ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মুজিব-ইন্দিরা চুক্তিকে যারা ‘গোলামির চুক্তি’ বলেছিল, তারা আজ সাধুবাদ জানাচ্ছে ॥ সংসদে প্রধানমন্ত্রী

জিয়া-এরশাদ-খালেদা ৪০ বছরে যা পারেননি আমরা তা পেরেছি

প্রকাশিত: ০৬:০১, ১১ জুন ২০১৫

জিয়া-এরশাদ-খালেদা ৪০ বছরে যা পারেননি আমরা তা পেরেছি

সংসদ রিপোর্টার ॥ প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত স্থল সীমান্ত চুক্তিকে বর্তমান সরকারের ‘বড় রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সাফল্যে’ উল্লেখ করে বলেছেন, এর মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বর্তমানে নতুন মাত্রা লাভ করেছে। বাংলাদেশের জন্য বিরাট সাফল্যে অর্জিত হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে থাকলেও যাদের (বিএনপি-জামায়াত) অন্তরে পরাজিত শক্তি পাকিস্তানের ধ্যান-ধারণা রয়ে গেছে, যারা এখনও পাকিস্তানের পরাজয় মেনে নিতে পারেনিÑ তারাই মুজিব-ইন্দিরা চুক্তিকে ‘গোলামী চুক্তি’ বলেছিল। যারা অতীতে এসব কথা বলেছিল, তারাই এখন সম্পাদিত এই চুক্তিকে সাধুবাদ ও ধন্যবাদ জানাচ্ছে। বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ক্ষমতায় থেকে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে ওপর দিয়ে ঝগড়াঝাটি, আর ভেতরে দিয়ে তোষামোদী করে দেশের জন্য কোনকিছু অর্জন করা যায় না। বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের মাধ্যমে আলোচনার ভিত্তিতেই যে সবকিছুই অর্জন করা যায়, যে কোন সমস্যার সমাধান করা যায়- তা আমরা প্রমাণ করেছি। আওয়ামী লীগ সরকারের দীর্ঘ কূটনৈতিক তৎপরতার ফলেই এই চুক্তির সফল বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে। স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে বুধবার জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রীর জন্য নির্ধারিত প্রশ্নোত্তর পর্বে সরকারী দলের সংসদ সদস্য এস এম মোস্তফা রশিদী সুজার সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন। ভারত থেকে প্রাপ্ত ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ সুবিধা কোন শর্ত ছাড়াই নেয়া হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা কোন শর্ত মেনে কিছু নেই না। শর্তহীনভাবে প্রাপ্ত এই দুই বিলিয়ন ডলার আমরা স্বাধীনভাবে আমাদের ইচ্ছামতো প্রকল্পে ব্যবহার করতে পারব। প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্থলসীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে দুদেশের পারস্পরিক সহযোগিতা ও উন্নয়নের নতুন নতুন ক্ষেত্র উন্মোচিত হয়েছে। দুদেশের মধ্যে রাজনৈতিক, সরকারী এবং সাধারণ জনগণ পর্যায়ে যোগাযোগ বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। আগামীতে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যে সকল দ্বিপাক্ষিক সমস্যা রয়েছে, সেগুলো আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করে বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। আর এ সব কিছুই আওয়ামী লীগ সরকারের দীর্ঘদিনের কূটনৈতিক তৎপরতার ফলেই সফল বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে। এতে করে উভয় দেশের জনগণের মাঝে বিদ্যমান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরও গভীর ও জোরদার হবে। অপর এক সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যখন ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী চুক্তি এবং ’৭৪ সালে ঐতিহাসিক মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি হয়, তখন পরাজিত শক্তির দোসররা গোলামীর চুক্তি, দাসত্বের চুক্তি, দেশ বিক্রির চুক্তিÑ ইত্যাদি নানা মন্তব্য করে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছে। পাকিস্তানের পরাজয় যারা মানতে পারে না, তারাই এসব কথা বলেছে। আওয়ামী লীগ যাই-ই করুক, যে অর্জনই করুক, তাদের ভাল লাগে না। বাংলাদেশের বিজয়ের কথা শুনলেই তাদের মন খারাপ হয়। এ প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি এবং পার্বত্য শান্তি চুক্তির সময় বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার নানা নেতিবাচক উক্তির কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, গঙ্গার পানি চুক্তির সময় বিএনপি-জামায়াত বলেছিল এই চুক্তি হবে না, করলে ৫ বছরের চুক্তি করতে হবে। আমরা ৩০ বছরের চুক্তি করার পর তারা বলতে থাকে, চুক্তি হলেও পানি আসবে না, পদ্মায় পানি নেই। আর গঙ্গার পানিতে অজু হবে না। এসব বলে জাতিকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে। তিনি বলেন, পার্বত্য শান্তি চুক্তির সময়ও বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া বলেছিলেন এই চুক্তি হলে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে ফেনী পর্যন্ত ভারত হয়ে যাবে। চুক্তির পর আমি বলেছিলাম, এখন বিএনপি নেত্রী সিদ্ধান্ত নিক তিনি বাংলাদেশের সংসদে নাকি ভারতের লোকসভার সংসদ সদস্য হবেন। কারণ তিনি ফেনী থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন। শুধুমাত্র ভারত বিরোধিতা আর জনগণকে বিভ্রান্ত করতেই এসব বলা হয়েছে। গত ৪০ বছর জিয়া-এরশাদ-খালেদা জিয়ার সরকার যা করতে পারেনি, আমরা তা করতে সক্ষম হয়েছি। তখন যারা বিরোধিতা করত, এখন তারাই সাধুবাদ জানাচ্ছে। এটা তাদের রাজনৈতিক চরিত্র। বাংলাদেশের সঙ্গে স্থল চুক্তি ভারতের লোকসভায় পাসের সময় দলমত নির্বিশেষে সকল রাজনৈতিক দল সমর্থন জ্ঞাপনের জন্য প্রধানমন্ত্রী সেদেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলের নেতাসহ সকল রাজনৈতিক দল ও ভারতের জনগণকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ৬৮ বছর পর এই সমস্যার সমাধান হলো। দেশের জনগণ যদি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে না হারাত, তবে অনেক আগেই এই চুক্তি সম্পাদিত হতো। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরবর্তী কোন সরকারই এ ব্যাপারে কোন উদ্যোগ নিতে সাহস দেখাতে পারেনি। আমরা তা পেরেছি এবং বাস্তবায়নও করেছি। তিনি বলেন, পরবর্তীতে দুই দেশের কর্মকর্তারা অতি শীঘ্রই চুক্তির বিধানগুলো মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়ন করবেন। এর ফলে দুই বন্ধুপ্রতীম দেশের মাঝে দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত সমস্যার সমাধান বিশেষ করে ছিটমহলবাসীদের মানবিক সমস্যার সমাধান হবে। বাংলাদেশ ১০ হাজার একর জমি বেশি পাবে ॥ প্রধানমন্ত্রী বলেন, দুদেশের মধ্যে সম্পাদিত স্থল সীমান্ত চুক্তির ফলে বাংলাদেশ নীট ১০ হাজার ৫০ একর জমি বেশি পাবে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অবস্থিত ভারতীয় ১১১টি ছিলমহলের আয়তন ১৭ হাজার ১৬০ একর এবং জনসংখ্যা ৩৭ হাজার ৩৬৯ জন। পক্ষান্তরে ভারতের অভ্যন্তরে অবস্থিত বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের আয়তন ৭ হাজার ১১০ একর এবং জনসংখ্যা ১৮ হাজার ৯০ জন। স্বাক্ষরিত প্রটোকল অনুযায়ী যে ছিটমহল যে দেশের অভ্যন্তরে অবস্থিত তা সেই দেশেরই অন্তর্ভুক্ত হবে। ছিটমহলে বসবাসকারী জনগণ সংশ্লিষ্ট ছিটমহল স্বাভাবিকভাবে যে দেশে অন্তর্ভুক্ত হবে, স্থানান্তরের মাধ্যমে তিনি সে দেশের নাগরিক হবেন, তবে ইচ্ছা করলে তাদের পূর্ববর্তী দেশের নাগরিক হওয়ারও সুযোগ থাকবে। স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য ডাঃ রুস্তম আলী ফরাজীর এক সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আগে ভারত আমাদের এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার দিয়েছিল, এবার নরেন্দ্র মোদি সরকার দুই বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে। তবে এ ঋণে কোন শর্ত নেই। আমরা আমাদের মতো করে স্বাধীনভাবে যেসব প্রকল্পে এই ঋণ ব্যয় করতে চাই সেটাই করতে পারব। আর আমরা কোন শর্ত মেনে কোনকিছু নেই না। বন্ধুত্বের নির্দশন হিসেবে ভারত সরকার এ টাকা দিয়েছে, আমরা তা নিয়েছি। এই ঋণের অর্থ কোনভাবে ব্যবহার করে দেশের দ্রুত উন্নয়ন করা যায়, সে ব্যাপারে সরকারী পর্যায়ে চিন্তা-ভাবনা চলছে। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের সারাবিশ্বের ওপর প্রকাশিত জিডিপি প্রবৃদ্ধির রিপোর্ট তুলে ধরে বলেন, বাংলাদেশ দ্রুত সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, বিশ্বব্যাংকের রিপোর্টেও তার প্রমাণ মেলে। জিডিবির বিবেচনায় বিশ্বের মধ্যে ২০১৩ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৩০তম। আর ২০১৫ সালে বাংলাদেশ ৩৩তম স্থানে উন্নীত হয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ যেভাবে অর্থনৈতিকভাবে উন্নয়ন করে যাচ্ছে তাতে ২০২১ সালে মধ্যম আয়ের দেশে এবং ২০৪১ সালে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবেই। চারদেশীয় আন্তঃযোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠছে ॥ সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডাঃ দীপু মনির অপর এক প্রশ্নের জবাবে সংসদ নেতা বলেন, আমরা প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে আঞ্চলিক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলছি। বাংলাদেশ-ভারত-নেপাল-ভুটান এবং বাংলাদেশ-ভারত-মিয়ানমার-চীন এই চারদেশীয় যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রক্রিয়া চলছে। রেল-সড়ক-নৌ ও আকাশপথে এ যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। আর এটি সম্ভব হলে শুধু এসব দেশই নয়, পুরো দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের উন্নতি হবে, দারিদ্র্যের হাত থেকে মুক্তি পাবে। ভুটান থেকে জলবিদ্যুত আমদানির কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভারত থেকে ইতোমধ্যে আমরা ৫শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুত ক্রয় করছি, ত্রিপুরা থেকে আরও একশ’ মেগাওয়াট বিদ্যুত আনা হবে। এছাড়া ভুটান থেকে জলবিদ্যুত ক্রয় কিংবা বিনিয়োগের ব্যাপারে ভারতের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। এছাড়া পাইপলাইনের মাধ্যমে মিয়ানমার থেকেও গ্যাস আমদানির বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে। খুব শীঘ্রই এসব ব্যাপারে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। নাশকতাকারীদের বিচার করা হবে ॥ সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য বেগম নাসিমা ফেরদৌসীর প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিধান ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সরকার দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। আন্দোলনের নামে যারা পেট্রোলবোমা, অগ্নিসংযোগ ও সন্ত্রাসী কর্মকা- করে জানমালের ক্ষতিসাধনসহ মানুষ হত্যা করেছে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। জড়িতদের আইনের আওতায় এনে বিচারের জন্য সন্ত্রাসবিরোধী আইন অনুযায়ী প্রত্যেক জেলার দায়রা জজ ও অতিরিক্ত দায়রা জজকে বিচার করার এখতিয়ার প্রদান করা হয়েছে। সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ধারা অনুযায়ী হুকুমের আসামিসহ অপরাধ সংঘটনে সাহায্য বা সহায়তাকারী হিসেবে চিহ্নিত হলে তাদের বিচারের আওতায় আনা হবে। স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য হাজী মোহাম্মদ সেলিমের সদ্য সমাপ্ত তিন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, দেশের ইতিহাসে এই প্রথম কোন প্রাণহানি ছাড়াই অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে তিন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অসৎ উদ্দেশ্যে বিএনপি নির্বাচনের দিন পূর্বাহ্নে পূর্ব পরিকল্পনা মাফিক নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। যদিও নির্বাচনের দিন প্রার্থিতা প্রত্যাহারের কোন আইনগত সুযোগ নেই। বিএনপি শুধুমাত্র রাজনৈতিক ফায়দা লুটার অজুহাত খোঁজার লক্ষ্যেই এ কাজ করেছে। সারাদেশে বিদ্যুতের প্রি-পেইড মিটার চালু হবে ॥ বিপুল অর্থের বিনিময়ে কষ্টার্জিত উৎপাদিত বিদ্যুত ব্যবহারে মিতব্যয়ী হওয়ার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভৌতিক বিলসহ বিদ্যুতের সিস্টেম লস কমাতে সারাদেশেই প্রি-পেইড বিদ্যুত মিটার চালু করা হবে। বিএনপি-জামায়াতের রেখে যাওয়া মাত্র ১৬শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুত থেকে আমরা স্বল্পতম সময়ে বিদ্যুত উৎপাদনের ক্ষমতা ১৩ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করেছি, যা অতীতে কেউ করতে পারেনি, ভবিষ্যতেও করতে পারবে না।
×