ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আবীর আবদুল্লাহর আলোকচিত্রে নেপাল

শোক-দ্বীপ থেকে খুঁড়ে আনা জীবন, জোরালো শিল্পভাষা

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ৮ জুন ২০১৫

শোক-দ্বীপ থেকে খুঁড়ে আনা জীবন, জোরালো শিল্পভাষা

মোরসালিন মিজান এইটুকুন দেশ। দেখে তবু শেষ করা যায় না। এত রূপ! এত এত সুন্দর! অথচ এখন প্রায় সবই স্মৃতি। অতি সম্প্রতি নেপালের ছোট্ট বুকে দুঃসহ এই স্মৃতি এঁকে দিয়েছে ভূমিকম্প। মাত্র ৫৫ সেকেন্ডের কম্পন। তাতেই ভরপুর প্রাণের দেশটি পরিণত হয়েছে মৃত্যুপুরীতে! কালের সাক্ষী হয়ে বহুকাল দাঁড়িয়ে থাকা ভবন ধসে পড়েছে। মাঝখান থেকে ভাগ হয়ে গেছে রাস্তা। মানুষ, মানুষকে রক্ষা করার দেবতাÑ কেউ অক্ষত নেই। হঠাৎই বিপুল পরিবর্তন। বিভৎস পরিবর্তন। হ্যাঁ, অনেক আলোকচিত্রী এই নেপালকে ক্যামেরাবন্দী করেছেন। যতটা সম্ভব দেখিয়েছেন। তবে আবীর আবদুল্লাহর হাতে ক্যামেরা যখন, কিছু অদেখা সামনে এসে দাঁড়ায়। জোরালো ভাষা পায় আলোকচিত্র। শিল্পীত উপস্থাপনা পায়। গ্যালারি চিত্রক ঘুরে আরও একবার সে উপস্থাপনা দেখা গেল। এখানে শুক্রবার থেকে চলছে স্বনামধন্য আলোকচিত্রীর একক প্রদর্শনী। সপ্তাহব্যাপী প্রদর্শনীতে মোট ৯৫টি ছবি। ছোট বড় মাঝারি ছবিতে যে নেপাল, দেখে আঁতকে ওঠতে হয়। মন মনের অজান্তে ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। নেপালের বয়ান হলেও, আবীর আবদুল্লাহর আলোকচিত্র পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশকে সতর্ক করে দিতে ভুলে না। ধ্বংসের বিপরীতে দাঁড়িয়ে সবুজের পক্ষে সুন্দরের পক্ষে সেøাগান তুলে। জীবনের জয়গান গায়। গ্যালারিতে প্রবেশের আগেই চোখ চলে যায় হাতের বাম পাশের সিঁড়িতে। সিঁড়িটি বিধ্বস্ত। যেন বিধ্বস্ত। সিঁড়ির যেখানে শেষ, সেখানে মুখ থুবড়ে পড়েছে একটি বাড়ি। এই বাড়ি নেপালে ভেঙে পড়া বাড়ির ছবি আসলে। সব মিলিয়ে স্বল্পপরিসর স্থাপনাশিল্প। মূল প্রদর্শনীতে প্রবেশের আগেই এটি দর্শনার্থীর মনোজগতকে বিশেষভাবে তৈরি করে নেয়। ধ্বংসের মাঝে নিজেকে আবিষ্কারের পর শুরু হয় বাকি ছবি দেখা। আলোকচিত্রী শুরুটা করেছেন উপর থেকে। তাঁর বার্ডস আই ভিউ নেপালকে বড় পরিসরে দৃশ্যমান করে। ভূমিকম্প দৃশ্যমান হয় পাশের ছবিতে। এখানে ধ্বংস নয় শুধু, ধ্বংসের মাত্রা কত ভয়াবহ ছিল তা তুলে ধরার প্রয়াস। সফল প্রয়াস বলতে হবে। ছবিতে আকস্মিক ভূমিকম্পে খসে পড়া ইট কাঠের কোনটিই আস্ত নেই। বিল্ডিংয়ের ধ্বংসাবশেষ ছোটখাট পাহাড়ের উচ্চতা পেয়েছে। আলোকচিত্রীর বহুদিনের দক্ষ চোখ। তছনছ হয়ে যাওয়ার চারপাশ থেকে তিনি খুঁজে নেন ধ্যানমগ্ন গৌতম বুদ্ধকে। এই ক’দিন আগেও বুদ্ধের সৌম্য শান্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে নেপালের মানুষের ভেতরটা পড়ে ফেলা যেত। ভূমিকম্প পরবর্তী সময় বদলে দিয়েছে সে অভিব্যক্তি। পাথরমূর্তির পায়ের কাছে এখনও গড়াগড়ি খাচ্ছে পুজোর ফুল। কোন পূজারী নেই। অদ্ভুত শূন্যতা তাঁকে ঘিরে আছে। বার বার দেখা মুখটিকে এখানে বিষণœ মনে হয়। গোটা নেপালের নিস্তবদ্ধতা এই মুখ থেকে খুঁজে নিয়েছেন আলোকচিত্রী। প্রলয় থেকে বেঁচে যাওয়া মানুষের চোখে মুখে ক্যামেরার আলো ফেলেছেন। তখনই ফুটে ওঠেছে নিখুঁত বেদনা। তেমন একটি আলোকচিত্রে অশিথিপর বৃদ্ধা। চাদরে মুখ ঢেকে রেখেছেন। তাঁর দু’চোখ তুলে ধরছে বুকের হাহাকার। অন্য ছবিতে মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়া বাড়ির উঠোনে কী যেন খুঁজে ফেরা। খুঁড়োখুঁড়ি করে হয়ত জীবন খুঁজছেন বৃদ্ধা। এক দেয়ালে জীবন। অপর দেয়ালে আলোকচিত্রী দেখান মৃত্যুকে। মৃত্যুর ভীবৎস রূপ সচেতনভাবে এড়িয়ে যান তিনি। শোকটাকে শিল্পীত করেন। সামনে আনেন। একটি ছবিতে দেখা যায়, মৃত স্বজনকে নিয়ে শশ্মানে ছুটে চলার দৃশ্য। আরেকটি আলোকচিত্রে দাউ দাউ আগুন। একসঙ্গে জ্বলছে বেশ কয়েকটি চিতা। আশ্চর্য সুন্দর ফ্রেমিংয়ে ধরা পড়ে আরও দু’ একটি চরিত্র। এ ছবি দেখতে দেখতেই কানে আসে প্রার্থনা সঙ্গীত। আগরবাতির ঘ্রাণও নাকে পৌঁছে দেন কিউরেটর অনিন্দ্য কবির অভীক। আর তখন নতুন ভাষা পায় আলোকচিত্র। নেপালের শোক গ্যালারিতে এসে যেন আছড়ে পড়ে। অথবা দর্শক নিজেই নিজের অজান্তে পৌঁছে যান সেখানে। শুধু কী নেপাল? নেপালের ভাঙা বাড়ির ভেতরে দর্শকদের হাত ধরে নিয়ে চলেন আবীর আবদুল্লাহ। আর সব আলোকচিত্রী যা যা ফেলে গেছেন, তিনি খুঁজে নেন। রং করা জুতো, ছিটকে পড়া টুথব্রাশকে ভাষা দেন তিনি। খাবার টেবিল গ্লাস বাটি যেন মনে করিয়ে দেয়, এ জীবন কত ক্ষণস্থায়ী! কখনও কখনও কত বেদনার হতে পারে জীবন, বলে দিয়ে যায়। অনেক ছবিতে ফেটে চৌচির দেয়াল। দেয়ালে এখনও ঝুলছে প্রিয়জনের ছবি। সে ছবি সে দেয়াল এখন বেদনার কাব্য। গ্যালারির ভেতরে একই দৃশ্য দেখানো হয়েছে অনন্য সুন্দর একটি স্থাপনা শিল্পের মাধ্যমে। জানালার দিকে তাকালে বাইরেও দেখা যায় ধ্বংস। জানালাটি নিখুঁতভাবে ব্যবহার করে এই ধ্বংস দেখানো হয়েছে। তবে ধ্বংসকে শোক ব্যথা বেদনাকে শেষ আশ্রয় করেননি আলোকচিত্রী। বরং সবুজের পক্ষে সুন্দরের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। গেয়েছেন জীবনের জয়গান। ঘুরে দাঁড়ানোর কথা বলেছেন আলোকচিত্রে। সেখানে নতুন করে জীবন শুরুর গল্প। দেখে হেলাল হাফিজের কবিতার কথা মনে পড়ে যায়। যেখানে কবি বলছেনÑ যে মানুষ জীবনের সব ক’টি শোক-দ্বীপে গেছে,/ সব কিছু হারিয়েই সে মানুষ/হারাবার ভয় হারিয়েছে। একটি আলোকচিত্রেতো চোখ আটকে যায়। মৃত্যুপুরীতে এমনকি বিয়ের ছবি! ৮ হাজার মৃত্যুকে পেছনে ফেলে শ্বশুরবাড়িতে এসে পৌঁছেছেন কনে! প্রায় একই বার্তা দেয় খোলা আকাশের নিচে শুয়ে থাকা এক নারী। তাঁর ভুবন ভোলানো হাসি বলে দেখে মনে পড়ে যায় রবীন্দ্রনাথের সেই কালজয়ী গানÑ প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে/মোরে আরো আরো আরো দাও প্রাণ।/তব ভুবনে তব ভবনে/মোরে আরো আরো আরো দাও স্থান...। সব মিলিয়ে অনবদ্য প্রদর্শনী। আবীর আবদুল্লাহ সাংবাদিকতা সামান্য দূরে সরিয়ে রেখে ছবি তুলেছেন। সচেতনভাবেই সুপার এ্যাকশন ক্যামেরাবন্দী করতে যাননি। ব্যক্তির জায়গা থেকে দেখেছেন। দেখিয়েছেন। এই দেখা ভিন্নতর বৈকি! ‘রিজিলিয়ন্স এ্যান্ড এ্যান্ড রিজনস’ শীর্ষক প্রদর্শনী চলবে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত।
×