ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

চুক্তির মেয়াদ বাড়ছে, পণ্য পরিবহন সুযোগ পাবে তৃতীয় কোন দেশও

বাংলাদেশের সংশোধিত নৌ ট্রানজিট প্রটোকলে ভারতের সম্মতি

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ১ জুন ২০১৫

বাংলাদেশের সংশোধিত নৌ ট্রানজিট প্রটোকলে ভারতের সম্মতি

তৌহিদুর রহমান ॥ নৌ ট্রানজিট প্রটোকলে বাংলাদেশের সংশোধিত প্রস্তাবে সম্মতি দিয়েছে ভারত। বাংলাদেশের প্রস্তাব অনুযায়ী নৌ ট্রানজিটের আওতায় তৃতীয় দেশের পণ্য চলাচলে এখন কোন বাধা থাকছে না। এছাড়া উপকূলীয় জাহাজ চলাচল চুক্তির আওতায় দুই দেশের মধ্যে যাত্রীবাহী জাহাজ চলাচল করতে পারবে। আর ঢাকা সফরের মধ্যে দিয়ে নতুন অধ্যায় শুরু করতে চলেছেন বলে জানিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের একদিন আগে আসছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে নৌ যোগাযোগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে দুই দেশের মধ্যে নৌ প্রটোকল চুক্তি রয়েছে। তবে এই চুক্তির মেয়াদ এবার বাড়ানো হচ্ছে। আগে এই চুক্তির মেয়াদ ছিল তিন বছর। এখন এই চুক্তির মেয়াদ হবে পাঁচ বছর। দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান ‘প্রটোকল অন ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রানজিট এ্যান্ড ট্রেড’ শিরোনামে এই নৌ প্রটোকল রয়েছে। ১৯৭২ সালে ভারত বাংলাদেশের মধ্যে নৌ-প্রটোকল সই হয়। এর পর বিভিন্ন সময়ে এই চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। তবে এবারের চুক্তিতে নতুন সংশোধনী আনা হয়। এতে বলা হয়, বাংলাদেশ বা ভারত নৌপথ ব্যবহার করে তৃতীয় কোন দেশে পণ্য পরিবহনের সুযোগ পাবে। প্রটোকলটি আগে দ্বিপাক্ষিক ছিল। এখন তৃতীয় পক্ষ সংযুক্ত করা হয়েছে। তৃতীয় পক্ষ হিসেবে নেপাল ও ভুটানকে টার্গেট রাখা হয়েছে, যেন দুই পক্ষেরই (বাংলাদেশ-ভারত) সুবিধা হয়। দুই পক্ষ আলাপ-আলোচনা করে সমস্যা চিহ্নিত ও সমাধান করবে। নৌ প্রটোকল চুক্তির সংশোধিত খসড়া মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পরে ভারতের নিকট পাঠানো হয়। তবে সংশোধিত খসড়ায় দু’টি বিষয়ে আপত্তি তুলেছিল ভারত। সে কারণে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের আগে সংশোধিত এই চুক্তি নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছিল। অবশেষে শনিবার ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের প্রস্তাবিত সংশোধনীতেই সম্মতি দেয়া হয়। বাংলাদেশের সংশোধিত প্রস্তাবে যে দুটি বিষয়ে ভারত আপত্তি তোলে, তার মধ্যে একটি হলো নৌ পথে ট্রানজিটের আওতায় তৃতীয় দেশে পণ্য চলাচল সুবিধা। অপরটি অপারেশনাল মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে রক্ষণাবেক্ষণ চার্জ বাড়ানোর বিধান বাতিল। তবে ভারতের এই আপত্তি তোলার পরে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ কিছুটা বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে। কেননা বাংলাদেশের সংশোধনী প্রস্তাব বাতিল হলে পুনরায় এটি মন্ত্রিসভায় নতুন করে পাস করাতে হতো। আর মোদির সফর সামনে রেখে পুনরায় সংশোধনের জন্য সময় ছিল খুবই কম। ভারতের সম্মতির পরে এখন এই চুক্তিতে আর কোন বাধা নেই। এদিকে নৌ প্রটোকলের আওতায় বাংলাদেশ ও ভারতের উপকূল দিয়ে জাহাজ চলাচল নিয়ে আরও একটি চুক্তির প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। এ চুক্তির মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে উপকূল দিয়ে পণ্যবাহী জাহাজ চলাচল করতে পারবে। ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে এই চুক্তির নাম ‘কোস্টাল শিপিং এগ্রিমেন্ট’। এ ব্যবস্থার ফলে দুই দেশের মধ্যে পণ্যবাহী জাহাজ চলাচল করবে। এতে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বৃদ্ধিসহ দুই দেশের সড়কপথের ওপর চাপ অনেকটা কমবে। সাশ্রয়ী মূল্যে ও স্বল্প সময়ে দুই দেশের মধ্যে পণ্য পরিবহন সম্ভব হবে। তাছাড়া দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কোন্নয়নে এটি বিশেষ ভূমিকা রাখবে। দুই দেশের মধ্যে ইতিমধ্যেই প্রাথমিক সমঝোতা হয়েছে। বর্তমানে নৌ প্রটোকলের আওতায় তিনটি রুটে দুই দেশের মধ্যে দুই শতাধিক পণ্যবাহী নৌযান চলাচল করছে। এর মধ্যে প্রথম রুটটি হচ্ছে : কলকাতা-হলদিয়া-রায়মঙ্গল-চালনা-খুলনা-মংলা-কাউখালী-বরিশাল-হিজলা-চাঁদপুর-নারায়ণগঞ্জ-আরিচা-সিরাজগঞ্জ-বাহাদুরাবাদ-চিলমারী-ধুবড়া-পা-ু-শীলঘাট। দ্বিতীয় রুট হচ্ছে : কলকাতা-হলদিয়া-রায়মঙ্গল-চালনা-খুলনা-মংলা-কাউখালী-বরিশাল-হিজলা-চাঁদপুর-নারায়ণগঞ্জ-ভৈরব-আশুগঞ্জ- আজমীরিগঞ্জ-মারকুলি-শেরপুর-ফেঞ্চুগঞ্জ-জকিগঞ্জ-করিমগঞ্জ। তৃতীয় রুট হলো: ধুলিয়ান-গোদাগাড়ী-রাজশাহী-করিমগঞ্জ-জকিগঞ্জ-ফেঞ্চুগঞ্জ-শেরপুর-মারকুলি-আজমীরিগঞ্জ-আশুগঞ্জ-ভৈরব-নারায়ণগঞ্জ-চাঁদপুর-আরিচা-সিরাজগঞ্জ-বাহাদুরাবাদ-চিলমারি-ডুবরি-পা-ু-শীলঘাট। চুক্তি সইয়ের পর ভারতের কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ ও আসামের সঙ্গে বাংলাদেশের কয়েকটি নদীবন্দরের সরাসরি যাত্রী ও পর্যটক চলাচলের সুযোগ হবে। তবে এক্ষেত্রে নদীগুলোর নাব্যতা বৃদ্ধি করতে হবে। কলকাতার হলদিয়া থেকে নারায়ণগঞ্জ বন্দর আসতে মালবাহী জাহাজ আসবে ৮-১০ দিনে। বর্তমানে ভারত থেকে সমুদ্রপথে পণ্য আনতে হলে মুম্বাই বা বিশাখাপত্তম বন্দর থেকে শ্রীলংকা বা সিঙ্গাপুরে যায়। সেখান থেকে বাংলাদেশের জাহাজে করে চট্টগ্রামে আসে। এতে একটি পণ্যবাহী কার্গো চট্টগ্রামে আসতে ২৫-৩০ দিন সময় লাগে। আর এক টন পণ্যের ভাড়া দিতে হয় প্রায় ১১০ ডলার। উপকূলীয় জাহাজ চলাচল শুরু হলে অন্ধ প্রদেশের কাকিনাদা বা বিশাখাপত্তম থেকে পণ্যবাহী জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দর বা মংলা বন্দরে আসতে সময় লাগবে মাত্র তিনদিন। খরচ হবে টন প্রতি ৩০-৩৫ ডলারের মতো। জাহাজ চলাচল চুক্তি হলে খরচ কমবে প্রায় ৩৩ শতাংশ। কোস্টাল শিপিং এগ্রিমেন্ট সইয়ের জন্য ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় শনিবার অনুমোদন দেয়া হয়েছে। ঢাকায় নতুন অধ্যায় শুরুই মোদির লক্ষ্য ॥ ঢাকা সফরের মধ্যে দিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নতুন অধ্যায় অধ্যায় শুরু করতে চলেছেন বলে মনে করছেন। তিনি কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকাকে বলেছেন, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে মধুর সম্পর্ক দক্ষিণ পূর্ব-এশিয়ার এই বিস্তৃীর্ণ অঞ্চলে শান্তি এবং স্থায়িত্ব নিয়ে আসবে’। তিনি আরও বলেন, সমস্ত রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কথা বলে সংসদের অনুমোদন নিয়েই বাংলাদেশের সঙ্গে স্থলসীমান্ত চুক্তিটি করতে চলেছে ভারত। ১৯৭৪ সালে দেশ ভাগের পর থেকে এই সীমান্ত নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছিল। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ গঠনের পরেও সেই বিতর্ক বহাল রয়ে গিয়েছে। আমরা এই বিতর্কের অবসান ঘটানোর চেষ্টা করছি এবং সেটা সর্বসম্মতির ভিত্তিতে। এটা আদৌ সামান্য ঘটনা নয়’। শনিবার কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় বাংলাদেশ সফর নিয়ে মোদি আরও বলেন, আয়তনে বাংলাদেশ ছোট হলেও আমাদের কাছে তার ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব অনেক। শেখ হাসিনার সরকার বেশ কয়েক বছর ধরেই যে সন্ত্রাস দমনে অত্যন্ত ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে, তা মন্ত্রিসভার বৈঠকে উল্লেখ করেন মোদি। আর এই পরিস্থিতিতে তিনি মনে করেন, উন্নয়নই দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক মজবুত করার কাজে সব চেয়ে বড় হাতিয়ার হতে পারে। দু’দেশের মধ্যে যোগাযোগ যত বাড়বে, পারস্পারিক আস্থাও তত বাড়বে। সেই উন্নয়নের ধারা বজায় রখতেই একগুচ্ছ পদক্ষেপ নেবে দিল্লী।
×