ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

একেএম মুজ্জাম্মিল হক

নবসাজে ঐতিহাসিক বড় সরদারবাড়ি

প্রকাশিত: ০৪:৫৭, ৮ জুন ২০১৫

নবসাজে ঐতিহাসিক বড় সরদারবাড়ি

রাজধানী ঢাকার অদূরে স্থাপত্যশৈলী এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ছায়া ঢাকা, হৃদয়ছোঁয়া নৈসর্গিক পরিবেশে সোনারগাঁর অবস্থান। এই সোনারগাঁর সঙ্গে জড়িয়ে আছে হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। মুঘল আমলে যে ২৪ বর্গমাইল আয়তনের এলাকাজুড়ে ছিল এর অবস্থান, এখন তার পরিচিতি নারায়ণগঞ্জ জেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপজেলা হিসেবে। ১৪ শতকে দিল্লী সুলতানের প্রতিনিধি শামসুদ্দিন ফিরোজ স্বাধীনতা ঘোষণা করে সোনারগাঁ থেকে নিজ নামে মুদ্রা প্রচলনের পর এটি ইতিহাসের পাথুরে পাতায় নিজের স্থান করে নেয়। গবেষকদের মতে, সোনারগাঁর প্রাচীন নাম সুবর্ণবীথি বা সুবর্ণগ্রাম। এই সুবর্ণগ্রাম থেকেই সোনারগাঁ নামের উদ্ভব। প্রবাদ আছে, ‘মহারাজ জয়ধ্বজের সময় অত্র অঞ্চলে সুবর্ণবৃষ্টি হয়েছিল বলে এ স্থান সুবর্ণগ্রাম নামে পরিচিতি লাভ করে।’ এছাড়া অনেকে বলেন, ‘বার ভূঁইয়া প্রধান ঈশা খাঁর স্ত্রী সোনাবিবির নামানুসারে এর নাম হয়েছে সোনারগাঁ।’ মধ্যযুগে সোনারগাঁ ছিল মুসলিম সুলতানদের রাজধানী। এর পূর্বে মেঘনা নদী, দক্ষিণ-পশ্চিমে শীতলক্ষ্যা, দক্ষিণে ধলেশ্বরী এবং উত্তরে ব্রহ্মপুত্র দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকায় এলাকাটি খুব উন্নত ছিল। সেজন্য অনেক রাজা-বাদশাহ সানন্দে সোনারগাঁ রাজধানী গড়ে তুলেছিলেন। ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দে ফখরুদ্দীন মোবারক শাহের সময়ে সোনারগাঁ পূর্ব বাংলার রাজধানী হিসেবে প্রথম মর্যাদা লাভ করে। সোনারগাঁর প্রাণকেন্দ্রে বিখ্যাত বড় সরদারবাড়ি মুসলিম ঐতিহ্যিক স্থাপনার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। যার পরিচিতি বাংলার প্রতাপশালী শাসক ঈশা খাঁর বাড়ি হিসেবে। বার ভূঁইয়া, মুঘল আর ব্রিটিশ, সময় হিসেবে প্রায় ৬০০ বছর। বাংলার স্থাপত্যশৈলীর প্রায় সব নিদর্শন যেন একসঙ্গে গাঁথা নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁর এই বাড়িটিতে। সময়ের বিবর্তন আর নগর আগ্রাসনে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে যেতে বসেছিল ইতিহাসের এই ঐশ্বর্য। স্বাধীনতার পর সরকার সরদার বাড়িখ্যাত প্রাচীন ইমারতসহ ভূমি অধিগ্রহণ করে। আশির দশকের শেষদিকে প্রতœতত্ত্ব অধিদফতর কর্তৃক আংশিক সংস্কারের পর এটিতে লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর গড়ে তোলা হয়। দীর্ঘ ৩৫ বছরব্যাপী বাংলাদেশে বিনিয়োগের মাধ্যমে এদেশের মানুষের সঙ্গে সাং কিহাকের গভীর আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠার পরিপ্রেক্ষিতে প্রাচীন রাজধানীর স্মৃতিবিজড়িত এই ভবন পরিদর্শনে এসে এর জীর্ণদশা দেখে ফাউন্ডেশন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বড় সরদারবাড়ির প্রকৃত সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনার কথা বলেন। তারই অংশ হিসেবে বিগত ৩ জানুয়ারি ২০১২ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং দক্ষিণ কোরিয়ার ইয়াংওয়ান কর্পোরেশনের মধ্যে বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের বড় সরদারবাড়ির রেস্টোরেশন কাজের ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষর হয়। বড় সরদারবাড়ি রেস্টোরেশন প্রজেক্টের প্রকল্প পরিচালক এশিয়া প্যাসিফিক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের বিভাগীয় প্রধান বিশিষ্ট স্থপতি অধ্যাপক ড. আবু সাঈদ এম আহমেদ পুরনো ভবনের রেস্টোরেশন কাজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, ‘কথিত সরদারবাড়ি ঐতিহাসিক সোনারগাঁর প্রাণকেন্দ্রে নির্মিত মধ্যযুগীয় উল্লেখযোগ্য একটি স্থাপনা। অনুপম স্থাপত্যশৈলীতে অলঙ্কৃত এই প্রাচীন স্থাপনাকে ঘিরে বিভিন্ন সময়ে সংস্কার-সম্প্রসারণ কাজ সংঘটিত হয়। অনিন্দ্যসুন্দর অলঙ্করণশৈলীতে সুশোভিত বহুল আলোচিত ভবনটিতে তিনটি অংশ রয়েছে। ইমারতটির মূল অংশ মধ্যভাগ ঈশা খাঁর সময়ে অথবা প্রাক মুঘল আমলের। এটি প্রায় ৬০০ বছরের পুরনো। দৃষ্টিনন্দন পুরনো এ ইমারতটিতে দুটি আঙ্গিনা রয়েছে। লাল রঙের বর্গাকৃতির এই ভবন দুটি ইমারতের মধ্যস্থলে নির্মিত। এ ইমারতটি প্রাচীন মুঘল আমলের অনুপম স্থাপত্যশৈলীর কথা মনে করিয়ে দেয়। ইমারতটিতে ব্যবহৃত নিদর্শন থেকে জানা যায়, এই অংশ শিল্প-কারখানার কাজে ব্যবহার করা হতো। সরদারবাড়ির বর্তমান প্রধান ফটক একটি আর্কওয়ের ভেতর দিয়ে নির্মিত যা অপেক্ষাকৃত নিচু ও চিন্নিটিকরি (চীনা মাটির সিরামিকের ভাঙা অংশ) দিয়ে সুসজ্জিত করা হয়েছে। এই ইছাপাড়া ভবনের রাজকীয় সামনের অংশ রয়েছে পশ্চিম দিকের শান-বাঁধানো পুকুরের ধারে। এখানে দুটি ঘোড়ার ওপর দু’জন অশ্বারোহী সুসজ্জিত সৈনিক সরদারবাড়ির শান-সৌকতের কালের সাক্ষী হয়ে এখনও দ-ায়মান। মূল্যবান এ স্মৃতি চিহ্নটি বাংলার প্রাচীন রাজধানীর পরিচিতি বহন করছে। বহুল আলোচিত এই ভবনের মোট আয়তন ২৭ হাজার ৪০০ বর্গফুট। রেস্টোরেশন ড্রয়িং অনুযায়ী বড় সরদারবাড়িতে নিচতলায় কক্ষ সংখ্যা ৪৭টি। দ্বিতীয়তলায় কক্ষ সংখ্যা ৩৮টি। সর্বমোট কক্ষ সংখ্যা ৮৫টি। বিভিন্ন উচ্চতার ছাদ ২৩টি। সিঁড়ি সংখ্যা ৬টি, লিফটের সংখ্যা ১টি, খড়খড়ি দরজা আনুমানিক ৪৯টি, খড়খড়ি জানালা (ছোট বড়) আনুমানিক ১৬৮টি, ফিক্সড্ কাঁচের জানালা ১৮টি। সরদার বাড়ির পূর্বদিকে পুকুর আছে। এতে ৩টি শান বাঁধানো ঘাট রয়েছে। পুকুরের পশ্চিমপাড়ের পুরো অংশ ইটের দেয়াল দ্বারা পাড় ভেঙ্গে যাওয়া নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। এ বাড়ির পশ্চিমদিকেও ১টি পুকুর আছে। এতে ৪টি শান বাঁধানো ঘাট আছে। সোনারগাঁ এবং ঈশা খাঁ একে অপরের পরিপূরক। এর কিছুটা ইতিহাস, কিছুটা কিংবদন্তি এবং অবশিষ্টাংশ এখনও ঐতিহাসিকদের কাছে বিস্ময় হয়ে আছে। ১৬শ’ শতাব্দীর শেষভাগে মুঘল সাম্রাজ্যবাদ ও আগ্রাসী ভূমিকার বিরুদ্ধে ঈশা খাঁ যে কৃতিত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন, তা ইতিহাসে তাঁকে চিরস্মরণীয় করে রেখেছে। প্রজাতন্ত্রী দক্ষিণ কোরিয়ার ইয়াংওয়ান কর্পোরেশন কর্তৃক বড় সরদারবাড়ির রেস্টোরেশন কাজ সমাপ্তির পর এটি একটি ঐতিহাসিক স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন হিসেবে প্রতিভাত হবে। বাংলার প্রাচীন রাজধানীর স্পর্শাতীত কালচারাল হেরিটেজের মায়াবি আকর্ষণে অনুসন্ধিৎসু দেশী-বিদেশী পর্যটক এই ভবনটিতে একই সঙ্গে এদেশে বিদ্যমান প্রাক ইসলামী, মুঘল স্থাপত্য অলঙ্করণশৈলী, বার ভূঁইয়ার স্থাপত্য অলঙ্করণশৈলী, ব্রিটিশ কলোনিয়াল স্থাপত্যশৈলী এবং হিন্দু স্থাপত্যশৈলীর সংমিশ্রণে নির্মিত মনোলোভা স্থাপত্য নিদর্শনের জৌলুস পুনরায় অবলোকন করতে পারবেন। বাংলার প্রাচীন রাজধানীর ঐতিহ্যিক স্থাপত্যশৈলী পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে এর ভৌত অবকাঠামো ফিরিয়ে আনার পর রাজকীয় জীবনধারাকে মানসপটে উপস্থাপিত করা। ইতিহাসের এই অমূল্য সম্পদের চেহারা ফিরিয়ে দিতে কাজ করছে কোরিয়াভিত্তিক বহুজাতিক কোম্পানি ইয়াংওয়ান কর্পোরেশন। কিছুদিনের মধ্যেই আপনরূপে দেশবাসীর কাছে উন্মোচিত হবে বড় সরদারবাড়ির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট। এর মাধ্যমে আমাদের অতীত ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে নতুন প্রজন্মের মেলবন্ধন সৃষ্টি হবে। একই সঙ্গে প্রাচুর্যময় আভিজাত্য ও সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ পীঠস্থানকে দেশী-বিদেশী পর্যটকদের কাছে উপস্থাপনের দ্বার উন্মুক্ত হবে। লেখক : গবেষক
×