ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

নেপথ্যে গ্যাস সরবরাহে বিপর্যয়

গ্যাস বিদ্যুত ও পানি সঙ্কটে চট্টগ্রামে হাহাকার

প্রকাশিত: ০৫:১৪, ১০ জুন ২০১৫

গ্যাস বিদ্যুত ও পানি সঙ্কটে চট্টগ্রামে হাহাকার

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ গ্যাস নেই, বিদ্যুত নেই, পানি নেই। চট্টগ্রাম মহানগরজুড়ে সৃষ্টি হয়েছে হাহাকার। সঙ্কটের নেপথ্যে গ্যাস সরবরাহে বিপর্যয়। সিলেটের বিবিয়ানা গ্যাসফিল্ড থেকে উত্তোলিত কন্ডেনসেটের আধিক্যে মজুদ সুবিধার অভাবে গ্যাস উত্তোলন হ্রাস করতে বাধ্য হওয়ায় সরবরাহ লাইনে সঙ্কটে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আর কন্ডেনসেটের আধিক্যের মূল কারণ বেসরকারী রিফাইনারি কোম্পানিগুলোতে কন্ডেনসেট পরিশোধনে কমিশন বা মার্জিন পরিমাণ অর্ধেকে নেমে যাওয়ায়। জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে উত্তোলিত কন্ডেনসেট ইতোপূর্বেকার মতো বেসরকারী রিফাইনারিগুলোকে সরবরাহের ব্যবস্থা বাদ দিয়ে তা বিপিসির (বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন) মাধ্যমে সরবরাহের সিদ্ধান্ত কার্যকর হওয়ার পর দেশের দশ প্রাইভেট রিফাইনারি কন্ডেনসেট গ্রহণ একেবারে কমে গিয়েছে। এর ফলে কন্ডেনসেটের মজুদ বেড়ে গেছে, যা সংরক্ষণের সীমা ইতোমধ্যে অতিক্রম করেছে। অপরদিকে, সরকারী নিরীক্ষা বিভাগের অডিট আপত্তির কারণে বিপিসি গ্যাসফিল্ডসমূহ থেকে উত্তোলিত কন্ডেনসেট গ্রহণ করে তা বেসরকারী রিফাইনারিগুলোতে পুনসরবরাহ করার প্রক্রিয়ায় কমিশন বা মার্জিনের হার অর্ধেক হয়েছে। এ নিয়ে বিপিসি, জিটিসিএল ও পেট্রোবাংলা ত্রিপক্ষীয় বৈঠক হলেও সরকারী সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। ফলে সঙ্কট জিইয়ে আছে। মঙ্গলবার বিপিসি সূত্রে জানানো হয়, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মন্ত্রণালয় কন্ডেনসেট বিদেশে রফতানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ রফতানির প্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষ। ফলে গত প্রায় ছয়দিন ধরে ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নোয়াখালীতে গ্যাস সরবরাহ হ্রাস পেয়ে ব্যাপক সঙ্কট অব্যাহত রয়েছে। এ সঙ্কট সবচেয়ে বেশি দেখা দিয়েছে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে। গ্যাস সরবরাহ হ্রাস পাওয়ায় রাউজান তাপ বিদ্যুত কেন্দ্রের ২১০ মেগাওয়াটের একটি ইউনিট এবং কর্ণফুলীর দক্ষিণ পাড়ে পটিয়ার শিকলবাহার দেড় শ’ মেগাওয়াট তাপ বিদ্যুত কেন্দ্রে উৎপাদন বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে পিডিবি। গ্যাসের অভাবে বিদ্যুত কেন্দ্র বন্ধ হয়ে লোডশেডিং বেড়েছে। ওয়াসার পানি সরবরাহের জন্য ব্যবহৃত অধিকাংশ পাম্প চলছে না। ফলে নগরীতে যে পরিমাণ পানি সরবরাহ হয়ে আসছিল তাতেও ধস নেমেছে। চট্টগ্রাম মহানগরীতে ওয়াসা সরবরাহকৃত পানির চাহিদা প্রায় ৫০ কোটি লিটার। ওয়াসা সরবরাহ করতে পারে চাহিদার অর্ধেকেরও কম। এ অবস্থায় গ্যাস বিপর্যয়ের কারণে তা বর্তমানে ১৮ থেকে ১৯ কোটি লিটারে নেমে এসেছে। চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী একেএম ফজলুল্লাহ মঙ্গলবার জনকণ্ঠকে জানান, এমনিতেই ভূগর্ভস্থ পানির লেয়ার বহু নিচে নেমে গেছে। ফলে ওয়াসা নিয়ন্ত্রিত এবং ব্যক্তি পর্যায়ের ডিপ টিউবওয়েরগুলো প্রয়োজনীয় পানি উত্তোলন করতে ব্যর্থ হচ্ছে। সরবরাহের বেশিরভাগ পানি ওয়াসা থেকে আসে। বর্তমানে ওয়াসার যে ৯৬ পাম্প সচল রয়েছে সেগুলো বিদ্যুতের অভাবে প্রায় বন্ধ থাকছে। এর ফলে পানির পাম্পিং ব্যবস্থায় বিপর্যয় নেমেছে। তবে হালদা ও কর্ণফুলী নদী থেকে যে পানি সরবরাহ করা হয়ে থাকে তা এখনও অব্যাহত রয়েছে। এর ফলে নগরীর কিছু কিছু অংশে ওয়াসার পানি মিলছে। ওয়াসা চেয়ারম্যান বলেছেন, আগামীতে রাঙ্গুনিয়ায় কর্ণফুলী প্রকল্প সম্পূর্ণভাবে চালু না হওয়া পর্যন্ত চট্টগ্রামে পানি সঙ্কট রয়েই যাবে। এ প্রকল্পটি আগামী অক্টোবরের মধ্যে চালু হওয়ার কথা রয়েছে। এটি চালু হলে অতিরিক্ত ১৪ কোটি লিটার পানি পাওয়া যাবে বলে তিনি জানান। এর আগ পর্যন্ত বৃষ্টিই একমাত্র ভরসা বলে তিনি জানান। কর্ণফুলী গ্যাস কোম্পানি সূত্রে জানানো হয়েছে, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সোমবার রাত থেকে ১শ’ এমএমসিএফডি গ্যাস সরবরাহ বাড়িয়েছে বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র থেকে। কিন্তু এর আগে পাইপ লাইনে গ্যাস যে ফুরিয়ে গিয়েছিল তা সম্পূর্ণ করতে ওই ১শ’ এমএমসিএফডি গ্যাস লেগে যায়। এতে করে তা ভোক্তা পর্যায়ে সবরাহ প্রক্রিয়ায় উন্নতি হয়নি। তবে কর্তৃপক্ষ আশা করছে, বিবিয়ানা থেকে বর্ধিত গ্যাস সরবরাহ অব্যাহত থাকলে সঙ্কট ধীরে ধীরে কমে যাবে। পেট্রোবাংলা সূত্রে জানানো হয়, বর্তমানে কন্ডেনসেটের যে আধিক্য রয়েছে তা বেসরকারী রিফাইনারিগুলোকে সরবরাহের তৎপরতা চলছে। যে কোনভাবেই হোক বেসরকারী কোম্পানিগুলো যে গ্যাস সরবরাহের পিছ টান দিয়েছিল তা সুরাহার চেষ্টা চলছে। এরপরেও উদ্ধৃত্ত কন্ডেনসেট বিদেশে রফতানির ব্যবস্থার জন্য মন্ত্রণালয় থেকে বিপিসিকে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। পিডিবি সূত্রে বলা হয়েছে, প্রয়োজনীয় গ্যাসের অভাবে রাউজান তাপ বিদ্যুত উৎপাদন কেন্দ্রের দুটির মধ্যে ২১০ মেগাওয়াটের একটি ইউনিট বন্ধ রাখা হয়েছে। অনুরূপভাবে শিকলবাহা ১১০ মেগাওয়াটের বিদ্যুত উৎপাদন কেন্দ্রটি গ্যাস সঙ্কটে পড়ে অচল রয়েছে। এ দুটি কেন্দ্র থেকে বিদ্যুত সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বন্দরনগরী চট্টগ্রামে লোডশেডিংয়ের মাত্রা বেড়েছে। আর এতে করে কর্তৃপক্ষ লোডশেডিং করতে বাধ্য হচ্ছে। একদিকে, প্রচ- গরম ও দাবদাহ। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিদ্যুতের লোডশেডিং মানুষের জীবনে চরম দুর্ভোগ নেমে এসেছে। এর পাশাপাশি সিএনজি ফিলিং স্টেশনগুলোতে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অধিকাংশ স্টেশন থেকে গ্যাসনির্ভর যানবাহনগুলো সঙ্কটে পড়েছে। গ্যাস, বিদ্যুত ও পানি সঙ্কট একসঙ্গে শুরু হওয়ায় চট্টগ্রাম মহানগরীর প্রায় ৫০ লাখ বাসিন্দার মাঝে হাহাকার সৃষ্টি হয়েছে। পিডিবি, কর্ণফুলী গ্যাস কোম্পানি ও চট্টগ্রাম ওয়াসার সূত্রগুলো যুগপৎভাবে বলছে, এ সঙ্কটের নেপথ্যের মূল কারণ গ্যাস সঙ্কট। চট্টগ্রামে ইতোপূর্বে একসঙ্গে ত্রিমুখী সঙ্কট কখনও সৃষ্টি হয়নি। ফলে মানুষ যন্ত্রণাকাতর হয়ে উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় পড়েছে। বিশেষ করে বহুতল ভবনের বাসিন্দারা পানি ও গ্যাস সঙ্কটে চরম দুর্ভোগের শিকার। এরপরও কর্মকর্তারা আশা করছেন বিবিয়ানা গ্যাস কর্তৃপক্ষ তাদের কন্ডেনসেট মজুদ প্রক্রিয়ায় সুরাহা করতে পারলে গ্যাস সরবরাহ বৃদ্ধি পাবে আর এতে করে বিদ্যুত ও পানি সরবরাহ ব্যবস্থায় উন্নতি ঘটবে। তবে মঙ্গলবার পর্যন্ত অবস্থা আগের তিমিরেই রয়ে গেছে।
×