ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সাগরে মানবপাচারে এখনও ধরা পড়েনি কোন গডফাদার

প্রকাশিত: ০৬:২০, ১১ জুন ২০১৫

সাগরে মানবপাচারে এখনও ধরা পড়েনি কোন গডফাদার

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ সমুদ্রের ভয়ঙ্কর পথে মানবপাচারের মতো জঘন্যতম ঘটনায় হাতেগোনা কিছু দালাল ধরা পড়লেও দালাল গ্যাংয়ের বহু সদস্য ও গডফাদাররা এখনও গ্রেফতার এড়িয়ে থাকতে সক্ষম হয়েছে। কক্সবাজারসহ দেশের অন্তত সতেরোটি জেলা থেকে যেসব মানুষ এসব দালাল ও গডফাদারদের প্রলোভনে পড়ে পাচার হয়ে নিখোঁজ রয়েছে এদের পরিবার ও স্বজনরা দুঃসহ বেদনা নিয়ে শোকাবহ পরিবেশে দিন অতিবাহিত করছে। পাচার হয়ে যাওয়াদের মধ্যে যাদের মৃত্যু নিশ্চিত হয়েছে তাদের স্বজনদের কান্না থমকে গেছে। আর যারা এখনও নিখোঁজ রয়েছে তাদের স্বজনরা এখনও আশায় বুক বেঁধে রয়েছে এ আশায় যে, বন্দীশালা, জেলখানা, আশ্রয়শিবির বা বিভিন্ন দেশে উদ্ধার হওয়া দল থেকে হয়ত তারা ফিরে আসতে পারে। এদিকে গত সোমবার মিয়ানমার থেকে যে ১৫০ জন বাংলাদেশীকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে তাদের মধ্য থেকে ১২২ জনকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। এদের প্রায় সকলেই প্রাপ্ত বয়স্ক। আর এদের মধ্যে থাকা ২৪ শিশুকে বুধবার কক্সবাজার আদালতে সোপর্দ করে পুলিশের জিম্মায় দেয়া হয়েছে। অবশিষ্ট ৪ জনের মধ্যে একজন মানবপাচারকারী দালাল হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। অবশিষ্ট ৩ জনের মধ্যে একজন মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নাগরিক। সে উখিয়ার রোহিঙ্গা বস্তিতে বসবাস করে থাকলেও নিবন্ধিত নয়। আর দুজনের বিরুদ্ধে নিজ নিজ এলাকার থানায় বিভিন্ন মামলা থাকায় জেলহাজতে প্রেরণ করা হয়েছে আদালতের নির্দেশে। এদিকে নতুন করে আরও চার দালাল গ্রেফতার হয়েছে। অপরদিকে থাই পুলিশের পক্ষ থেকে বুধবার বলা হয়েছে সমুদ্রপথে পাচারের ঘটনা ও বন্দীশিবির এবং গণকবর নিয়ে সে দেশের পুলিশের তদন্ত কাজ প্রায় শেষ হয়েছে। এ রিপোর্ট সে দেশের এটর্নি জেনারেলের কাছে এ মাসের শেষদিকে পাঠানো হবে বলে বার্তা সংস্থা রয়টার সূত্রে জানানো হয়েছে। ইতোমধ্যে থাইল্যান্ডে এ ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর ৫৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। যাদের মধ্যে পুলিশ কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ এবং একজন মিলিটারি জেনারেল রয়েছেন। কোন গডফাদার ধরা পড়েনি ॥ দেশ ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বঙ্গোপসাগর হয়ে আন্দামান সাগর এলাকাজুড়ে মানবপাচার, বন্দীশিবির ও গণকবরের যে ঘটনা আবিষ্কার হয়েছে এর সঙ্গে জড়িত বাংলাদেশী কোন গডফাদার এখনও গ্রেফতার হয়নি। গডফাদারদের নিয়োজিত অসংখ্য দালাল ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে। অথচ কক্সবাজার অঞ্চল এবং দেশের আরও সতেরোটি জেলা থেকে হাজার হাজার অবৈধ অভিবাসী প্রত্যাশীদের প্রলোভনে ফেলে এরা দুর্গম সমুদ্রপথে পাচার করেছে। এ পাচার প্রক্রিয়ায় অনেককে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার জঙ্গলে বন্দী রেখে মুক্তিপণ আদায়ের যে ঘটনা বেরিয়ে এসেছে তা রীতিমতো রোমহর্ষক। এসব হতভাগ্য অভিবাসীর অনেকেরই মৃত্যু হয়েছে অনাহারে অর্ধাহারে ও নির্যাতনে। দালালরা বেপরোয়া হয়ে উঠে যেভাবে ॥ উখিয়ার জুম্মাপাড়ার ছানাউল্লাহ, শিকদার বিলের আবুল কালাম, ফয়েজ সিকদার, শামসুল আলম, হুমায়ুন রশিদ বাপ্পু, বেলাল মেম্বার, রস্তম আলী, ছৈয়্যা, নুরুল কবির, কায়ছার আহমদ জনি, রুবেল, মুসলেম উদ্দিন ও রেজিয়া আক্তার রেবিসহ পাচারকারীরা অনেকে দু’তিন বছর আগেও ছিলেন দিনমজুর, গাড়ির হেলপার, নৌকার মাঝি, পোনা আহরণকারী, জেলে ও জীবন বীমার মাঠকর্মী। এখন তারাই একাধিক বাড়ি-গাড়ি আর বিপুল পরিমাণ বিত্তবৈভবের মালিক। তারা রাতারাতি কোটিপতি বনে গেলেও কখনও কেউ তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়নি। যে কারণে অনেকটা বেপরোয়া হয়ে উঠে কক্সবাজার অঞ্চলের মানবপাচারকারী সিন্ডিকেট। কক্সবাজার জেলার ৮টি থানায় এমন কোন এলাকা নেই, যেখান থেকে দালালরা মালয়েশিয়ায় লোক পাচার করেনি। এদের মধ্যেÑ ঈদগাঁও কালিরছড়ার মঞ্জুর আলম ও তার ভাই পুতুইক্যা, উখিয়া পাইন্যশিয়ার হাঙ্গামা বেলাল, মাহমুদুল হক বাবুল, সোনারপাড়ার মুসলেম উদ্দিন, খুনিয়া পালংয়ের আবদুল্লাহ বিদ্যুত, লিংকরোডের নাসির, টেকপাড়ার মিজান, রামু রশিদনগরের মোঃ হোছন, সোনারপাড়ার জমির আহম্মদ, সোনাইছড়ির শফি আলম, আবু ছিদ্দিক ও জালাল উদ্দিনসহ অনেকের নামে মামলা না থাকায় তারা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে বলে জানা গেছে। অথচ ঈদগাঁও কালিরছড়ার দালাল মঞ্জুর আলমের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামে পুলিশ এসল্ট মামলার গ্রেফতারি পরোয়ানাও রয়েছে। তার ভাই মানবপাচারকারী পুতুইক্যার বিরুদ্ধে বিচারাধীন রয়েছে হত্যাসহ একাধিক মামলা। পুতুইক্যা গ্রেফতার এড়াতে পালিয়ে গিয়ে কিছুদিন বিদেশে অবস্থানের পর দেশে ফিরে মানবপাচার কাজে জড়িয়ে পড়ে বহু লোকজনকে পাচার করে দিয়েছে মালয়েশিয়ায়। ওই মানবপাচারকারী পুতুইক্যা ও মঞ্জুর আলম দুই সহোদর আদালতের গ্রেফতারি পরোয়ানা মাথায় প্রকাশ্যে ঈদগাঁও বাজারে ঘুরে বেড়ালেও পুলিশের সঙ্গে সখ্য থাকায় তারা গ্রেফতার হচ্ছে না বলে স্থানীয়দের অনেকে অভিযোগ করেছে। মানবপাচার করে এরা বিত্তের মালিক বনে গেছে। ২০ দালালের বিরুদ্ধে মামলা ॥ এদিকে মিয়ানমার থেকে ফিরিয়ে আনা ১৫০ জনের মধ্যে শনাক্ত হওয়া দালাল হামিদ হোসেনকে প্রধান আসামি করে ২০ দালালের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। মঙ্গলবার রাতে উদ্ধার হওয়া চকরিয়ার এক অভিবাসী ফজল করিমের পুত্র একরাম হোসেন বাদী হয়ে কক্সবাজার সদর মডেল থানায় এ মামলাটি দায়ের করেন। কক্সবাজার সদর মডেল থানার ওসি কাজী মতিউল ইসলাম জানান, উদ্ধার হওয়া ভিকটিমের পক্ষ থেকে আবেদনে প্রেক্ষিতে ২০ দালালের বিরুদ্ধে দায়ের করা এজাহারটি মামলা হিসেবে রুজু করা হয়েছে। মামলার প্রধান আসামি উখিয়া কুতুপালং শরণার্থী শিবিরের ব্লক-এফ, শেড-১৫ এর সলিম উল্লাহর পুত্র রোহিঙ্গা দালাল হামিদ হোসেন। তিনি জানান, মামলার আসামি দালালদের বিরুদ্ধে মানবপাচারের আরও একাধিক মামলা রয়েছে। তাদেও বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হবে। আরও চার দালাল গেস্খফতার ॥ কক্সবাজারের চকরিয়া ও টেকনাফ থানা পুলিশ অভিযান চালিয়ে চার মানবপাচারকারীকে গ্রেফতার করেছে। থানা সূত্র জানায়, বুধবার রাতে হ্নীলা মৌলভীবাজার এবং সাবরাং কুয়াইনছড়ি পাড়ায় পুলিশ এ অভিযান চালায়। ধৃত দালালরা হচ্ছেÑ হ্নীলা মৌলভীবাজার এলাকার হাজী সিরাজ আহমদের পুত্র জাহিদুল মোস্তাফা ও সাবরাং কুয়াইনছড়িপাড়ার মৃত আমির হোছেনের পুত্র মোজাহের আহমদ। চকরিয়ায় আটক হওয়া মানবপাচারকারীরা হচ্ছেÑ দক্ষিণ বরইতলীর পাহাড়তলীর মোক্তার আহমদ কালুর পুত্র মহিবুল্লাহ প্রকাশ নেজাম ও মিয়ানমারের মংডু আইসচুরাতার খুইল্যা মিয়ার পুত্র মোঃ শফি। রোহিঙ্গা শফি উখিয়ার কোটবাজার মনির মার্কেটে সমিরা বেগমের ভাড়া বাসায় অবস্থান করে মানবপাচার করত বলে স্বীকার করেছে। আটক মানবপাচারকারী মহিবুল্লাহ বলেন, গত ৬ মাস পূর্বে দক্ষিণ বরইতলীর আবদু শক্কুরের পুত্র মোহাম্মদ ইউছুফ ও মৃত আবদুল নবীর পুত্র মোহাম্মদ মনজুর আলমকে দুই লাখ করে ৪ লাখ টাকা নিয়ে টেকনাফ হয়ে সাগর পথে মালয়েশিয়া পাঠানো হয়। তারা এখন কোথায় আছে, পাচারকারীসহ আত্মীয়দের কেউ জানে না। এ ছাড়া মহিবুল্লাহ মহেশখালীর কুতুবজুম নয়াবাজার শ্বশুরবাড়িতে থেকে বেকার ও নিম্নআয়ের লোকজনকে প্রলোভন দেখিয়ে ধৃত বর্মাইয়া শফির মাধ্যমে সাগরপথে কিশোর এবং যুবকদের মালয়েশিয়া পাচার করেছে বলে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছে। মিয়ানমার থেকে তালিকা আসেনি ॥ দালাল চক্রের খপ্পরে পড়ে সাগরপথে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমাতে গিয়ে মিয়ানমারের জলসীমা থেকে দেশটির নৌবাহিনী মারফত প্রথম দফায় উদ্ধার হওয়া ২০৮ ব্যক্তির মধ্যে ১৫০ জনকে বাংলাদেশ সরকার এ দেশের নাগরিক বলে নিশ্চিত করে ফিরিয়ে এনেছে। দ্বিতীয় দফায় উদ্ধার হওয়া ৭২৭ জন অবৈধ অভিবাসীর মধ্যেও প্রায় ৫ শতাধিক বাংলাদেশের নাগরিক বলে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ দাবি করলেও এদের তালিকা এখনও বাংলাদেশকে দেয়া হয়নি। কক্সবাজার ১৭ বিজিবি সেক্টর কমান্ডার সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে বলেন, উদ্ধারকৃত ৭২৭ জনের মধ্যে বাংলাদেশীদের তালিকা প্রেরণ করতে মিয়ানমারকে অনুরোধ করা হয়েছে। তালিকা পেলে এভাবে তাদেরও যাচাই-বাছাই করে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা নেয়া হবে। কক্সবাজার বিজিবি-১৭ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল খন্দকার সাইফুল আলম বুধবার জনকণ্ঠকে বলেন, উদ্ধার হওয়া ৭২৭ ব্যক্তির পরিচয় জানতে মিয়ানমারে দুই দেশের কন্স্যুলেট কাজ করছে। এ ব্যাপারে দেশটির মংডুতে একটি নতুন অফিসও খোলা হয়েছে। তথ্য সংগ্রহের কাজ চলছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে যে কয়েক জনের তালিকা আমাদের হাতে আসবে, তাদেরই আমরা মিয়ানমার থেকে ফিরিয়ে আনব। দালালদের বিরুদ্ধে ফুঁসছে ক্ষতিগ্রস্তরা ॥ কক্সবাজার জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রশাসনের অভিযানের পাশাপাশি মানবপাচারকারী দালালদের বিরুদ্ধে ফুঁসছে সাধারণ মানুষ। উখিয়ার রোহিঙ্গা অধ্যুষিত জনপদ কুতুপালং এলাকায় মানবপাচারবিরোধী বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে স্থানীয় গ্রামবাসী। হেল্প কক্সবাজার এনজিও আয়োজিত মিছিলোত্তর সমাবেশে বক্তারা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ত্বরান্বিত করার দাবি জানিয়ে বলেন, কুতুপালং ক্যাম্পে অবস্থানরত নিবন্ধিত ১৩ হাজার ১৭৯ ও অনিবন্ধিত ৮০ হাজার রোহিঙ্গার কারণে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। রোহিঙ্গা মানবপাচারকারীর খপ্পরে পড়ে এলাকার অসংখ্য যুবক, ছাত্র ও প্রাপ্তবয়স্ক লোকজন মালয়েশিয়ার উদ্দেশে রওনা করে নিখোঁজ হয়েছে। তাদের স্বজনদের আহাজারিতে গ্রামের পরিবেশ ভারি হয়ে উঠছে। বুধবার বিকেলে কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কের কুতুপালং বাজার এলাকায় অনুষ্ঠিত এ সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে হেল্প কক্সবাজারের নির্বাহী পরিচালক আবুল কাশেম বলেন, রোহিঙ্গা বস্তিতে বসবাসরত ৮০ হাজার রোহিঙ্গা নিয়ন্ত্রণহীনভাবে চলাফেরা করার সুযোগে মানবপাচারকারীরা বেপরোয়া হয়ে মালয়েশিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে লোকজন পাচার করছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কমিটির সদস্য সাবেক ইউপি সদস্য বখতেয়ার আহমদ বলেন, রোহিঙ্গা বস্তি থেকে লোকজন পাচার হওয়ার খবরে মিয়ানমার থেকে সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশও অব্যাহত রয়েছে। তাই এসব রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের আওতায় আনা না হলে মানবপাচারসহ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ কোনভাবেই দমন করা সম্ভব হবে না।
×