ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

থাই বন্দী শিবিরে রোহিঙ্গা নারীরা গণধর্ষণের শিকার

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ৪ জুন ২০১৫

থাই বন্দী শিবিরে রোহিঙ্গা নারীরা গণধর্ষণের শিকার

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ বঙ্গোপসাগর-আন্দামান সাগর রুটে মালয়েশিয়ায় অবৈধ অভিবাসী প্রত্যাশী হওয়ার প্রচেষ্টা চালিয়ে মিয়ানমারের যেসব রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশুদের থাইল্যান্ডের বন্দী শিবিরে নিয়ে আটকে রাখা হয়, এদের মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছে রোহিঙ্গা নারীরা। বুধবার আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সূত্রে এ খবর দিয়ে বলা হয়েছে, ধর্ষিত নারীদের সকলেই মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের। মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বারনামা বলেছে, ধর্ষিতাদের মধ্যে অন্তত দু’জন অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েছে বলে তারা নিশ্চিত হয়েছেন। এদিকে, মানবপাচারের ঘটনা নিয়ে থাই পুলিশ সে দেশের সেনা সদস্যদের বিরুদ্ধেও মানব বেচাকেনা ও পাচারের কাজে জড়িত হওয়ার যে অভিযোগ এনেছিল তা শেষ পর্যন্ত সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। থাই আদালতের পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত যাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে তাদের মধ্যে ইতোমধ্যে ৫১ জনকে গ্রেফতার করার পর বুধবার অভিযুক্ত শীর্ষ এক সেনা কর্মকর্তা নিজেই আত্মসমর্পণ করার পর তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তার নাম লে. জেনারেল মানাস কংপান, যিনি থাই জান্তা সরকারের একজন শীর্ষ সেনা সামরিক উপদেষ্টা পদে অধিষ্ঠিত। এর আগে তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ওঠার পর সে দেশের সেনাবাহিনীর ৪২তম সেনা সার্কেলের ঐ কমান্ডারকে বরখাস্ত করা হয়। এছাড়া সে দেশে পুলিশ কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদ মিলে ৮৪ মানবপাচারকারীকে চিহ্নিত করা হয়েছে। অপরদিকে, থাইল্যান্ডে দ্বিতীয় দফায় যে ৭২৭ জন অভিবাসীকে সে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মালয়েশিয়া সীমান্ত এলাকার কাছাকাছি থেকে উদ্ধার করা হয় তাদের বুধবার টেকনাফের নাফ নদীর ওপারে মংডু শহরে নিয়ে আসা হয়েছে। দুটি ট্রলারে করে এদের অপর দুটি সেনা সদস্যবাহী ট্রলারের পাহারা দিয়ে নিয়ে আসা হয়। নাফ নদীতে এ সময় টহলরত বাংলাদেশের কোস্টগার্ড ও বিজিবি সদস্যরা সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় ছিলেন। উদ্ধারকৃত এসব অভিবাসীকে কোনভাবেই যাতে বাংলাদেশ সীমানায় পুশব্যাক করতে না পারে সে ব্যাপারে এ সতর্কতা গ্রহণ করা হয় বলে জানিয়েছেন বিজিবির ১৭ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল খন্দকার সাইফুল আলম। কক্সবাজারে অভিযান চালিয়ে আরও ৪ মানবপাচারকারীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা বৈষম্য বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। এছাড়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অভিবাসী সঙ্কটের মূল সমস্যার সমাধান মিয়ানমারের সংখ্যালঘু মুসলিম রোহিঙ্গাদের নিজেদের নাগরিক হিসেবে বিবেচনায় আনা দরকার বলে মন্তব্য করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ্যান রিচার্ড। অপরদিকে সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, অস্ট্রেলীয় সরকার সে দেশের জলসীমা থেকে ৬৫ অভিবাসীবোঝাই একটি নৌকাকে সরিয়ে দিয়েছে। এদের মধ্যে ১০ জন বাংলাদেশী। থাইল্যান্ডে শীর্ষ সেনা কর্মকর্তা গ্রেফতার ॥ থাইল্যান্ডের সাধারণ মানুষের পাশাপাশি পুলিশ ও সেনা সদস্যদের বিরুদ্ধে মানবপাচারের অভিযোগ ওঠার পর সে দেশের তদন্তে অভিযুক্ত হয়েছেন থাই সেনাবাহিনীর শীর্ষস্থানীয় উপদেষ্টা লে. জেনারেল মানাস কংপান। তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হওয়ার পর বুধবার তিনি নিজে সেনা দফতরে দিয়ে আত্মসমর্পণ করার পর তাকে গ্রেফতার করা হয়। তার বিরুদ্ধে মানবপাচার ছাড়াও মুক্তিপণ আদায় ও অভিবাসী প্রত্যাশীদের বন্দীশালায় আটকে রাখার অভিযোগ রয়েছে। এর আগে এ সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে থাই আদালত থেকে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। সে দেশের পুলিশ বলেছে, এ সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মানবপাচারের যথেষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণ রয়েছে। থাই পুলিশ প্রধান সমট পোমপান মং বলেছেন, গ্রেফতারকৃত ঐ সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রমাণাদি থাকায় তার পালানোর কোন পথ নেই। তিনি এ ব্যাপারে অতিরিক্ত কোন তথ্য না দিয়ে বলেন, থাইল্যান্ডের মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় বহু বছর ধরে মানবপাচারের ঘটনার নেপথ্যে শ’ শ’ মিলিয়ন ডলারের সন্ত্রাসী তৎপরতার নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সূত্রে বলা হয়েছে, গ্রেফতারকৃত লে. জেনারেল মানাসের বয়স ৫৮ বছর। ২০১৩ সালে এ সেনা কর্মকর্তা চাম্পন প্রদেশের সেনা কমান্ডারের দায়িত্বে ছিলেন। চলতি বছর তাকে ব্যাঙ্ককের রয়েল থাই সেনা সদর দফতরে শীর্ষস্থানীয় উপদেষ্টা পদে নিয়োগ দেয়া হয়। থাই সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সেনাবাহিনী মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত কারও পক্ষ নেবে না। সেনা সূত্রে আরও বলা হয়েছে, গ্রেফতারকৃত মানাস নিজের পক্ষে দাঁড়ানোর সুযোগ রয়েছে। উল্লেখ্য, থাই পুলিশ ইতোমধ্যে মানবপাচারে জড়িত ৫১ জনকে গ্রেফতার করেছে, যার মধ্যে স্থানীয় শীর্ষ পদের কর্মকর্তারা রয়েছেন। ৩৩ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা রয়েছে। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা থেকে বলা হয়েছে, থাইল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলে যে গণকবর ও বন্দী শিবির আবিষ্কৃত হয়েছে এর নেপথ্যে ছিল অবৈধ অভিবাসীদের সেখানে আটকে রেখে কমপক্ষে দুই হাজার ডলার করে মুক্তিপণ আদায় করা। আর তা না হলে তাদের মালয়েশিয়ার বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের কৃষি ফার্মে বিক্রি করে দেয়া। বঙ্গোপসাগর দিয়ে থাইল্যান্ড হয়ে মালয়েশিয়ায় মানবপাচারের ঘটনা সর্বপ্রথম সে দেশের পুলিশী তদন্তে উদ্ঘাটিত হয়। শংখলা প্রদেশে গত ১ মে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর যৌথ অভিযানে বেরিয়ে আসে বন্দীশালা ও গণকবর। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার মতে, এখনও আড়াই সহস্রাধিক অবৈধ অভিবাসী প্রত্যাশী এখনও সাগরে ভাসছে। গণধর্ষিত রোহিঙ্গা নারীরা ॥ থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় গণকবর ও বন্দী শিবিরের রোমহর্ষক ঘটনা বেরিয়ে আসার পর এখন বেরিয়ে এসেছে এ দু’দেশের পাচারকারীদের বন্দীশালায় রোহিঙ্গা নারীরা গণধর্ষণের শিকার হয়েছে। এরা সবাই ছিল মালয়েশিয়ায় অবৈধ অভিবাসী প্রত্যাশী। মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে বছরের পর বছর নিপীড়ন-নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে এরা সাগরপথে স্বজনদের সঙ্গে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমানোর পথে সে দেশের ও থাইল্যান্ডের উপকূলবর্তী এলাকার জঙ্গলে বন্দী শিবিরে আটক রাখা হয়েছিল এবং সেখানে দিনের পর দিন তারা গণধর্ষণের শিকার হয়েছে। মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বারনামা জানিয়েছে, ধর্ষিত নারীদের মধ্যে ইতোমধ্যে দু’জন অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার খবর নিশ্চিত হওয়া গেছে। গত বছর থেকে থাইল্যন্ডের পেডাং পেসারের ক্যাম্পে আটক ছিল নুর খাইদা আবদুল শুকুর নামের এক রোহিঙ্গা নারী। তিনি গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে জানিয়েছেন, পেডাং পেসারের ক্যাম্পে আটক যুবতী নারীদের রাত হলেই অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হতো। নুর খাইদাও ঐ ক্যাম্পে আটক ছিলেন গেল এক বছর ধরে। পাচারকারীদের নিরাপত্তা প্রহরীরা তাদের অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়ার পর দলবেঁধে ধর্ষণ করত। নুর খাইদার স্বামী সে বন্দীশালায় আটক থাকা অভিবাসীদের একজন। তার নাম নুরুল আমিন নবী হোসেইন। তিনি জানিয়েছেন, মালয়েশিয়ায় পাচারকারীদের বন্দীশালাতেও তিনি একই অপরাধ সংঘটিত হতে দেখেছেন।
×