ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নিষিদ্ধ হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ২২ মে ২০১৫

আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নিষিদ্ধ হচ্ছে

শংকর কুমার দে ॥ উগ্র মৌলবাদী জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নিষিদ্ধ করা হচ্ছে। আনসারুল্লাহ বাংলা টিম-১৩ নামের জঙ্গী সংগঠনের বরাত দিয়ে ১০ বিশিষ্ট ব্যক্তিকে চিঠি পাঠিয়ে প্রাণনাশের হুমকি দেয়ার প্রেক্ষিতে তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থা। নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে বিশিষ্ট ওই ব্যক্তিদের। বুধবার ১০ বিশিষ্ট ব্যক্তিকে হুমকি দেয়ার ঘটনায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে রাজধানীর শাহবাগ থানায়। দেশের বিশিষ্ট ১০ ব্যক্তিকে সরকার বিশেষ নিরাপত্তা দেবে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে যারা লেখেন, কথা বলেন, মুক্তচিন্তা করেন, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আছেন- এমন সব রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী, মুক্তমনা প্রগতিশীল লেখক, ব্লগাররাই আছেন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের হিটলিস্টে। জামায়াত-শিবির নিয়ন্ত্রিত যুদ্ধাপরাধীর পক্ষের ফেসবুক, টুইটার, ব্লগে হত্যার টার্গেট করে উস্কানি দেয়া হচ্ছে। সর্বশেষ দেশের বিশিষ্ট ১০ জনকে প্রাণনাশের হুমকি দেয়ার মধ্য দিয়ে জঙ্গী সংগঠনগুলোর তৎপরতা জানান দেয়া হলো বলে মনে করেন গোয়েন্দারা। প্রসঙ্গত, বুধবার সকালে ডাকযোগে পাঠানো ইংরেজী ভাষায় লেখা চিঠির মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচটি ইমাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, ঢাবির জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ অসীম সরকার, ড. জাফর ইকবাল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক কাবেরী গায়েন ও গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ডা. ইমরান এইচ সরকারসহ ১০ বিশিষ্ট ব্যক্তিকে হত্যার হুমকি দেয় আল কায়েদার অনুসারী আনসারুল্লাহ বাংলা টিম-১৩। ওই হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে শাহবাগ থানায় অসীম সরকারের পক্ষ থেকে একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়। বিশিষ্ট দশজনকে প্রাণনাশের হুমকি দেয়ার চিঠিটিতে প্রেরকের কোন ঠিকানা নেই। সাদা কাগজে লেখা ওই চিঠিতে কাউকে ইসলামের দুশমন, কাউকে হিন্দু মৌলবাদী, ব্লগার ইত্যাদি নামে আখ্যায়িত করা হয়। প্রেরকের ঠিকানাবিহীন চিঠিতে উপরোক্ত ব্যক্তিদের মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি নিতে বলা হয়। যে খামে চিঠি পাঠানো হয়েছে তার ওপর ঢাকা জিপিওর সিল মারা। খামের ওপর লাগানো ছিল ছয় টাকার টিকিট। আনসারুল্লাহ বাংলা টিম-১৩ নামের জঙ্গী সংগঠনটি ডাকযোগে পাঠানো ইংরেজীতে লেখা একটি চিঠিতে এ হত্যার হুমকি দেয়। জিডির তদন্ত ডিবিতে ॥ শাহবাগ থানায় যে জিডি করা হয়েছে তার তদন্তভার ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশে (ডিবি) নেয়ার জন্য আবেদন করেছেন শাহবাগ থানার পুলিশ। শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু বক্কর ছিদ্দিক ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারের বরাবর বিশিষ্ট ১০ জনকে প্রাণনাশের হুমকি প্রদানের জিডির তদন্তভার ডিবিতে হস্তান্তরের জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন বলে জানা গেছে। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী যা বলেছেন ॥ স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জমান খান কামাল বলেছেন, দেশের বিশিষ্ট ১০ ব্যক্তিকে সরকার বিশেষ নিরাপত্তা দেবে। বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে বাংলাদেশ সেক্রেটারিয়েট রিপোর্টার্স আয়োজিত ফোরাম মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে একথা জানান স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, দেশের সব মানুষেরই নিরাপত্তার দায়িত্ব রয়েছে আমাদের। তবে তাদের যেহেতু হুমকি দিয়েছে, সে কারণেই তাদের নিরাপত্তায় গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। সাংবাদিকদের অপর এক প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ব্লগারদের হত্যা আর দেশের বিশিষ্ট ১০ জনকে হত্যার হুমকির মধ্যে ভিন্নতা থাকতে পারে। এ সকল ঘটনা আল কায়েদা-আনসারুল্লাহ বাংলা টিম ঘটাচ্ছে- না ওই নামে অন্য কেউ ঘটাচ্ছে, তা অনুসন্ধানের বিষয়। কারা হুমকি দিচ্ছে, কী কারণে হুমকি দিচ্ছে, তা গোয়েন্দা অনুসন্ধানে জানা যাবে বলে জানান প্রতিমন্ত্রী। তিনি বলেন, বিশিষ্ট ১০ ব্যক্তি দেশ ও স্বাধীনতার কথা বলেন। আর যারা হুমকি দিচ্ছে তারা স্বাধীনতা ও দেশের অগ্রগতির বিপক্ষে। তবে ব্লগার হত্যা আর ১০ বিশিষ্ট ব্যক্তিকে হত্যার হুমকির মোটিভ ভিন্ন হতে পারে। এর পেছনে যে সংগঠনই জড়িত থাকুক না কেন অনুসন্ধান করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। নিষিদ্ধ হচ্ছে আনসারুল্লাহ জঙ্গী সংগঠনটি ॥ উগ্র মৌলবাদী জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমকে (এবিটি) নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে যাচ্ছে সরকার। ‘সিরিয়াল কিলিং’ করে যাচ্ছে এ সংগঠনটি। ‘সিøপার সেল’ ও ‘কাট-আউট’ পদ্ধতিতে খুন করে এ সংগঠনের জঙ্গীরা। এ সংগঠনের হিটলিস্টের আছে ব্লগার, লেখক, বুদ্ধিজীবী। যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে ফেসবুক, টুইটার, ব্লগে লেখালেখি করেন এমন প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীরাই হচ্ছেন তাদের টার্গেট। জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে সম্পৃক্ততা আছে এ সংগঠনটির। মুক্তমনার ব্লগার ও লেখক অভিজিত রায়কে হত্যার জন্য দায়ী করা হচ্ছে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমকেই। আনসারুল্লাহ বাংলা টিম একের পর এক সিরিয়াল কিলিং করে যাওয়ার প্রতিবেদন জমা হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। অধ্যাপক ড. হুমায়ুন আজাদ, ব্লগার রাজীব, ইমাম মাহাদীর কথিত সেনাপতি লুৎফর রহমান, মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকী ও বুয়েট ছাত্র দীপকে হত্যা করে এ জঙ্গী সংগঠনটিই। ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারকে খুনের মধ্য দিয়ে এ সংগঠনটির প্রকাশ্যে আসার আত্মপ্রকাশ ঘটে ২০১৩ সালে। তারপর একের পর এক খুনের ঘটনার দায় স্বীকার করে চ্যালেঞ্জ দিয়ে যাচ্ছে এ জঙ্গী সংগঠনটি। কখনও আনসার আল ইসলাম বাংলাদেশ, আবার কখনও আনসার আল ইসলাম বাংলাদেশ-২ নামে হত্যার দায় স্বীকার করছে তারা। আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, হিযবুত তাহরীর, ইসলামিক স্টেটসহ অন্য উগ্রপন্থী জঙ্গীরা একই সূত্রে গাঁথা, মুদ্রার এপিট আর ওপিঠ মাত্র। একটি জঙ্গী সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হলে সেই জঙ্গী সংগঠনের জঙ্গীরা অন্য নামের জঙ্গী সংগঠনের ব্যানারে কাজ করতে থাকে। জঙ্গী সংগঠনগুলোর আদর্শ, উদ্দেশ্য ও কাজের ধরনও প্রায় একই। ৮৪ ব্লগারের তালিকা ॥ আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের ১০ জনকে হত্যার হুমকি দেয়াসহ এর আগে যে ৮৪ জন মুক্তমনা লেখক ও ব্লগারের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে তাদের অনেকেরই কোন নিরাপত্তা নেই। ৮৪ ব্লগারকে বর্ণনা করা হচ্ছে ‘নাস্তিক বা ইসলামবিরোধী’। এর মধ্যে অন্তত ৪ জন হত্যাকা-ের শিকার হয়েছেন। তালিকাভুক্ত ব্লগার ও লেখকদের মধ্যে গত দুই মাসে অভিজিত, ওয়াশিকুর ও অনন্ত বিজয় দাস- এই তিনজনকে কুপিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। হত্যাকারীরা হুমকি দিচ্ছে, মোবাইলে এসএমএস পাঠাচ্ছে, বাসার সামনে ঘোরাঘুরি করছে, মোটরসাইকেলেও অনুসরণ করছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তাদের নিরাপত্তার বিষয়ে আরও সক্রিয় হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা।
×