ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় বিশ্বের মডেল বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ২১ মে ২০১৫

প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় বিশ্বের মডেল বাংলাদেশ

নিখিল মানখিন ॥ কমিউনিটি ক্লিনিকে সেবাগ্রহীতা ও সেবার মান বেড়েই চলেছে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় বিশ্বের মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রকল্প। ক্লিনিকের সুফল ভোগ করছে দেশের সাধারণ মানুষ। বাড়ির পাশেই বিনামূল্যে মিলছে স্বাস্থ্যসেবা। বর্তমানে প্রতিমাসে ৮০ থেকে ৯০ লাখ মানুষ কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে সেবা নেন। চালু হওয়ার পর থেকে মোট ৩৫ কোটির বেশি রোগী সেবা পেয়েছেন। রেফার করা হয়েছে প্রায় ৭০ লাখ রোগীকে। কমিউনিটি ক্লিনিকে নির্ধারিত ৩০ প্রকারের ওষুধ। বর্তমানে ৮৯৪টি কমিউনিটি ক্লিনিকে স্বাভাবিক প্রসবের ব্যবস্থা চালু হয়েছে। তিন শতাধিক নতুন কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের কাজ প্রক্রিয়াধীন। গঠন করা হয়েছে শক্তিশালী মনিটরিং টিম। মা ও শিশু স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে কমিউনিটি ক্লিনিক। প্রতিটি ক্লিনিকেই সরবরাহ করা হয়েছে ল্যাপটপ। ভবিষ্যতে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোই হবে দেশের স্বাস্থ্যসেবার পরিসংখ্যানের তথ্যভা-ার। কমিউনিটি ক্লিনিকের বার্ষিক প্রতিবেদনে এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে। অতিরিক্তি সচিব ও আরসিএইচসিআইপি প্রকল্পের পরিচালক ডাঃ মাখদুমা নার্গিস জনকণ্ঠকে জানান, কমিউনিটি ক্লিনিক বর্তমান সরকারের অগ্রাধিকারভিত্তিক একটি কার্যক্রম। এটি গ্রামীণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। দেশের জনগণ এখন ক্লিনিকের কার্যক্রমে খুশি। তারা এখন অনুধাবন করতে পেরেছেন যেÑ তারাই কমিউনিটি ক্লিনিকের মালিক, এগুলো তাদের জায়গায় স্থাপিত, তারা এখান থেকে সেবা নিচ্ছেন এবং তারাই কমিউনিটি সাপোর্ট গ্রুপের মাধ্যমে এগুলো পরিচালনা করছেন। বর্তমানে ১২ হাজার ৮শ’র বেশি কমিউনিটি ক্লিনিক চলছে এবং পল্লীর জনগণ বিশেষ করে দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিতরা তাদের দোরগোড়ায় স্থাপিত কমিউনিটি ক্লিনিক হতে সেবা নিচ্ছেন। ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৩৫ কোটির বেশি মানুষ সেবা গ্রহণ করেছে এবং ৭০ লাখের বেশি জরুরী ও জটিল রোগীকে উচ্চতর পর্যায়ে রেফার করা হয়েছে। স্বাস্থ্য শিক্ষা, স্বাস্থ্যের উন্নয়ন, সাধারণ সমস্যা ও জখমের চিকিৎসা, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, নির্ণয় ও রেফার ইত্যাদি কমিউনিটি ক্লিনিকের উল্লেখযোগ্য সেবা। প্রায় ৯শ’ ক্লিনিকে স্বাভাবিক প্রসব পরিচালিত হচ্ছে। কমিউনিটি ক্লিনিক আজ জনগণের নিকট একটি নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান বলে জানান ডাঃ মাখদুমা নার্গিস। কিভাবে, কী ধরনের সেবা দেয়া হয় ॥ কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্পের কর্মকর্তারা দাবি করেন, কমিউনিটি ক্লিনিক কার্যক্রম এবং সেবাদানকারীদের করণীয় সম্পর্কে নির্দেশিকা সম্পন্ন করে প্রতিটি কমিউনিটি ক্লিনিকে পৌঁছে দিয়েছে সরকার। নির্দেশিকায় টানানো থাকায় চিকিৎসা ও ওষুধ নিয়ে অবৈধ কাজ করার সুযোগ থাকছে না। কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডারদের (সিএইচসিপি) শুক্রবার এবং সরকারী ছুটিন দিন ব্যতীত প্রতিদিন কমিউনিটি ক্লিনিকে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত উপস্থিত থাকতে হয়। প্রশিক্ষণ পাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত স্বাস্থ্য সহকারী এবং এফডব্লিউএ-এর কাজে সহায়তা করেন। হেলথ কেয়ার প্রোভাইডাররা ক্লিনিক খোলা এবং বন্ধ করা, রোগীর উপস্থিতি রেজিস্টারে নাম তোলা, পরিষ্কারপরিচ্ছন্ন নিশ্চিত করাসহ তাদের কর্মপরিধির আওতাধীন এই মুহূর্তে যে সকল কর্মকা- পরিচালনা করা সম্ভব তা করেন। কমিউনিটি গ্রুপের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন। সার্বিক প্রজনন স্বাস্থ্য পরিচর্যার আওতায় অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের প্রসব পূর্ব (প্রতিষেধক টিকাদান) এবং প্রসব পরবর্তী (নবজাতকের সেবা) সেবা দেন। সময়মতো প্রতিষেধক টিকাদান (যক্ষ্মা, ডিপথেরিয়া, হুপিং কফ, পোলিও, ধনুষ্টংকার, হাম, হেপাটাইটিস-বি, নিউমোনিয়া) শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের জন্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা দেয়া হয়। জনগণের জন্য বিশেষ মহিলা ও শিশুদের অপুষ্টি দূরীকরণের জন্য ফলপ্রসূ ব্যবস্থা গ্রহণ ও সেবা প্রদান করা হয়। ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মা, কুষ্ঠ, কালাজ্বর, ডায়রিয়াসহ সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা এবং সেগুলোর সীমিত চিকিৎসা সুবিধা রয়েছে। সাধারণ জখম, জ্বর, ব্যথা, কাটা-পোড়া, দংশন, বিষক্রিয়া হাঁপানি চর্মরোগ, ক্রিমি এবং চোখ, দাঁত ও কানের সাধারণ রোগের ক্ষেত্রে লক্ষণভিত্তিক প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান করা হয়। অস্থায়ী পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি সংক্রান্ত বিভিন্ন উপকরণ, যেমনÑকনডম, পিল, ইসিপি সর্বক্ষণিক সরবরাহ ও বিতরণ নিশ্চিত করা হয়। জটিল রোগীদের প্রয়োজনীয় প্রাথমিক সেবা প্রদান করে দ্রুত উচ্চতর পর্যায়ে রেফার করা হয়। সদ্য বিবাহিত ও অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের নিবন্ধীকরণ ও সম্ভাব্য প্রসব তারিখ সংরক্ষণ করতে হয়। মহিলা ও কিশোর-কিশোরীদের রক্তস্বল্পতা শনাক্ত এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা প্রদান করতে হয়। প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ এবং ব্যবস্থাদি থাকা সাপেক্ষে স্বাভাবিক প্রসব পরিচালনা করা হয়। কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার ওষুধপত্র ও এমএসআরসহ আবশ্যক দ্রব্যাদির প্রয়োজনীয়তা নির্ণয় করেন। ওষুধপত্র ও এমএসআর সংগ্রহের জন্য ইউনিয়ন মেডিক্যাল অফিসারের মাধ্যমে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা এবং পরিবার কল্যাণ সামগ্রী প্রদানের জন্য উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা বরাবর ইনডেন্ট প্রদান করে থাকেন। যে সব গর্ভবতী মহিলা কমিউনিটি ক্লিনিক হতে প্রসবপূর্ব ও প্রসবোত্তর সেবা গ্রহণ করেননি এবং যে সব নারী/ পুরুষ ইপিআই, যক্ষ্মা, কুষ্ঠ বিষয়ে কমিউনিটি ক্লিনিক হতে সেবা গ্রহণ করেননি, স্বাস্থ্য সহকারী ও পরিবার কল্যাণ সহকারীরা তাদের খুঁজে বের করে কমিউনিটি ক্লিনিকের সেবা ব্যবস্থায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন। কিন্তু এই নির্দেশিকা অনুযায়ী কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো পরিচালিত হয় না। কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্পের কার্যক্রম আরও গতিশীল করতে নতুন আইন প্রণয়ন করতে যাচ্ছে সরকার। আইনটির নাম দেয়া হয়েছে ‘কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্ট আইন-২০১৪’। ইতোমধ্যে প্রস্তুত করা হয়েছে আইটির খসড়া। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নিকট হতে অর্থ সংগ্রহ ও ব্যবহারের মাধ্যমে কমিউনিটি ক্লিনিক পরিচালনায় সহায়তা করাই আইনটির মূল উদ্দেশ্য। স্থানীয় জনসাধারণের মধ্যে অংশীদারিত্বমূলক মনোভাব তৈরির লক্ষ্যে স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়নে তাদের পরামর্শ/ মতামতের ভিত্তিতে ট্রাস্টের তহবিল থেকে আর্থিক সাহায্য / মঞ্জুরি প্রদানের ব্যবস্থা থাকবে। বিশেষ ক্ষেত্রে অতিদরিদ্র রোগীর উন্নত চিকিৎসার জন্য উচ্চতর পর্যায়ে প্রেরণের ব্যয় নির্বাহ করাও আইনটির অন্যতম উদ্দেশ্য। আইন প্রণয়ন ॥ কমিউনিটি ক্লিনিকের কার্য়ক্রম আরও গতিশীল করতে আইন প্রণয়ন করতে যাচ্ছে সরকার। খসড়া আইনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের গ্রামীণ সুবিধাবঞ্চিত জনগণের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করতে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সহায়তা চাওয়া হবে। কমিউনিটি ক্লিনিকে বেসরকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের অংশীদারিত্ব তৈরি করা সমীচীন ও প্রয়োজনীয়। এই আইন বলবৎ হওয়ার পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সরকার এই আইনের বিধান অনুযায়ী কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্ট নামে একটি ট্রাস্ট স্থাপন করবে। সরকারের উন্নয়ন বা অনুন্নয়ন বাজেটের বাইরে বিশেষ প্রয়োজনে গ্রামীণ সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর সমন্বিত প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য এই ট্রাস্টের তহবিল ব্যবহার করা হবে। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে উন্নত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা হবে এবং কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর সমন্বিত প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকে আরও টেকসই করা হবে। স্থানীয় জনসাধারণের মধ্যে অংশীদারিত্বমূলক মনোভাব তৈরির লক্ষ্যে স্বাস্থ্যসেবা মান উন্নয়নে তাদের পরামর্শ/ মতামতের ভিত্তিতে ট্রাস্টের তহবিল থেকে আর্থিক সাহায্য / মঞ্জুরি প্রদানের ব্যবস্থা থাকবে। ক্লিনিক মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয়সহ বিদ্যুত বিল প্রদান ও অন্যান্য ব্যয় নির্বাহের জন্য ট্রাস্টের তহবিল ব্যবহার করা হবে। সমন্বিত প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানসহ মাতৃস্বাস্থ্যসেবা প্রদানের লক্ষ্যে এমএসআর সামগ্রী ক্রয়ের জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হবে। বিশেষ ক্ষেত্রে অতিদরিদ্র রোগীর উন্নত চিকিৎসার জন্য উচ্চতর পর্যায়ে প্রেরণের ব্যয় নির্বাহ করাও আইনটির অন্যতম উদ্দেশ্য। খসড়া আইনে আরও বলা হয়েছে, যে সব উৎস থেকে সহায়তা নেয়া যাবে- সরকার কর্তৃক প্রদত্ত জাতীয় বাজেট হতে প্রাপ্ত অর্থ, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক দান ও অনুদান, বিভিন্ন অর্থ লগ্নীকারী প্রতিষ্ঠানের (ব্যাংক, বীমা) আর্থিক সহায়তা, প্রবাসীদের আর্থিক সহায়তা, সরকার অনুমোদিত দাতা দেশ, সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান হতে প্রাপ্ত অর্থ, সরকার অনুমোদিত দেশী ও বিদেশী উৎস হতে প্রাপ্ত অর্থ এবং সমাজের বিত্তবান, শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের নিকট হতে প্রাপ্ত অনুদান।
×