ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

রানী পাতাকুড়ানি

প্রকাশিত: ০৩:৪৮, ৪ জুন ২০১৫

রানী পাতাকুড়ানি

মাস দুয়েক হলো ওয়াসার শ্রমিকরা সারা ধানম-ি খোঁড়াখুঁড়ি করে ল-ভ- করেছেন। স্যুয়ারেজ লাইন সংস্কার কাজ চলছে। শত শত বিশাল মোটা মোটা পাইপ মাটির তলায় ঢোকানো হচ্ছে। প্রতিদিন এই প্রতœতাত্ত্বিক খননকণ্টকিত ভূমিরূপ দেখতে দেখতে আমাকে কর্মস্থলে যাওয়া-আসা করতে হয়। ধানম-ি ছয় নম্বর রোডটা এখনও কাটা হয়নি। ভূতের গলির প্রচ- এবড়ো-খেবড়ো রাস্তায় ভূতের ঠেলা ধাক্কা খেতে খেতে এই ছয় নম্বরে আসার পর একটু ঘাড় সোজা করে দম নিয়ে বসি। দু’তিন মিনিট একটু আরামে যাওয়া যাবে। কিন্তু ঘাড় সোজা করতে গিয়ে মাথায় ঠোক্কর খেতে হলো। ঢাকা শহরের রিক্সাগুলোর হুড দিনেদিনেই ছোট হয়ে প্রায় মাথার টোপর সমান হয়ে যাচ্ছে। হুড ওঠানো রিকশায় তাই মেরুদ- সোজা করে বসার উপায় নেই। রিকশার নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়ে যাচ্ছে আর টান পড়ছে রিক্সার ঘোমটায়। অবশ্য এতে রিক্সাচালকদের সঙ্গে প্যাসেঞ্জারের শ্রেণীবৈষম্যটা কমে আসছে। প্যাডেল মারতে মারতে চালকের শিরদাঁড়া যাবে বেঁকে আর প্যাসেঞ্জার নবাবী স্টাইলে ঠ্যাঙের ওপর ঠ্যাঙ তুলে বসে থাকবে! সেটি হচ্ছে না। থাক তেড়ুয়া ঘাড় বেঁকিয়ে বসে!আমি ঘাড় সোজা করার জন্য রিক্সার হুডটা খুলতে চেষ্টা করি। পারি না। রিক্সাওয়ালাকে বললে তাকে আবার রিক্সা থামাতে হবে। ঝামেলা মনে করে হুডের ভেতরেই ঘাড় গোঁজ করে নতমস্তকে বসে থাকি। ঠিক সে সময়ে আমার চোখে পড়ে দৃশ্যটি। দৃশ্যটি যেন বিদ্রোহী কবিতার সেই লাইন- ‘বল বীর বল উন্নত মম শির, শির নেহারি আমারই, নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির...’। আমি দেখতে পাই, সামনের দিক থেকে একটি রিক্সা আসছে। সেই রিক্সার অনেক উঁচুতে বসে আছেন এক নারী। নারীর বয়স সত্তরের কাছাকাছি। মাথাভরা সাদা চুল। উস্কুখুস্কু। কতকাল সে চুলে তেল-চিরুনি পড়েনি তা বোধ হয় সেই নারী নিজেও জানেন না। তেল-চিরুনি ব্যাপারটা খুব জরুরী বলে হয়ত তাঁর কাছে মনেও হয় না। রিক্সায় আসীন ঐ নারীর ইমেজ একেবারে আকাশের প্রেক্ষাপটে। কারণ রিক্সায় রাখা হয়েছে বড় বড় চার-পাঁচটি বস্তা আর শুকনো ডালপালার আঁটি। বস্তার সারফেস দেখে মনে হচ্ছে ভেতরে আছে কুড়োনো কাগজ বা শুকনো পাতা। পাতাকুড়ানি বয়সিনী নারী বসে আছেন বস্তাগুলোর চূড়ায়। এ যেন তাঁর পর্ণসিংহাসন। তাঁর মাথায় কোন অবগুণ্ঠন নেই। তাঁর বসার ভঙ্গি রাজসিক। এক পায়ের ওপর আর এক পা তুলে দিয়ে মেরুদ- সোজা করে রানীর মতো উদ্ধত দর্পিত ভঙ্গিমায় বসেছেন তিনি। তাঁর উন্নতশির। হিমাদ্রি শিখরের মতোই তাঁর মুক্ত মাথার ওপরে ঝকঝকে রৌদ্রময় আকাশ। পদতলে গুচ্ছকৃত তাঁর অর্জিত ধন, তাঁর কুড়ানো পাতা। তাঁকে আর পাতাকুড়ানি মনে হয় না। মনে হয় রানী। তাঁর মাথা উঁচু। সরল স্বাচ্ছন্দ্য তাঁর দৃষ্টি। সে দৃষ্টি নিবদ্ধ সামনে, দূরে কোথাও। হুডের ঘেরাটোপে আটকে থাকাতে আমি বসে আছি নতশির। তাই বেশিক্ষণ এই উন্নতশির পাতাকুড়ানি রানীর জেলা দেখতে পারি না। আমাদের দু’জনের রিক্সা বিপরীত দিকে ক্রস করে যায়। পরীবাগ, ঢাকা থেকে
×