ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিএনপি কোন্্ পথে-দলের সিনিয়র নেতারাও জানেন না

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ২১ মে ২০১৫

বিএনপি কোন্্ পথে-দলের সিনিয়র নেতারাও জানেন না

শরীফুল ইসলাম ॥ দল কোন পথে চলছে তা জানেন না বিএনপির অধিকাংশ সিনিয়র নেতারাও। এজন্য দলীয় হাইকমান্ডের কর্মকা-ের প্রতি মনে মনে ক্ষুব্ধ থাকলেও প্রকাশ্যে কিছুই বলছেন না। তবে এ নিয়ে তারা অস্বস্তিতে রয়েছেন। কোথাও কোথাও প্রশ্নের সম্মুখীনও হচ্ছেন। তাই তারা এখন দলীয় কর্মকাণ্ডে আস্তে আস্তে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ছেন। আর কেন্দ্রের এই প্রভাব তৃণমূল পর্যায়ে গিয়েও পড়ছে। এ কারণেই বিএনপির সর্বস্তরে এখন বেহাল দশা বিরাজ করছে। বিএনপির গঠনতন্ত্র অনুসারে চেয়ারপার্সন তার একক ক্ষমতাবলে যে কোন সময় যে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। তারপরও যে কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে সিনিয়র নেতাদের মোটামুটি একটি ধারণা দিতেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। কিন্তু ২০১৩ সালের শেষের দিকে সরকারবিরোধী কঠোর আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার পর থেকে খালেদা জিয়া অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার লন্ডন প্রবাসী ছেলে তারেক রহমান ছাড়া আর কারও পরামর্শ নেন না। তবে মাঝেমধ্যে জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবীদের পরামর্শ নিয়ে থাকেন। জানা যায়, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জনের আগে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া দলের সিনিয়র নেতাদের পরামর্শ নেননি। তবে তিনি ছেলে তারেক রহমান ও ২০ দলীয় জোটের শরিক দল জামায়াতের পরামর্শে নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়ে পরে তা দলের সিনিয়র নেতাদের জানিয়ে দেন। আর সিদ্ধান্ত হওয়ার পর নির্বাচন বর্জনের কথা জানলেও দলের অবস্থান খর্ব হওয়ার ভয়ে সিনিয়র নেতাদের কেউ এ বিষয়ে কোন কথা বলেননি। তবে নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে কিছু না বললেও দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রতিহত করার ব্যাপারে খালেদা জিয়া যে নির্দেশনা দেন তা বাস্তবায়নে বিএনপির সিনিয়র নেতারা সক্রিয় ছিলেন না। আর এ কারণেই নির্বাচন প্রতিহত করার ব্যাপারে হাইকমান্ড কঠোর অবস্থানে থাকলেও বিএনপি তা করতে ব্যর্থ হয়। সূত্র মতে, ৬ জানুয়ারি দেশব্যাপী টানা অবরোধ কর্মসূচী ঘোষণার আগে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া দলের সিনিয়র নেতাদের মতামত নেননি। লন্ডন থেকে দেয়া ছেলে তারেক রহমানের পরামর্শ নিয়ে কোন পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়াই তিনি হঠাৎ করে এত বড় একটি আন্দোলন কর্মসূচী ঘোষণা করে ফেলেন। শুধু টানা অবরোধ কর্মসূচী ঘোষণা করেই ক্ষান্ত হননি খালেদা জিয়া। এ কর্মসূচী চলাকালেই তিনি দফায় দফায় হরতাল ঘোষণা করেন। এ বিষয়টিকে ভাল চোখে দেখেননি বিএনপির অধিকাংশ সিনিয়র নেতা। তাই তারা এ কর্মসূচী সফল করতে রাজপথে নামা দূরে থাক কোন ভূমিকাই পালন করেননি। আর সিনিয়র নেতারা নিষ্ক্রিয় থাকায় তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরাও মাঠে নামেননি। এ কারণেই টানা ৩ মাসের আন্দোলনে বিএনপির অর্জন শূন্য। মাঝখানে নেতিবাচক হরতাল-অবরোধ কর্মসূচী চলাকালে পেট্রোলবোমাসহ নাশকতামূলক কর্মকা-ের শিকার হয়ে দেড়শ’ লোকের প্রাণহানি ও শতাধিক লোক মারাত্মক আহত হন। আগুনে পুড়ে যায় সহস্রাধিক যানবাহনসহ অনেক স্থাপনা। এতে সব কিছু মিলিয়ে দেশের ক্ষতি হয় প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা। বিএনপির এক কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ৩ মাসের আন্দোলনে দেশবাসী যে নাশকতার শিকার হয়েছে তার জবাব এখনও দলের নেতাকর্মীদের দিতে হচ্ছে। সাংগঠনিক কার্যক্রম না থাকলেও দলের নেতারা সামাজিক কোন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গেলে সাধারণ মানুষের কাছে এর কৈফিয়ত দিতে হচ্ছে। কখনও কখনও বিব্রতকর পরিস্থিতিও মোকাবেলা করতে হচ্ছে। অথচ এর আগে বিএনপি যত আন্দোলন কর্মসূচী পালন করেছে তা নিয়ে এমন বিব্রতকর পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হয়নি। সূত্র জানায়, টানা অবরোধ-হরতাল কর্মসূচী সফল না হওয়া এবং এ কর্মসূচী চলাকালে জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আরও আগেই আন্দোলনের কৌশল পরিবর্তন করতে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে পরামর্শ দিয়েছিলেন দলের সিনিয়র নেতারা। কিন্তু খালেদা জিয়া তাদের পরামর্শ উপেক্ষা করে লন্ডন প্রবাসী ছেলে তারেক রহমানের পরামর্শকে প্রাধান্য দিয়ে টানা অবরোধ ও দফায় দফায় হরতাল কর্মসূচী পালন করতে থাকলে একপর্যায়ে দলের সিনিয়র নেতারা খালেদা জিয়াকে এড়িয়ে চলতে শুরু করেন। তবে শেষ পর্যন্ত যখন গ্রেফতার হয়ে যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হন তখন গুলশানের অফিস ছেড়ে আদালতে গিয়ে হাজিরা দিয়ে বাসায় ফিরে আন্দোলনের ইতি টানেন। যদিও আন্দোলন স্থগিতের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়া হয়নি। তবে আন্দোলন স্থগিতের বিষয়েও খালেদা জিয়া দল বা জোটের সিনিয়র নেতাদের মতামত নেননি। বিএনপির সিনিয়র নেতারা মনে করেছিলেন, একক সিদ্ধান্তে খালেদা জিয়া টানা আন্দোলন স্থগিত করে বাসায় ফিরে গেলেও পড়ে সুবিধাজনক সময়ে তিনি হয়ত সবাইকে ডেকে পরিস্থিতি পর্যালোচনার সুযোগ দেবেন। কিন্তু ৫ এপ্রিল গুলশানের অফিস ছেড়ে বাসায় ফিরলেও এখনও টানা আন্দোলন থেকে সরে আসা এবং দলের ভবিষ্যত পরিকল্পনা নিয়ে খালেদা জিয়া সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে কথা বলেননি। তাই গায়ে পড়ে সিনিয়র নেতারাও এখন আর খালেদা জিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করেন না। দলীয় কর্মকা- থেকে নিজেদের দূর রাখতে একেকজন একেক রকম কৌশল নিয়েছেন। কেউ ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন, কেউ অসুস্থতাজনিত কারণে চিকিৎসা নেয়ার পাশাপাশি বিশ্রাম নিয়ে সময় কাটাচ্ছেন, আবার কেউ অবসরে থাকলেও বাসা থেকে বের হচ্ছেন না। অবশ্য কেউ কেউ এখনও পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, কেউবা বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন। সর্বশেষ ৩ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং বর্জনের ব্যাপারেও বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া দলের সিনিয়র নেতাদের কোন পরামর্শ নেননি। তবে এ ব্যাপারে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর এমাজউদ্দীন আহমেদসহ ক’জন বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবীর পরামর্শ নিয়েছেন। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর খালেদা জিয়াসহ দলের নেতারা বলতে থাকেন তাদের পক্ষে এ নির্বাচনে অংশ নেয়া সম্ভব নয়। আবার পরে বললেন এটা স্থানীয় সরকার নির্বাচন তাই এ নির্বাচন নিয়ে দলীয় সিদ্ধান্তের ব্যাপার নেই। এর পর দেখা গেল দলের নেতাদের সঙ্গে কোন কথা না বলেই বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। সিটি নির্বাচনে অংশ নেয়ার পর খালেদা জিয়া দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে বৈঠক না করে জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেন। প্রথমে এই বৃদ্ধিজীবীদের প্রার্থী মনোনয়নের দায়িত্ব দিলেও পরে ছেলে তারেক রহমানের পরামর্শে তিনি নিজেই প্রার্থী ঠিক করে দেন। এ নিয়ে দলের সিনিয়র নেতা ও জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ক্ষোভও দেখা দেয়। পরে অবশ্য খালেদা জিয়া দলের কিছু নেতাকর্মীকে সঙ্গে নিয়ে নিজেই নির্বাচনী প্রচারে মাঠে নেমে পড়েন। এতে দলের সিনিয়র নেতাদের উপস্থিতি না থাকায় খোদ দলের মধ্যেই এ নিয়ে নানান প্রশ্ন দেখা দেয়। তবে নির্বাচনে অংশ নিলেও ২৮ এপ্রিল নির্বাচনের দিন দুপুর ১২টায় নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্তও এককভাবেই নেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। তবে তিনি কৌশলে দলের ক’জন নেতাকে দিয়েই নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন। ২ মাস নিখোঁজ থাকার পর ভারতের শিলংয়ে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদকে পাওয়ার পর এ নিয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে কোন প্রতিক্রিয়া দেয়া হয়নি। বিএনপি চেয়ারপার্সনের নির্দেশ থাকায় এ নিয়ে দলের কোন নেতা ব্যক্তিগতভাবেও কিছু বলতে চান না। দলীয় হাইকমান্ডের এ সিদ্ধান্ত নিয়েও সিনিয়র নেতাদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছেন। দলীয় ফোরামে কোন আলোচনা না করেই ১৯ মে হঠাৎ করে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া যুবদলের সিনিয়র সহ-সভাপতি এ্যাডভোকেট আবদুস সালাম আজাদকে দলের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রদল সভাপতি তাইফুল ইসলাম টিপুকে সহ-দফতর সম্পাদক পদে নিয়োগ করেন। এ খবর শুনে বিএনপির অনেক সিনিয়র নেতাই হতবাক হয়েছেন বলে জানা গেছে। একই প্রক্রিয়ায় দলের আরও ক’টি শূন্য পদেও দ্রুতই ক’জন নেতাকে নিয়োগ দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে বলে জানা গেছে। এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান, জনকণ্ঠকে বলেন, দল পরিচালনায় যে কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যাপারে গঠনতন্ত্রে চেয়ারপার্সনের বিশেষ ক্ষমতা দেয়া আছে। তাই তিনি ভাল মনে করলে যে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আমাদের ডাকলে আমরা প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেয়ার চেষ্টা করি। তবে দলের পরবর্তী কর্মসূচী কি হবে তা এখন বলতে পারছি না। দলীয় ফোরামের কোন বৈঠক হলে তখন বলতে পারব। বিএনপি কোন পথে চলছে জানতে চাওয়া হলে দলটির আরেক সিনিয়র নেতা রাগত স্বরে বলেন, এ বিষয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করছেন কেন? আমি কিছু জানি না। বিএনপি চেয়ারপার্সনকে জিজ্ঞেস করেন, তিনি বলতে পারবেন।
×