ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

শিক্ষকরাই জড়িয়ে পড়ছেন প্রশ্ন ফাঁস কেলেঙ্কারিতে

প্রকাশিত: ০৫:১৬, ২৫ মে ২০১৫

শিক্ষকরাই জড়িয়ে পড়ছেন প্রশ্ন ফাঁস কেলেঙ্কারিতে

বিভাষ বাড়ৈ ॥ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারির কারণে ফেসবুকসহ অন্যান্য মাধ্যমে প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা কিছুটা কমতে শুরু করলেও এ সঙ্কট এবার নতুন মোড় নিয়েছে। প্রশ্ন ফাঁসে এবার সরাসরি জড়িয়ে পড়েছেন খোদ অধ্যক্ষ, প্রধান শিক্ষকসহ অন্যান্য শিক্ষক। পরীক্ষার শুরুর দুই-তিন ঘণ্টা আগেই বান্ডিল খুলে প্রশ্নের উত্তর ঠিক করে শিক্ষকরাই পৌঁছে দিচ্ছেন পরীক্ষার্থীদের কাছে। চলমান এইচএসসি পরীক্ষায় গত এক সপ্তাহেই রাজধানীতে এমন ঘটনায় হাতে নাতে ধরা পড়েছেন দুই নামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা। বুধবার টঙ্গীর শফিউদ্দিন সরকার একাডেমি এ্যান্ড কলেজের ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই রবিবার আবার একই কেলেঙ্কারির জন্ম দিয়েছে বিএএফ শাহিন কলেজ। শফিউদ্দিন সরকার একাডেমির ঘটনায় মামলা হয় তিন শিক্ষক, শাহিনের ঘটনায় মামলা হয়েছে আরও এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে। এদিকে শিক্ষা বোর্ড কর্মকর্তারা বলছেন, তাদের কাছে দেশের আরও নামী-দামি স্কুল-কলেজের বিষয়েও আসছে এমন উদ্বেগজনক তথ্য। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সচিব সাহেদুল খবীর চৌধুরী পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলছিলেন, বিষয়টি খুবই উদ্বেগের। অধ্যক্ষ, প্রধান শিক্ষক বা অন্য শিক্ষকরা যদি আগেই প্রশ্নপত্রের বান্ডিল খুলে তাদের পরীক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছে দেয় তাহলে বুঝতে হবে আমাদের চিন্তাধারা কত নিচে নেমে গেছে। অধ্যক্ষের উপস্থিতিতে পরীক্ষার আগেই প্রশ্নের বান্ডিল খোলা হচ্ছে, তারপর প্রশ্নের উত্তর ঠিক করে পরীক্ষার্থীদের কাছে পাঠানো হচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে দীর্ঘদিন বিদ্যালয় পরিদর্শকের দায়িত্ব পালন করা এ কর্মকর্তা বলেন, বেশ কয়েকদিন ধরেই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে এমন তথ্য আমাদের কাছে আসছে। সে অনুসারে আমরা পরীক্ষার আগে না জানিয়েই হঠাৎ করে পরিদর্শনে চলে যাচ্ছি প্রতিষ্ঠানগুলোতে। তবে যেখানে ধরা পড়েছে সমস্যা কেবল সেখানেই নয়। আমাদের কাছে খবর আসছে দেশের স্বনামধন্য অনেক স্কুল-কলেজ সম্পর্কেও। প্রতিষ্ঠানের ভাল ফল দেখানোর জন্য এসব করছে অনেকে। বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে বোর্ড কাজ করছে বলে জানালেন ওই কর্মকর্তা। জানা গেছে, রবিবার এইচএসসির রসায়ন দ্বিতীয়পত্র পরীক্ষা শুরুর আগেই বিএএফ শাহিন কলেজে প্রশ্নের বান্ডিল খুলে প্রশ্ন পাঠানোর আলামত পান ঢাকা বোর্ডের কর্মকর্তারা। একজন শিক্ষকের কাছেও পাওয়া যায় প্রশ্ন। এই কলেজের শিক্ষার্থীদের কেন্দ্র পার্শ্ববর্তী আরেকটি কলেজে। সেখানেই প্রশ্ন পাঠানোর চেষ্টা ছিল বলে অভিযোগ। ঘটনায় যার কাছে প্রশ্ন পাওয়া যায় সেই শিক্ষক মোঃ কামরুজ্জামানের বিরুদ্ধে বোর্ড বাদী হয়ে কাফরুল থানায় মামলা দায়ের করেছে। এর আগে গত বুধবার ঠিক একই কায়দায় পরীক্ষা শুরুর দুই ঘণ্টা আগেই প্রশ্ন পরীক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে দেয়ার ঘটনায় টঙ্গী শফিউদ্দিন সরকার একাডেমির দুই শিক্ষকসহ তিনজনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। এ কেলেঙ্কারির ঘটনায় ঢাকা শিক্ষা বোর্ড বাদী হয়ে টঙ্গি থানায় এ মামলা দায়ের করে। ওই মামলার আসামিরা হলেন এইচএসসি পরীক্ষার কেন্দ্র সফিউদ্দিন সরকার একাডেমি এ্যান্ড কলেজের জীববিজ্ঞান বিষয়ের শিক্ষক আবদুল্লাহ আল-আনসার, স্কুল শাখার সিনিয়র সহকারী শিক্ষক মশিউল ইসলাম ও অফিস সহকারী নজরুল ইসলাম। জানা যায়, বাদী বুধবার সকাল ৯টায় কেন্দ্র পরিদর্শনে গিয়ে কেন্দ্র সচিবের কক্ষে দেখতে পান জীববিজ্ঞান ও ইতিহাস বিষয়ের প্রশ্নপত্রের বান্ডিল খোলা। এ সময় কক্ষে উপস্থিত আসামিদের কারণ জিজ্ঞেস করলে তারা কোন সদুত্তর দিতে পারেননি। তিনি এ সময় প্রশ্নগুলো গণনা করে সংখ্যায় গরমিল পান। বান্ডিলে নির্ধারিত সংখ্যার প্রশ্নপত্র না থাকার কারণও এড়িয়ে যান আসামিরা। এ সময় কেন্দ্র সচিব ও অধ্যক্ষ শহিদুল ইসলাম রহস্যজনক কারণে অফিসে না থেকে পরীক্ষার ফল ভাল করার অপকৌশল হিসেবেই প্রশ্নপত্র ফাঁসের সুযোগ করে দেন বলেও অভিযোগ করা হয়। প্রতিদিন সকাল ৮টায় থানা থেকে প্রশ্নপত্র বুঝে নেয়ার পর পরীক্ষা শুরুর নির্ধারিত সময়ের দেড়/দুই ঘণ্টা আগেই প্রশ্নপত্র ফাঁস করা হতো বলে বাদী উল্লেখ করেন। এ ঘটনায় মামলা দায়ের ছাড়াও অধ্যক্ষকে কেন্দ্র সচিবের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা থানার অফিসার ইনচার্জ তদন্ত আমিনুল ইসলাম বলেন, মামলার তদন্ত শুরু হয়েছে। এদিকে গত কয়েক মাসে শিক্ষকদের প্রশ্ন ফাঁসে জড়িয়ে পড়ার বেশ কয়েকটি ঘটনার প্রমাণ পাওয়া গেছে। বেশ কয়েকটি ঘটনায় আটকও হয়েছেন শিক্ষকরা। বিদ্যালয়ের গেল বার্ষিক পরীক্ষায় লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলায় গণিত বিষয়ের প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় এক শিক্ষকের সংশ্লিষ্টতা পায় তদন্ত কমিটি। তাঁর নাম শফিকুল ইসলাম। তিনি আদিতমারীর সাপ্টিবাড়ী নিম্ন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার তৈরি করা দুটি তদন্ত প্রতিবেদনেই এ তথ্য জানা যায়। জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা এস এম মোসলেম উদ্দিন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালকের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন দুটি দাখিল করেন। গেল প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় বগুড়ায় বাংলার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ স্বীকার করায় সরকারী প্রাথমিক এবং উচ্চ বিদ্যালয়ের ৪ শিক্ষককে কারাদ- ও অর্থদ- দিয়েছিল ভ্রাম্যমাণ আদালত। দ-প্রাপ্ত মাহবুবুর রহমান স্থানীয় গাবতলী মডেল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক, শফিকুল ইসলাম আটঘরিয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক, গোলাম সারোয়ার গোরদহ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, শাহীন কাদির শহরের ইয়াকবিয়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। এবারের এসএসসি পরীক্ষায় কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার একটি কেন্দ্র থেকে প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে স্কুলের সহকারী শিক্ষক ইসলাম হোসেনের দুই বছরের বিনাশ্রম কারাদ- দিয়েছিল ভ্রাম্যমাণ আদালত। জেলার খোকসায় জেএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস ও উত্তরপত্র তৈরির দায়ে চার শিক্ষকের দুই বছর করে কারাদ- ও ৫ হাজার টাকা করে জরিমানা করেছিলেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। এদিকে কিছুদিন আগে অগ্রণী ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের বিষয়ে অভিযোগ উঠেছিল।
×