ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ড. আরএম দেবনাথ

২০১৫-১৬ অর্থবছরের আয়কর সম্পর্কে কিছু সুপারিশ

প্রকাশিত: ০৬:৩৪, ২৯ মে ২০১৫

২০১৫-১৬ অর্থবছরের আয়কর সম্পর্কে কিছু সুপারিশ

২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেট উত্থাপিত হবে আর কয়েকদিন পরই। আমার ধারণা, অর্থমন্ত্রীর প্রস্তুতিকাজ শেষ। অনেকদিন ধরেই তিনি নানা পদের লোকের সঙ্গে বাজেট সম্পর্কে মতবিনিময় করেছেন। এ প্রেক্ষাপটে হয়ত তিনি তার মনস্থির করে ফেলেছেন। অতএব শেষ মুহূর্তে তাঁকে সুপারিশ ধরিয়ে দিয়ে কোন লাভ হবে বলে মনে হয় না। তবু ‘চিত্তসুখ’ বলে একটা কথা আছে। এ কারণেই কিছু কথা তাঁকে বলতে চাই। বলতে চাই ‘আয়কর’ (ইনকাম ট্যাক্স) সম্পর্কে। এটা জানা কথা, যারা আয়কর দেন তাদের প্রতিবছর প্রস্তুতি নিতে হয়। পরিকল্পনা করে আয়কর গোছানোর কোন ব্যবস্থা বর্তমান অবস্থায় নেই। কারণ অর্থমন্ত্রীরা প্রতিবছর বাজেট দেন জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে। ঐ বাজেটে আয়করের ক্ষেত্রে কিছু সুযোগ-সুবিধা থাকে, আবার কখনও কিছু থাকে না, আবার অনেক সময় আয়করে অনেক সুযোগ-সুবিধা প্রত্যাহারও করা হয়। এমন সময়ে করদাতারা এসব বিষয়ে অবহিত হন যখন তাদের কিছুই করার থাকে না। কারণ সমস্ত হিসাব শেষ করতে হয় ৩০ জুন তারিখে। উদাহণস্বরূপ ধরা যাক, বিনিয়োগের সীমা বাড়ানো হলো। এতে একজন করদাতা বেশি ‘সঞ্চয়পত্র’ ক্রয় করতে পারেন কর রেয়াত পাওয়ার জন্য। কিন্তু যেহেতু ঘোষণাটা এলো জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে এবং কাজটা শেষ করতে হবে জুনের মধ্যে, কাজেই তখন অনেকে ‘বিনিয়োগের’ সুবিধা ধরতে পারেন না। এটা একটা মাত্র উদাহরণ। এমন অনেক হিসাবপত্র আছে যা আগেভাগে জানলে করদাতারা সারাবছর পরিকল্পনামাফিক কাজ করতে পারেন। এক কথায় তারা আয়কর পরিকল্পনা করতে পারেন। বর্তমানে করের বিষয়টা বার্ষিক কর্মকা- হওয়ায় কোন করদাতার পক্ষেই পরিকল্পনা করে কাজ করা সম্ভব নয়। কারণ তারা জানেন না অর্থমন্ত্রীর ‘কালো বাক্সে’ আয়কর সম্পর্কে কী আছে। এমতাবস্থায় আমার একটা প্রস্তাবÑ আয়করের বিধিবিধান যাই থাকুক তা অন্তত তিন বছরের জন্য কার্যকর রাখা হোক। এতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডও জানবে এই আছে, করদাতারাও বুঝবে এই আছে এবং তা থাকবে তিন বছর, কোন পরিবর্তন হবে না। এটা নতুন কোন প্রস্তাব নয়। মাঝে একবার এই ব্যবস্থা দুই বছরের জন্য চালু হয়েছিল। অজানা কারণে তা বন্ধ করে দেয়া হয়। জানা গেছে, সম্পদ করের বর্তমান বিধান রহিত হতে যাচ্ছে। বর্তমান বিধানে বলা হয়েছে, দুই কোটি টাকার উপরে সম্পদ থাকলেই আয়কর, সম্পদ কর দিতে হবে। বস্তুত, এটা সারচার্জ সম্পদ কর নয়। এ ব্যাপারে বহুবার লিখেছি। বলেছি এতে প্রকৃত সম্পদের মালিকরা কোন সম্পদকর দিচ্ছেন না। ধানম-ি, গুলশান, বনানী, উত্তরার বাড়ির মালিকরা সম্পদকরের বাইরে, কারণ তাদের বাড়ির ঘোষিত মূল্য কারও ক্ষেত্রে হাজারের কোটায়, কারও লাখ টাকার কোটায়। কোটি টাকার প্রশ্নই ওঠে না। বিপরীতে যে সমস্ত কর্মচারী-কর্মকর্তা এফডিআর এবং সঞ্চয়পত্রে (ফিন্যান্সিয়াল এ্যাসেট) বিনিয়োগ করেছেন তাদের টাকা প্রতিবছর বাড়ে, অতএব তাদের সম্পদ বাড়ে। তাদের সম্পদকর দিতে হয়। এই জুলুম যত তাড়াতাড়ি তিরোহিত হয় ততই মঙ্গল। এর পরিবর্তে সত্যিকার সম্পদকর চালু হোক। গুলশানে একটা বাড়ির মালিক হলে তাকে ধরা যাক ৫০ হাজার টাকার সম্পদকর দিতে হবে, উত্তরায় হলে এত। ফ্ল্যাটের মালিক হলে এত। এটা করা যাবে না কেন? করা যাবে ঘোষিত জমির মালিকানার ক্ষেত্রে। আশা করি, সরকার এ বিষয়ে ভাববে। বর্তমান বিধান অনুযায়ী একজন করদাতা তার মোট আয়ের একটা অংশ ‘সঞ্চয়পত্রে’ বিনিয়োগ করলে তিনি কর রেয়াত পান। তার অর্থ করদাতাকে প্রতিবছর সঞ্চয়পত্র কিনতে হবে। এটা করা হয় করদাতাকে সঞ্চয়ে উৎসাহিত করার জন্য। সরকারের সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়, করদাতার সঞ্চয় বাড়ে, তার কিছুটা করও লাঘব হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে সমস্যা সঞ্চয়পত্রের উর্ধতম ক্রয়সীমা। এক সময় পাঁচ বছর মেয়াদি সঞ্চয়পত্র ৪৫ লাখ টাকা পর্যন্ত কেনা যেত। হঠাৎ করে এর উর্ধতম সীমা ৩০ লাখ টাকায় নামানো হয়। এর কোন যুক্তি নেই। মূল্যস্ফীতির প্রশ্ন আছে, টাকার অঙ্কে বেতন বৃদ্ধির প্রশ্ন আছে, আবার সরকারের বেতন বৃদ্ধির কার্যক্রম আছে। বেসরকারী ও সরকারী খাতে প্রায় তিন বছর পর পর বেতন-ভাতা বৃদ্ধি পায়। তাহলে স্বভাবতই মোট বেতন বাড়বে। মোট বেতন বাড়লে বিনিয়োগের পরিমাণও বাড়াতে হবে। নতুবা কর বেশি দিতে হবে। এমতাবস্থায় কোন্ যুক্তিতে উর্ধতম ক্রয়সীমা হ্রাস করা হলো তার মাথামু-ু আমি কিছুই বুঝি না। ক্রয়সীমা হ্রাস মানেই অধিকতর কর দিতে বাধ্য করা। এসবের যুক্তি কী বুঝতে পারি না। সঞ্চয় বাড়াতে হলে উর্ধতন ক্রয়সীমা অন্তত আগের পর্যায়ে আনা দরকার। মনে রাখা দরকার, যত জিডিপি প্রবৃদ্ধিই হোক না কেন আমাদের ‘ডমেস্টিক সেভিংস রেট’ স্থবিরাবস্থায় আছে প্রায় দুই দশক ধরে। কত কথা হয়, কিন্তু সঞ্চয়ের ওপর কথা শুনি না। সঞ্চয় না হলে যে বিনিয়োগ হবে না এ কথটা কেউ জোর দিয়ে বলেন না। অথচ বলা উচিত নয় কী? সঞ্চয়পত্র ছাড়া আরেকটা বাজার আছে সেটা হচ্ছে শেয়ারবাজার। সেখানেও মধ্যবিত্তের বিনিয়োগ আছে। সেই বাজারে বিনিয়োগ করেও করদাতারা যাতে ‘কর রেয়াত’ পান তার ব্যবস্থাও করা যেতে পারে। কিন্তু বর্তমান অবস্থায় মধ্যবিত্ত সেখানে যাবে না। বাজার টালমাটাল। তিন-চার বছর আগে ঐ বাজারে মানুষ ভীষণ মার খেয়েছে। বহু লোক তার জীবনের সকল সঞ্চয় হারিয়েছে। বাজারটা এখন একবার ওঠে আবার নামে। বর্তমান বড় সমস্যা একটা। আর সেটা ব্যাংকগুলোকে নিয়ে। এক সময় নিয়ম ছিল ব্যাংকগুলো তাদের মোট আমানতের (ডিপোজিট) ১০ শতাংশ শেয়ারে বিনিয়োগ করতে পারত। সে সুযোগে অনেক ব্যাংক শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে। অনেকে লাভবানও হয়। আমানতের ১০ শতাংশ টাকা কিন্তু অনেক টাকা। ভাগ্যিস সব ব্যাংক তা করেনি। কিছুটা করতেই বাজার ভেঙ্গে পড়ে। ধস নামে বাজারে। বোঝা গেল ঐ সিদ্ধান্তটি ছিল মারাত্মক ভুল। অথচ ঐ ভুলটি করেন প-িতরা। ঐ প-িতরা ‘ব্যাংক কোম্পানি এ্যাক্ট-১৯৯১’র একটি ধারায় বিধান করেন যে, ব্যাংকগুলো তাদের স্ব-স্ব আমানতের ১০ শতাংশ পরিমাণ টাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে পারবে। কথা খুব সহজ। ব্যাংকের টাকা আমানতকারীদের টাকাÑ পরের ধনে ব্যাংক ‘পোদ্দারি’ করে। সেই টাকা ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ কেউ করে না। অথচ প-িতরা সেই বিধানই করলেন। এই ভুল বুঝতে আমাদের সময় লাগে প্রায় ২০-২২ বছর। যাহা বোঝা, তাহা করা ‘এ্যাকশন’। আগামী ২০১৬ সালের জুনের মধ্যে ব্যাংকগুলোকে শেয়ারবাজারে বিনিয়োজিত ‘অতিরিক্ত’ টাকা তুলে ফেলতে হবে। অতিরিক্ত মানে? এখনকার বিধান মূলধনের (আমানত নয়) ২৫ শতাংশ ব্যাংকগুলো শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে পারবে। অর্থাৎ আগের তুলনায় অনেক কম। অতএব অতিরিক্ত বিনিয়োগ এখনকার হিসাবে। তা কত হবে? কাগজে দেখলাম ৭ হাজার কোটি টাকার মতো। এই পরিমাণ শেয়ারবাজারে বিক্রি করতে হলে বাজার যাবে পড়ে। বিক্রির চাপ বাড়বে। এমতাবস্থায় বাজেটে সময় বাড়ানোর একটা ব্যবস্থা থাকা দরকার বলে মনে করি। এতে সঞ্চয় ও বিনিয়োগে একটা স্থিতিশীলতা আসতে পারে। শত হোক যে ভুল বুঝতে ২০-২২ বছর সময় লেগেছে তা শোধরানোর জন্য এক-দুই বছর পর্যাপ্ত মনে করার কোন কারণ নেই। পরিশেষে আয়করের ক্ষেত্রে আরেকটা সুপারিশ করব। আমরা জানি, মধ্যবিত্তের আয় তার সংসার চালানোর জন্য যথেষ্ট নয়। অনেকে স্বামী-স্ত্রী দু’জনে মিলে চাকরি করে। তবু হয় না। অনেকে ভোগ কমিয়ে সংসার চালায়। অনেকে ভাল জায়গায় বাসা বদলিয়ে খারাপ জায়গায় গিয়ে খরচ কমায়। কোচিংয়ে ছেলেমেয়েদের দেয় না। রিক্সা ছেড়ে হাঁটে, বাসে ওঠে। এভাবে চলে তার সংসার। সে বাঁচার তাগিদে আয় বাড়ানোর চেষ্টা করে। কেউ কেউ প্রাইভেট ‘টিউশন’ করে। এতে দুই পয়সা আয় হয়। অনেকে শহরে টুকটাক ব্যবসা করে। কারও হয়ত একটা ছোট মুদিদোকান আছে। কেউ হয়ত গ্রামে তার ভাই-ভাস্তেকে দিয়ে ব্যবসা করায়। ‘রাখি মাল’ রাখে অনেকে। পাটের সময় পাট, গুড়ের সময় গুড়, ডালের সময় ডাল তারা রাখে মৌসুমে। সুযোগমতো তা বিক্রি করে। অনেকে টাকা ধার দিয়ে দুই পয়সা কামাই করে। অনেক ব্যবসায়ী অল্প সময়ের জন্য টাকা ধার করে। অথচ ভাল সুদ দেয়, মধ্যবিত্ত এই সুযোগও ধরে। এমন হাজার ধরনের বিচিত্র কাজ করে অনেক করদাতা কিছু আয় করেন। অথচ ঐ আয় দেখানোর কোন পথ নেই, কোন দলিল নেই আয়ের। এ কারণে বৈধ আয়ের টাকাটা ‘কালো’ হয়। এর তো একটা বিহিত করা যায়। মোট আয় ধরা যাক চার লাখ টাকা। বিভিন্ন সূত্রের আয়। এর সঙ্গে ‘অন্যান্য’ খাতের আয় ২০ শতাংশ যোগ করতে দিলে কী সর্বনাশ হবে ‘এনবিআর’-এর? ধরা যাক, এই আয়ের জন্য কোন দলিল দিতে হবে না। সরকার এসব ভাবতে পারে। না ভেবে অবশ্য উৎসে কর কর্তনের দিকে বেশি নজরও দিতে পারে। এটাই হচ্ছে অবশ্য। লেখক : ম্যানেজমেন্ট ইকোনমিস্ট ও সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×