ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

দুর্ধর্ষ ২১ জঙ্গীর ডেথ রেফারেন্স দীর্ঘদিন শুনানির অপেক্ষায়

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ২৪ মে ২০১৫

দুর্ধর্ষ ২১ জঙ্গীর ডেথ রেফারেন্স দীর্ঘদিন শুনানির অপেক্ষায়

আরাফাত মুন্না ॥ ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৪। মৃত্যুদ- প্রাপ্ত দুই দুর্ধর্ষ জঙ্গী এবং যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত এক জঙ্গীকে মুক্তাগাছা থানার রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা ও কোতোয়ালি থানার সিরিজ বোমা হামলাসহ ৫ মামলায় হাজিরা দিতে নেয়া হচ্ছিল ময়মনসিংহের আদালতে। সকাল সাড়ে দশটা। ময়মনসিংহের ত্রিশালে ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কে সাইনবোর্ড এলাকায় হঠাৎ প্রিজন ভ্যানের ওপর অতর্কিত গুলি ও বোমা হামলা শুরু হয়। ২০-২৫ অস্ত্রধারী হামলা চালিয়ে ফিল্মি কায়দায় ছিনিয়ে নেয় জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) তিন দুর্ধর্ষ ক্যাডারকে। এ হামলায় এক পুলিশ সদস্য নিহত ও আহত হন আরও দুজন। পরে ছিনিয়ে নেয়া এক জঙ্গী পুলিশের হাতে ধরা পড়লে বন্দুক যুদ্ধে নিহত হন। শুধু এই তিন জঙ্গীই নয়, দেশের বিভিন্ন কারাগারে থাকা মৃত্যুদ-প্রাপ্ত ২১ দুর্ধর্ষ জঙ্গীকেও বিভিন্ন আদালতে আনা নেয়া করা হয় ঝুঁকি নিয়েই। যাদের মধ্যে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠন হরকাতুল জিহাদের নেতা মুফতি হান্নানও রয়েছেন। এদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা থাকায় এক প্রকার বাধ্য হয়েই আনা-নেয়া করা হয় দেশের বিভিন্ন আদালতে। ছিনিয়ে নেয়া দুই জঙ্গীসহ বিভিন্ন মামলায় ২৯ ভয়ঙ্কর জঙ্গীকে মৃত্যুদ- দেন দেশের বিভিন্ন আদালত, যাদের মধ্যে শায়খ আবদুর রহমানসহ ছয় জঙ্গীর ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। বাকি ২১ জন কারাগারে আছে। ওই জঙ্গীদের ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদ- নিশ্চিতকরণ) দীর্ঘদিন ধরে শুনানির অপেক্ষায় আছে হাইকোর্টে। এসব ডেথ রেফারেন্স অগ্রধিকার ভিত্তিতে শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে কোন বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। আইনজ্ঞরা মনে করেন, একটি মামলায় ফাঁসি কার্যকর হলে এদের বিভিন্ন আদালতে হাজির করার প্রয়োজন হতো না। ফলে পালানোরও সুযোগ পেতো না তারা। অভিযোগ রয়েছে, কারাগারে থাকা জঙ্গীরা এখনও যোগাযোগ রেখে চলেছে বাইরে থাকা জঙ্গীদের সঙ্গে। আর এ কারণে ফাঁসির দ-প্রাপ্ত দুই জঙ্গী ও যাবজ্জীবন কারাদ-প্রাপ্ত এক জঙ্গীকে কাশিমপুর কারাগার থেকে ময়মনসিংহের একটি মামলায় হাজির করার জন্য নেয়ার সময় ত্রিশালে ফিল্মি স্টাইলে ছিনিয়ে নেয় তাদের সহযোগীরা। ওই তিন ভয়ঙ্কর খুনী হলো- জেএমবির বোমা বিশেষজ্ঞ সালাউদ্দিন, রাকিব হাসান ও বোমা মিজান। জানা গেছে, জঙ্গী সালাউদ্দিনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন আদালতে প্রায় ৪০ এবং রাকিব হাসানের বিরুদ্ধে ৩০ মামলা রয়েছে। সালাউদ্দিন তিন মামলায় এবং রাকিব একটি মামলায় ফাঁসির দ-প্রাপ্ত। ২০০৪ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর বোমা হামলার ঘটনায় দায়ের মামলায় ২০০৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠন হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি আবদুল হান্নান ওরফে মুফতি হান্নানকে মৃত্যুদ-ের নির্দেশ দেন আদালত। সিলেটের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল ওই রায় দেন। মুফতি হান্নানের দুই সহযোগী শরীফ শাহেদুল বিপুল ও দেলোয়ার হোসেন রিপনকেও একই মামলায় মৃত্যুদ- দেয়া হয়। মুফতি হান্নান ও বিপুল কারাগারে থাকলেও রিপন পলাতক। এই তিন জঙ্গীর মৃত্যুদ- নিশ্চিতকরণ অনুমোদনের (ডেথ রেফারেন্স) বিষয়টি পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে হাইকোর্টে শুনানির অপেক্ষায়। এদিকে ঢাকার রমনা বটমূলে বোমা হামলার ঘটনায় দায়ের হত্যা মামলায়ও মৃত্যুদ- দেয়া হয়েছে মুফতি হান্নানকে। তার বিরুদ্ধে ঢাকা, সিলেট, নোয়াখালী, গোপালগঞ্জ, বাগেরহাট, খুলনা, হবিগঞ্জে আরও ৩৫ মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এসব মামলায় প্রায়ই তাকে এক কারাগার থেকে ওসব আদালতে হাজির করতে হয়। দুর্ধর্ষ এই জঙ্গী ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলারও আসামি। দেশের বিভিন্ন আদালতে তাকে আনা নেয়ার কারণে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ কয়েকবার পিছিয়ে দিতে হয়েছে। ২০০৫ সালে বোমা হামলার ঘটনায় দায়ের একটি হত্যা মামলায় জেএমবি জঙ্গী আমজাদ হোসেন বাবু ও এইচ এম মাসুমুর রহমানকে মৃত্যুদ- দেন লক্ষ্মীপুরের দায়রা জজ আদালত। ২০০৬ সালের ১৫ আগস্ট এ রায় দেয়া হলেও এখনও হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্স শুনানি হয়নি। একই বছর বোমা হামলা মামলার ঘটনায় শরীয়তপুরের বিশেষ ট্রাইব্যুনাল ২০১৩ সালের ২৮ জানুয়ারি ফাঁসির নির্দেশ দেন কামারুজ্জামান ওরফে স্বপন নামে এক জঙ্গীকে। ২০০৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সিলেটের দায়রা জজ জঙ্গী আক্তারুজ্জামানকে, ২০০৮ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-২ জঙ্গী আসাদুজ্জামানকে, ২০১০ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর জঙ্গী আবুল কালাম ওরফে শফিউল্লাহকে বিভিন্ন স্থানে বোমা হামলার মামলায় ফাঁসির নির্দেশ দেন। এসব আসামির ডেথ রেফোরেন্সেরও এখন পর্যন্ত শুনানি হয়নি। পুলিশের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, এসব আসামির বিরুদ্ধে এক থেকে ৪০ পর্যন্ত মামলা রয়েছে। সম্প্রতি পুলিশের পক্ষ থেকে একটি তালিকা করে এদের ডেথ রেফারেন্স শুনানির ব্যবস্থা করতে সরকারের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়েছে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, জেএমবি ও হরকাতুল জিহাদের এসব জঙ্গীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন আদালতে মামলা বিচারাধীন থাকায় প্রায়ই তাদের নিয়ে যেতে হয় বিভিন্ন জেলায়, যা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এ বিষয়ে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা মাহবুবে আলম বলেন, হাইকোর্টে কোন মামলা কোন বেঞ্চে শুনানি হবে তা নির্ধারণ করেন প্রধান বিচারপতি। তাই জঙ্গীদের মৃত্যুদ- অনুমোদনের বিষয়ে বিচারাধীন ডেথ রেফারেন্স দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য হাইকোর্টে বিশেষ বেঞ্চ গঠন করা যায় কি-না সে বিষয়েও সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার প্রধান বিচারপতিরই। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে বিশেষ বেঞ্চ গঠন করার জন্য প্রধান বিচারপতির কাছে আবেদন করা হবে কি-না জানতে চাইলে এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘বিশেষ ব্যক্তির জন্য বিশেষ বেঞ্চ গঠন করার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। তাদের মামলা দ্রুত শুনানির ব্যবস্থা করা গেলে বিশেষ বেঞ্চ গঠন করার প্রয়োজন হবে না।’ তিনি বলেন, জঙ্গীদের বিরুদ্ধে যেসব মামলা বিচারাধীন রয়েছে, সেসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেয়া হবে। এ বিষয়ে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার বিশেষ পিপি মোশাররফ হোসেন কাজল জনকণ্ঠকে বলেন, ‘অবশ্যই দ্রুত ডেথ রেফারেন্সগুলো নিষ্পত্তি হওয়া উচিত। তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আরও যেসব মামলা বিচারাধীন রয়েছে, সেসব মামলা নিষ্পত্তিতেও সুবিধা হয়।’ তিনি আরও বলেন, কোন জঙ্গীর ডেথ রেফারেন্স নিষ্পত্তির মাধ্যমে যদি দণ্ড কার্যকর করা হয়, তাহলে আর অন্য মামলাগুলোতে আদালতে হাজির করার প্রয়োজন হবে না। আইনজীবী ইমতিয়াজ আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, জঙ্গী নির্মূলের জন্য মামলাগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিষ্পত্তি করা প্রয়োজন। তারা ভয়ংকর অপরাধী। কিছু জঙ্গীর ফাঁসি কার্যকর হলে, নতুন যারা জঙ্গীবাদে ঝুঁকছে তারা ভয় পাবে। মৃত্যুদ-প্রাপ্ত যেসব জঙ্গী কারাগারে ॥ মৃত্যুদ-প্রাপ্ত মুফতি হান্নান কাশিমপুরে ২ নম্বর কারাগারে আছেন। রমনা বটমূলে বোমা হামলার ঘটনায় উদ্ভূত হত্যা মামলায় মৃত্যুদ-প্রাপ্ত হুজির জঙ্গী আরিফ হাসান সুমনও কাশিমপুর কারাগারে। গাজীপুর আদালতে বোমা হামলা মামলায় মৃত্যুদ-প্রাপ্ত জেএমবি সদস্য মোঃ নিজাম উদ্দিন ওরফে রনি ওরফে রেজা, আরিফুর রহমান ওরফে হাসিব ওরফে আকাশ, সাউদুল মুন্সী ওরফে ইমন ওরফে পলাশ, মাসুদ ওরফে আনিসুল ইসলাম ওরফে ভুট্টু, আবদুল্লাহ আল সোয়াইল ওরফে ফারুক ওরফে জাহাঙ্গীর ওরফে আকাশ, এনায়েতুল্লাহ জুয়েল ওরফে ওয়ালিদ, তৈয়বুর রহমান ওরফে হাসান, মামুনুর রশিদ ওরফে জাহিদ, আশ্রাফুল ইসলাম ওরফে আব্বাস খান ও আদনান সামী গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে আছে। এদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। প্রত্যেককেই ঝুঁকি নিয়ে হাজির করতে হয় বিভিন্ন আদালতে। বিভিন্ন মামলায় মৃত্যুদ-প্রাপ্ত জঙ্গী আমজাদ হোসেন বাবু, এইচ এম মাসুমুর রহমান, কামারুজ্জামান ওরফে স্বপন, আক্তারুজ্জামান, আসাদুজ্জামান ও আবুল কালাম ওরফে শফিউল্লাহ আছে গাজীপুর হাই সিকিউরিটি কারাগার ও কাশিমপুর কারাগারে।
×