ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মগের মুল্লুক বলে কথা-

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ২১ মে ২০১৫

মগের মুল্লুক বলে কথা-

মোয়াজ্জেমুল হক ॥ মগজাতি অধ্যুষিত সাবেক বার্মা বর্তমানে মিয়ানমার সরকার প্রমাণ করেছে কেন তাদের দেশকে ‘মগের মুল্লুক’ বলা হয়ে থাকে। সে দেশে বসবাসরত রোহিঙ্গা মুসলমানদের নিয়ে জাতিগত দাঙ্গা নিয়ে যে বর্বরতার উদাহরণ মিয়ানমার সৃষ্টি করেছে, তা বিশ্ব বিবেককে যুগপৎ লজ্জিত ও উৎকণ্ঠিত করে তুলেছে। কয়েক দশক জুড়ে এসব রোহিঙ্গা মুসলমানদের নিয়ে সে দেশের সামরিক জান্তা সরকার ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীগুলো যে বর্বর আচরণ করে চলেছে তা বর্তমান দুনিয়ায় অসভ্যতা, অমানবিকতার সর্বশেষ উদাহরণ হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। পক্ষান্তরে, বাংলাদেশ মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নাগরিকদের বৈধভাবে আশ্রয় এবং অবৈধভাবে বসতি স্থাপনকারীদের প্রতি মানবিক আচরণ করে যে উদাহরণ সৃষ্টি করেছে তাতে মিয়ানমারের লজ্জিত হওয়া উচিত বলে দেশের বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ সূত্রে দাবি করা হয়েছে। কয়েক দশক ধরে সে দেশের রাখাইন প্রদেশে (সাবেক আরাকান) রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর নিপীড়ন নির্যাতন, ভোটাধিকার, নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত রেখে যে মনমানসিকতা দেখাচ্ছে এবং এতে করে দলে দলে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অবৈধভাবে প্রবেশ করে আশ্রিত হয়েছে তা বিশ্বজুড়ে প্রশংসা কুড়িয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, রোহিঙ্গা ছাড়াও বাংলাদেশে মিয়ানমারের মগ জাতিগোষ্ঠীর বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সম্প্রদায়ের শ্রেণী পেশার লোকজন বহু আগে থেকে এদেশে বসতি গেড়েছে। কক্সবাজার, উখিয়া, টেকনাফ, নাইক্ষ্যংছড়ি, বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়িসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় মিয়ানমারের মগ জাতিগোষ্ঠীর লাখ লাখ নারী-পুরুষ এদেশে বসতি গেড়ে নাগরিকত্ব নিয়ে শান্তিতে বসবাস করে যাচ্ছে। নিপীড়ন নির্যাতন তো দূরের কথা। সেক্ষেত্রে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নাগরিকদের বাংলাদেশী আখ্যায়িত করে সে দেশের সরকার এখনও পর্যন্ত যে অসভ্য আচরণ করে যাচ্ছে তার কোন ব্যাখ্যা সে দেশের সরকারী বেসরকারী বা সুশীল সমাজের পক্ষে দেয়ার কোন সুযোগ তিরোহিত। বিভিন্ন সূত্রে বলা হচ্ছে, তর্কের খাতিরে বা বাস্তবতার ভিত্তিতে সে দেশের রোহিঙ্গা মুসলমানরা হাজার বছর আগে থেকে সে দেশে গিয়ে বসতি গড়ে তুলে থাকলে দোষটি কোথায়। যেমন সে দেশের মগ সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে তাদের বসতি গড়ে তুলে বৈধতা লাভ করেছে। কক্সবাজার অঞ্চলে রাখাইন নামের বার্মিজরা তাদের একাধিক কলোনি মার্কেট ছাড়াও ব্যবসা-বাণিজ্য এবং সরকারী বেসরকারী চাকরিতে রত। পক্ষান্তরে, মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা সর্বক্ষেত্রে উপেক্ষিত। এরা সেদেশে উদ্বাস্তু। নাগরিক অধিকার বলতে কিছুই নেই। পরিসংখ্যান মতে সে দেশের ১৩ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা মুসলমান রয়েছে। পক্ষান্তরে, বাংলাদেশে রয়েছে এর চেয়ে বহুগুণে বেশি বর্মী নাগরিক। রাখাইন, মং, প্রুসহ নামের শেষে এ ধরনের নানা টাইটেল রয়েছে তাদের। মূলত এরা সবাই মগ জাতি এবং শ’ শ’ বছর আগে এরা সাবেক বার্মা থেকে এ অঞ্চলে এসে বসতি গেড়েছে। এক সময় বৃহত্তর চট্টগ্রাম আরাকান রাজ্যের অধীনে থাকার কারণে দু’অঞ্চলের মানুষ অবাধে বিনা পাসপোর্টে আসা যাওয়া করত এবং ব্যবসা-বাণিজ্য করত। সে কারণে যার যেখানে ইচ্ছা এবং সুবিধা সেখানেই তারা বসতি গেড়েছে। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানরা গত কয়েক যুগ ধরে কেবলই দেশান্তর হচ্ছে। বাংলাদেশের শরণার্থী হিসেবে আশ্রিত হয়েছে অসংখ্য। ইতোমধ্যে কিছু ফেরত গেছে। কিন্তু সরকারী পরিসংখ্যানে এখনও রয়ে গেছে ৩২ হাজার। অথচ বেসরকারী পরিসংখ্যানে তা ১০ লক্ষাধিক। আর রাখাইনসহ মগ জাতিগোষ্ঠীর বিভিন্ন ছোট ছোট সম্প্রদায়ের মানুষের সংখ্যা লাখ লাখ। যারা এদেশের নাগরিক অধিকার নিয়ে, পাসপোর্ট পেয়ে সকল সুযোগ-সুবিধা অর্জন করে সুস্থ জীবনযাপন করছে। সর্বশেষ মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া সমুদ্র উপকূলে যে অভিবাসী সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে তাদের অধিকাংশ মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমান। নারী, পুরুষ, শিশু আবাল বৃদ্ধ বনিতা নির্বিশেষে এরা মিয়ানমার ছেড়ে অজানা গন্তব্যে পাড়ি দিয়ে যাচ্ছে অতীতের মতো। তাদের এ দেশান্তর প্রক্রিয়ার সুযোগ নিয়েছে মানব পাচারকারী চক্রের হোতারা। এ চক্রের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার ও মালয়েশিয়ার একশ্রেণীর নরপশু, যারা মানবপাচারকারী হিসেবে চিহ্নিত। মূলত রোহিঙ্গাদের এ দেশান্তরিত হওয়ার প্রক্রিয়ার সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে সমুদ্র পথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশী হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর কিছু মানুষ। রোহিঙ্গাদের দেখানো পথে এরা সওয়ারি হয়েছে। মগের মুল্লুকের দেশ বলে খ্যাত মিয়ানমার রোহিঙ্গা মুসলমানদের নাগরিকত্ব না দিয়ে উল্টো বলছে ওরা বাংলাদেশী। কিন্তু বাংলাদেশ সে দেশের মগ সম্প্রদায়ের লোকজন যারা বাংলাদেশে বসতি গেড়েছে তাদের কখনও বলেনি ওরা বার্মিজ। বছরের পর বছর ধরে সামরিক শাসনের যাতাকলে থেকে মিয়ানমার এখন গণতন্ত্রের পথে বলে বিশ্বব্যাপী প্রচার হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র তাদের দীর্ঘদিনের অবরোধ মিয়ানমারের উপর থেকে তুলে নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত দু’বার মিয়ানমার সফর করেছেন। আর মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট বিরোধীদলীয় নেত্রী অং সান সুকি যুক্তরাষ্ট্র সফর করেছেন। তাদের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকে সব সময় প্রাধান্য পেয়েছে রোহিঙ্গা মুসলমানদের সমস্যা নিয়ে। প্রেসিডেন্ট ওবামা মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট ও বিরোধী নেত্রীকে বার বার আহ্বান জানিয়েছেন রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বসহ সকল সুযোগ-সুবিধা প্রদান করতে। বিপরীতে মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট ও বিরোধীদলীয় নেত্রী এ আহ্বানে সাড়া দেয়ার ইঙ্গিতও দিয়ে এসেছেন। কিন্তু এ পর্যন্ত মিয়ানমার সরকার প্রমাণ করেছে ‘কয়লার ময়লা ধুলেও সাফ হয় না’। তারা রোহিঙ্গাদের কোন সমস্যা সমাধান তো করেইনি, উল্টো তাদের সে দেশ থেকে তাড়ানোর যাবতীয় তৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে। এতে দলে দলে রোহিঙ্গা মুসলমানরা সে দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে।
×