ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

চার্জ ১ : ৩৯ জনকে আটক করে ২৪ জনকে হত্যা- আমৃত্যু কারাদণ্ড;###;চার্জ ২ : লুট অগ্নিসংযোগ- ৫ বছরের কারাদণ্ড;###;চার্জ ৩ : গ্রহণ করা হয়নি

ট্রাইব্যুনালের অষ্টাদশ রায় ॥ চাঁপাইয়ের মাহিদুর ও চুটুর আমৃত্যু কারাদণ্ড

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ২১ মে ২০১৫

ট্রাইব্যুনালের অষ্টাদশ রায় ॥ চাঁপাইয়ের মাহিদুর ও চুটুর আমৃত্যু কারাদণ্ড

বিকাশ দত্ত ॥ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের মাহিদুর রহমান এবং আফসার হোসেন চুটুকে আমৃত্যু কারাদ- প্রদান করেছে ট্রাইব্যুনাল। স্বাভাবিক মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত তাদের কারাগারে থাকতে হবে। চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান শাহীনের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ বুধবার এ মামলার রায় ঘোষণা করে। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য ছিলেন বিচারপতি বিচারপতি মোঃ মুজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মোঃ শাহিনুর ইসলাম। এটি হবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের অষ্টাদশ রায়। ট্রাইব্যুনাল-২ এ হবে এটি দশম রায়। এর আগে ট্রাইব্যুনাল-২ নয়টি ও ট্রাইব্যুনাল-১ আটটি রায় প্রদান করেছে। মাহিদুর রহমান এবং আফসার হোসেন চুটুর মামলা ২২ এপ্রিল বিচারিক প্রক্রিয়া শেষ হওয়ায় রায় ঘোষণা অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখেন ট্রাইব্যুনাল। এদিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ কিশোরগজ্ঞের রাজাকার কমান্ডার পলাতক সৈয়দ মোঃ হাসান আলী ওরফে হাছেন আলীর মামলা বিচারিক কার্যক্রম শেষে রায় ঘোষণার জন্য সিএভি রাখা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট মামলার প্রসিকিউটরগণ আশা করছেন এ মামলার রায়ও দ্রুত ঘোষণা করা হতে পারে। রায় ঘোষণার সময় দুই আসামি মাহিদুর ও চুটু ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত ছিলেন। এদিকে রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে ট্রাইব্যুনালের বাইরে ও ভেতরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। সকাল সোয়া ১১টার কিছু পরে আদালত কক্ষে এসে রায়ের সংক্ষিপ্ত অংশ পড়া শুরু করেন চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান শাহীন। মাত্র ১৮ মিনিটের মধ্যে রায় ঘোষণা করা হয়। দ্বিতীয় অভিযোগ থেকে আসামিদের এক জন সদস্য খালাস দিয়েছেন এই বলে যে, উভয়পক্ষের প্রমাণাদি বিবেচনায় নিয়ে মনে হয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ এই অভিযোগটি প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছে। পরে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে রায় দেয়া হয়। তৃতীয় অভিযোগে আগে থেকেই দালাল আইনে আসামিদ্বয় সাজা ভোগ করায় ওই অভিযোগটিতে কোনও সাজা দেয়া হয়নি। তৃতীয় অভিযোগের বিষয়ে আগে থেকে তদন্ত কর্মকর্তা অবহিত না করায় ট্রাইব্যুনাল রায়ের পর্যবেক্ষণে তদন্ত কর্মকর্তা জেড এম আলতুফুর রহমানকে অদক্ষ উল্লেখ করেন। মাহিদুর রহমান ও আফসার হোসেন চুটুর আমৃত্যু কারাদ- হওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন প্রসিকিউটর। অপরদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী আব্দুস সোবহান তরফদার বলেন, তদন্ত সংস্থার তদন্তে যে দুর্বলতা ছিল এবং কর্মকর্তা যে একটি অথর্ব তদন্ত করেছেন তার কথা তো আদালতই বলেছেন। আমি আর কি বলব। তবে রায়ের কপি পাওয়ার পরে আপীল করবেন বলে জানিয়েছেন। আপীলেই সে বিষয়টি তুলে ধরা হবে। বুধবার ট্রাইব্যুনাল-২ এই মামলায় রায় ঘোষণার পর সাংবাদিকদেরকে সঙ্গে এক ব্রিফিংয়ে রাষ্ট্র এবং আসামি উভয় পক্ষের আইনজীবীরা এসব কথা বলেন। প্রসিকিউটর সাহিদুর রহমান বলেন, আদালত তাদেরকে আমৃত্যু কারাদ- দিয়েছেন। এই রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। ট্রাইব্যুনাল তার রায়ে বলেছে, আসামিদের বিরুদ্ধে আনীত তিন নম্বর অভিযোগে ইতিপূর্বে দালাল আইনে তাদের বিচার করা হয়েছে। সুতরাং এই আদালতে তাদেরকে এই অভিযোগে কোন সাজা দেয়া হলো না। একই সঙ্গে এই অভিযোগে শাস্তি হওয়ার পরও সেটি পুনরায় ট্রাইব্যুনালে নিয়ে আসার জন্য তদন্তকারী কর্মকর্তা ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন বলেও রায়ে উল্লেখ করেছে আদালত। রায়ের পর আসামিপক্ষের আইনজীবী আব্দুস সোবহান তরফদার বলেন, তিন নম্বর অভিযোগে তদন্তকারী কর্মকর্তার যে দুর্বলতা ছিল, অপর অভিযোগগুলোতেও সে দুর্বলতা রয়েছে। আমরা আপীল করব এবং উচ্চ আদালতে তদন্তকারীকারী কর্মকর্তার দুর্বলতাগুলো তুলে ধরব। অন্যদিকে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অমৃত্যু কারাদ- প্রাপ্ত রাজাকার মাহিদুর রহমান এবং আফসার হোসেন চুটুর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা (আইওর) কোন ধরনের অদক্ষতা বা গাফিলতি আছে কি না তা খতিয়ে দেখার কথা বলেছেন তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক আবদুল হান্নান খান। তিনি বলেন, তদন্ত সংস্থার বিভিন্ন সমস্যার মধ্য দিয়ে আমাদের তদন্ত কাজ সম্পন্ন করতে হয়। যেহেতু ঘটনা অনেক বছর আগের তাই মামলার তদন্ত করতে গিয়ে নথিপত্র সংগ্রহ করতে আমাদের সমস্যা পড়তে হয়। তদন্ত করতে গিয়ে আমরা দেখেছি মামলা সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় কাগজপত্র যেখানে থাকার কথা সেখানে পাওয়া যায়নি। অনেক জায়গায় সংরক্ষণই করা হয়নি। এসব সমস্যা মোকাবেলা করতে হয়েছে। সার্বিকভাবে এ রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে তিনি বলেন, একই তদন্ত কর্মকর্তা এর আগে আরও দুটি মামলায় সফলভাবে করেছেন। তারপরও এই মামলার তদন্তে কোন গাফিলতি, অদক্ষতা আছে কি না তা আমরা খতিয়ে দেখব। এদিকে ট্রাইব্যুনালের আদেশের পর প্রসিকিউটর রাজিয়া সুলতান বেগম চমন জনকণ্ঠকে বলেছেন, আমরা পুরো রায় পড়ে দেখব আপীল করব কি না। তবে রায়ে আমরা খুশি। অন্যদিকে আমৃত্যু কারাদ-প্রাপ্ত চাঁপাইনবাবগঞ্জের রাজাকার মাহিদুর রহমান ও আফসার হোসেন চুটুর ফাঁসির দাবিতে শাহবাগে বিক্ষোভ মিছিল করেছে গণজাগরণ মঞ্চ। বুধবার সকাল সাড়ে ১১টার দিকে শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরের সামনে ‘প্রজন্ম চত্বরে’ মিছিলটির আয়োজন করা হয়। মিছিলে নেতৃত্ব দেন গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার। ১৮তম রায় ॥ ২০১০ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর এ পর্যন্ত ১৮টি মামলার রায় হয়েছে। তার মধ্যে ১৯ জনকে দ- প্রদান করা হয়েছে। যাদের দ- দেয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে রয়েছেন জামায়াতের সাবেক রুকন বাচ্চু রাজাকার হিসেবে পরিচিত আবুল কালাম আযাদ (মৃত্যুদ-), জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লা (আমৃত্যু কারাদ- (আপীলে মৃত্যুদ-, পরবর্তীতে রায় কার্যকর), জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী (মৃত্যুদ-) আপীলে আমৃত্যু কারাদ-, জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামান (মৃত্যুদ-) আপীল বিভাগেও মৃত্যুদ- বহাল, পরবর্তীতে রায় কার্যকর। জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম (৯০ বছরের কারাদ-) অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ, জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ (মৃত্যুদ-), বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী (মৃত্যুদ-), বিএনপির সাবেক মন্ত্রী আব্দুল আলীম (আমৃত্যু করাদ-) অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ, বদর বাহিনীর নেতা চৌধুরী মাঈনুদ্দিন এবং মোঃ আশরাফুজ্জামান খান (মৃত্যুদ-), জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামী (মৃত্যুদ-), জামায়াতে ইসলামীর নির্বাহী কমিটির সদস্য মীর কাশেম আলী (মৃত্যুদ-), বিএনপি নেতা নগরকান্দা পৌর মেয়র জাহিদ হোসেন খোকন ওরফে খোকন রাজাকার (মৃত্যুদ-), আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত মোঃ মোবারক হোসেন (মৃত্যুদ-), জাতীয় পার্টির সাবেক মন্ত্রী কায়সার বাহিনীর প্রধান সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সার (মৃত্যুদ-), জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজাহারুল ইসলাম (মৃত্যুদ-) জামায়াতের নায়েবে আমির আব্দুস সুবহান (মৃত্যুদ-) ও জাতীয় পার্টির আব্দুল জব্বার (আমৃত্যু কারাদ-)। মামলার কার্যক্রম ॥ ২০১৫ সালের ২২ এপ্রিল মাহিদুর-আফসারের পক্ষে যুক্তিতর্ক (আর্গুমেন্ট) উপস্থাপন করেন তাদের আইনজীবী আব্দুস সোবহান তরফদার। অন্যদিকে গত ১৫ ও ২০ এপ্রিল মাহিদুর-আফসারের বিরুদ্ধে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন প্রসিকিউটর সাহিদুর রহমান। গত ১২ জানুয়ারি মাহিদুর-আফসারের বিরুদ্ধে সূচনা বক্তব্য (ওপেনিং স্টেটমেন্ট) উপস্থাপন করেন প্রসিকিউটর সাহিদুর রহমান। ২০১৪ সালের ১১ ডিসেম্বর তিনটি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে মাহিদুর রহমান ও মো. আফসার হোসেন চুটুর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল। এর আগে ১ ডিসেম্বর অভিযোগ গঠনের পক্ষে প্রসিকিউটর সাহিদুর রহমান ও বিপক্ষে শুনানি করেন তাদের আইনজীবী মিজানুল ইসলাম। ২০১৪ সালের ২৪ নবেম্বর মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে (শ্যোন এ্যারেস্ট) মাহিদুর-আফসারের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) আমলে নেয় ট্রাইব্যুনাল। ১৬ নভেম্বর এ আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করেন প্রসিকিউটর সাহিদুর রহমান। এ দু’জনের বিরুদ্ধে গত বছরের ২৭ অক্টোবর তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেন তদন্ত সংস্থা। পরদিন ২৮ অক্টোবর তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রসিকিউশনের কাছে জমা দেয়া হয়। এর ভিত্তিতে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ তৈরি করে ট্রাইব্যুনালে দাখিল করেন প্রসিকিউশন। প্রথম মামলা করেন বদিউর রহমান বুদু ॥ এ মামলার তদন্ত শুরু হয় ২০১৪ সালের ১১ ফেব্রুয়াির। তদন্ত শেষে ৭ খ-ে ৯৫৬ পৃষ্ঠার চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে শিবগঞ্জ উপজেলার বিনোদপুর স্কুল মাঠে ও এর আশপাশে সংঘটিত গণহত্যার ঘটনায় ২০১৩ সালে মাহিদুর রহমান ও আফসার হোসেন চুটুসহ ১২ জনকে আসামি করে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আদালতে একটি মামলা হয়। মামলাটি করেন গণহত্যার শিকার শহীদ পরিবারের সদস্য শিবগঞ্জ উপজেলার মনাকষা ইউনিয়নের পারচৌকা গ্রামের বদিউর রহমান বুদু। গত বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর গভীর রাতে শিবগঞ্জ উপজেলার দুর্লভপুর ইউনিয়নের দাদনচক গ্রামের মাহিদুর রহমান ও বিনোদপুর ইউনিয়নের সাতরশিয়া গ্রামের আফসার হোসেন চুটুকে যার যার বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
×