ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

চলে গেলেন সত্যজিৎ পত্নী বিজয়া রায়

প্রকাশিত: ০৪:১৫, ৪ জুন ২০১৫

চলে গেলেন সত্যজিৎ পত্নী বিজয়া রায়

সংস্কৃতি ডেস্ক ॥ বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের পত্নী বিশিষ্ট অভিনেত্রী ও সঙ্গীতশিল্পী বিজয়া রায় আর নেই। কলকাতার বেলভিউ নার্সিং হোমে মঙ্গলবার স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৬টায় মারা যান তিনি। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯৮ বছর। ভারতীয় এক গণমাধ্যম জানায়, ফুসফুসে প্রবল সংক্রমণ নিয়ে গত শনিবার তিনি বেলভিউ নার্সিংহোমে ভর্তি হয়েছিলেন। পারিবারিক চিকিৎসক স্বপন পালের অধীনেই তাঁর চিকিৎসা চলছিল। এর আগে গত সপ্তাহের মাঝামাঝি তাঁর জ্বর আসে, দিন-দু’য়েকের মধ্যেই শ্বাসকষ্ট শুরু হওয়ায় ডাক্তার তাঁকে হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দেন। তাঁর কিডনি ও শ্বাসনালীতে সংক্রমণ ছিল বলেও জানা গেছে। সেখানে চার দিন থাকার পর মঙ্গলবার মারা যান তিনি। গত চার বছর ধরে মুম্বাইয়ের বিশপ লেফ্রয় রোডের বাড়িতেই বার্ধক্যজনিত নানা অসুস্থতায় ভুগছিলেন বিজয়া রায়। তাঁর মৃত্যুর খবর পেয়েই বেলভিউ যান পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সোস্যাল মিডিয়ায় তিনি শোকপ্রকাশ করে সন্দ্বীপ রায় ও তাঁর পরিবারের প্রতি সমবেদনাও জানিয়েছেন। বিজয়া রায় সত্যজিতের ঘরণী হওয়ার আগে তিনি ছিলেন বিজয়া দাশ। ১৯১৭ সালে পাটনায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। পাটনার ব্যারিস্টার চারুচন্দ্র দাশ ও মাধুরী দেবীর কন্যা বিজয়া দাশ। মা মাধুরী দেবী ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের স্ত্রীর ছোট বোন। ১৯৩১ সালে তার বাবার মৃত্যুর পর কলকাতায় কাকা প্রশান্ত দাসের বাড়িতে চলে যান। সেখানে একান্নবর্তী পরিবারে মানুষ হন তিনি। এরপর নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ম্যাট্রিক এবং আশুতোষ কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট ও ইংরেজীতে স্নাতক পাস করেন। পরের দিকে কমলা গার্লস স্কুল এবং বেথুন স্কুলে শিক্ষকতার কাজ করেছেন। ১৯৪৮ সালে মুম্বাইয়ে সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে তার রেজিস্ট্রি বিয়ে হয়। তারপর ১৯৪৯ সালে আনুষ্ঠানিক ব্রাহ্ম বিয়ে মা সুপ্রভা রায়ের উপস্থিতিতে বিয়ে হয় কলকাতায়। সত্যজিৎ ছিলেন তার পিসতুতো ভাই। মাদার তেরেসার সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে তিনি কিছুদিন কাজ করেছেন। বাংলা চলচ্চিত্রে সত্যজিৎ রায়ের যে অবদান তার পেছনে বিজয়া রায়ের ভূমিকা অনেক। কারণ বিজয়া রায় একজন অভিনেত্রী এবং রবীন্দ্রসঙ্গীতশিল্পী ছিলেন বলে সত্যজিতের চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে যথেষ্ট এবং অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন তিনি। তবে নিজেকে কখনই প্রচারের আলোয় আনেননি বিজয়া রায়। সত্যজিৎ রায়ের বেশিরভাগ ছবির লোকেশন দেখা ও পোশাক ডিজাইনসহ নেপথ্যের অনেক কাজে জড়িয়েছিলেন তিনি। রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী বিজয়া মুম্বাইয়ের ‘রজনী’ ও ‘মশাল’ নামে দু’টি চলচ্চিত্রে অভিনয়ও করেছেন। সত্যজিতের বেশিরভাগ চলচ্চিত্রের লোকেশন দেখা থেকে কস্টিউম ডিজাইনিং করেছেন। বিশেষ করে ‘পথের পাঁচালী’র বালক অপুকে খুঁজে বের করা কিংবা প্রথম স্ক্রিন টেস্টের জন্য ‘অপর্ণা’ শর্মিলা ঠাকুরকে সাজিয়ে দেয়া সবই করেছেন তিনি। এমনকি সত্যজিতের ঘরে ফিল্ম বা সন্দেশ পত্রিকার আড্ডা হতো বিজয়া রায়ের প্রচ্ছন্ন গৃহিণীপনার কারণে। স্বামীর সঙ্গে কাটানো দিনগুলো নিয়ে ‘আমাদের কথা’ নামে একটি আত্মজীবনী লিখেছেন তিনি। বিজয়া রায় শুধু প্রতিভাবান স্বামীর নান্দনিক এবং ঐতিহাসিক সৃষ্টির সহযোগীই ছিলেন না, এক সময় নিজগুণেই খ্যাত ছিলেন। রবীন্দ্রসঙ্গীতের পাশাপাশি, জ্যাঠামশাই অতুলপ্রসাদ সেন থেকে হিমাংশু দত্তের গান রেকর্ড করেছেন। আত্মজীবনীতে লিখছেন, ‘একটা গানও আমার কাছে নেই, ইচ্ছা করেই রাখিনি। গান গেয়ে এবং শুনে এত খারাপ লেগেছিল যে রাখার কোনও তাগিদ অনুভব করিনি’। পিসিমা সাহানা দেবীর কাছে ছোট থেকে গান শিখেছিলেন বিজয়া। নিজেকে লুকিয়ে রাখার সাধনা ছিল তাঁর। চলচ্চিত্র, রেডিও পাশ্চাত্য সঙ্গীত এবং আরও অনেক কিছুর কারণে সত্যজিতের সঙ্গে এক হয়েছিলেন। ১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল সত্যজিৎ রায়ের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চলচ্চিত্র নির্মাতা স্বামীকে অনুপ্রেরণা দিয়ে গেছেন বিজয়া। তাকেই প্রথম চলচ্চিত্রের স্ক্রিপ্ট পড়ে শোনাতেন অস্কারজয়ী সত্যজিৎ। স্ত্রীর পরামর্শে তাতে পরিবর্তনও আনতেন। তাদের একমাত্র সন্তান খ্যাতনামা চিত্রপরিচালক সন্দীপ রায়। স্বামীর মৃত্যুর পর বড় একা হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। সঙ্গী ছিল স্বামীর স্মৃতি আর পৌত্র সৌরদীপ এবং পুত্র সন্দীপ ও পুত্রবধূ ললিতা। শুধু তাই নয়, সম্ভবত বিজয়া রায়ই স্বাধীনতার পরে প্রথম বাঙালী কন্যা যিনি ১৯৪৯ সালে কাজিন প্রেমিককে বিয়ে করছেন, দু’ জনকেই এই কৌতূহলী বাঙালী সমাজে সেই ঘটনা চেপে রাখতে হচ্ছে। ‘রিভার’ চলচ্চিত্রের সময়েও জঁ রেনোয়া সত্যজিৎ রায়কে তাঁর ছবি উপহার দিয়ে লিখছেন, ‘মানিক রায়কে, যাকে বিবাহিত দেখলে খুশি হব।’ সামাজিক ও পারিবারিক প্রতিকূলতার চাপে মানিক রায় ও তাঁর স্ত্রীকে যে কিভাবে প্রথম কয়েক মাস নিজেদের রেজিস্ট্রির কথা চেপে রাখতে হয়েছিল, রেনোয়া জানতেন না। বিয়ের পর শাশুড়ি সুপ্রভা রায়কে বিজয়া জিজ্ঞেস করেছিলেন, এ বার থেকে তোমাকে কী বলব? শাশুড়ি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘এতদিন মাসিমা বলতে, এ বার শুধু মা বোলো।’ বিজয়া রায় আজ অবধি সুকুমার ও সুপ্রভা রায়ের পুত্রবধূ, সত্যজিৎ রায়ের পতœী, সন্দীপ রায়ের মা। বাঙালী সমাজে এগুলোই তাঁর পরিচিতি। বিজয়াও তা মেনে নিয়েছিলেন। নইলে আত্মজীবনীর নাম ‘আমাদের কথা’ রাখবেন কেন? তাঁর ‘আত্ম’ সবসময় অপরের আলোয় উদ্ভাসিত, একক ‘আমি’র বদলে স্বামী-পুত্র-পরিবার নিয়ে ‘আমাদের’ বহুবচনই সেখানে প্রধান।
×