ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

হয়রানি ও অনিয়মের অভিযোগ

পাঠ্যবই না ছাপার হুমকি দেশের মুদ্রাকরদের

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ২০ মে ২০১৫

পাঠ্যবই না ছাপার হুমকি দেশের মুদ্রাকরদের

স্টাফ রিপোর্টার ॥ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের হয়রানি ও অনিয়মের কারণে আগামী শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবই না ছাপার হুমকি দিয়েছে দেশের মুদ্রাকররা। একই সঙ্গে তারা অভিযোগ করেছেন, সরকারের বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণে বিশাল অর্জনকে নস্যাত করতে অধিদফতরের একটি বিশেষ মহল তৎপর হয়ে উঠেছে। এদিকে, প্রায় একই ধরনের অভিযোগ করেছেন পাঠ্যবই মুদ্রণের দায়িত্বে থাকা ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) কর্মকর্তারাও। মঙ্গলবার মতিঝিল এনসিটিবি ভবনে আয়োজিত এক ‘প্রি-বিড মিটিং’য়ে এ অভিযোগ করেন তারা। এনসিটিবির চেয়ারম্যান প্রফেসর নারায়ণ চন্দ্র পালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাবেক ও বর্তমান নেতাকর্মী, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের প্রতিনিধি এবং এনসিটিবির কর্মকর্তারা বক্তব্য রাখেন। সভায় তোপের মুখে ছিলেন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের প্রতিনিধি নবী উল্লাহ নবী। সভার শুরুতে মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাবেক সভাপতি তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘লাগাতার হরতাল ও অবরোধের মধ্যে কী কষ্ট, কী পরিশ্রম করে আমরা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সারাদেশে পাঠ্যবই পৌঁছে দিয়েছি, তা দেশের মানুষ জানে। অথচ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর ও ডিপিই আমাদের ২০ শতাংশ বিল আটকে রেখে ব্যাংক ইন্টারেস্ট খাচ্ছে। আর আমরা ব্যাংক ঋণের সুদ টানতে টানতে দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছি।’ তিনি বলেন, ‘প্রিন্টার্সদের বিল পরিশোধ না করলে আগামীকালের (২১ মে) দরপত্রে দেশের কোন মুদ্রাকর অংশ নেবে না।’ এ সময় তোফায়েল আহমেদের বক্তব্যকে সমর্থন করে এনসিটিবির এক কর্মকর্তা বলেন, ‘২০ শতাংশ বিল ব্যাংকে থাকায় যে ইন্টারেস্ট হচ্ছে তা কারা নিচ্ছে- এটা খুঁজে বের করা দরকার। পাঁচ মাসেও বিডাররা (ঠিকাদার) কেন বিল পাবে না? মন্ত্রণালয় ও ডিপিই’র কোন না কোন চক্র এই বিল আটকে রেখেছে, সরকারের এই মহতি উদ্যোগকে নষ্ট করতে।’ মুদ্রণ শিল্প সমিতির নেতারা বলেন, ‘বই মুদ্রণের দরপত্র আহ্বান করে এনসিটিবি। কিন্তু বিল পরিশোধের দায়িত্ব ডিপিই’র কাছে কেন? এ দায়িত্বও এনসিটিবির কাছে থাকা উচিত। বিল পরিশোধের ক্ষমতা পেয়ে ডিপিই’র কর্মকর্তারা সীমাহীন দুর্নীতি ও ঘুষপ্রীতিতে লিপ্ত হয়েছে।’ মুদ্রণ শিল্প সমিতির সভাপতি শহীদ সেরনিয়াবাত প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের সমালোচনা করে বলেন, ‘ডিজি অফিসের লোকদের কথা শুনলে মনে হয়- তাদের সঙ্গে আমাদের ক্রেতা-বিক্রেতার সম্পর্ক। আমি স্ত্রীর গহনা, ফ্ল্যাট ব্যাংকে বন্ধক দিয়ে সরকারের পাঠ্যবই ছেপে সরবরাহ করেছি। অথচ বিল পরিশোধ করা হচ্ছে না। বিল ব্যাংকে আটকে রেখে সুদ খাচ্ছে একটি চক্র। আর আমরা সর্বস্ব হারিয়ে দেউলিয়া হওয়ার পথে।’ বিএনপি-জামায়াত জোটের লাগাতার নাশকতার মধ্যে গেরিলা কায়দায় পাঠ্যবই সরবরাহ করা হয়েছে উল্লেখ করে শহীদ সেরনিয়াবাত বলেন, ‘জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বই দিয়েছি। সরকারের ধন্যবাদটুকু পর্যন্ত পায়নি। দুর্নীতিবাজ ও সরকারবিরোধী চক্র ডিপিইকে ঘিরে রেখেছে।’ তিনি বলেন, ‘এনসিটিবির ঘাড়ে বন্দুক রেখে ফাঁয়দা লুটছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের দুর্নীতিবাজ চক্র। আমরা কাজ করেছি ১০০ ভাগ, বিল পেয়েছি ৮০ ভাগ। এই নিপীড়ন ও নির্যাতন বন্ধ না করলে আগামী দরপত্রে আমরা অংশ নেব না।’ তিনি এই অনিয়ম ও হয়রানি বন্ধে প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন। সভার এক পর্যায়ে তোপের মুখে পড়েন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি উপসচিব নূজাত জাহান। তিনি বলেন, ‘বই মুদ্রণের পুরো কাজটি পিইডিপি-৩ এর (প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচী) অধীনে। বই মুদ্রণের ১০ ভাগ টাকা দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক। কাজেই তাদের কিছু নিয়মকানুন আমাদের মানতে হয়। মুদ্রাকরদেরও তা মানতে হবে।’ এ সময় মুদ্রাকররা দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করতে থাকেন। মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাবেক নেতা ও আনন্দ প্রিন্টার্সের স্বত্বাধিকারী রাব্বানী জব্বার বলেন, ‘দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বিল পাচ্ছে না। অথচ বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলোকে তিন মাস আগেই বিল পরিশোধ করা হয়েছে।’ তিনি ডিজি অফিসের কর্মকা-ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘বই ছাপার সময় প্রতিদিনই আমাদের কার্যক্রম মনিটরিং করেছে ডিপিই ও এনসিটিবি। এখন চার মাস পর এসে বলা হচ্ছে, এটি ভাল না, ওটি ভাল না।’ তিনি আরও বলেন, ৩৩ কোটি বইয়ের মধ্যে কেবল প্রাথমিকের বই নিয়ে আমাদের হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। বাকি ২২-২৩ কোটি বই নিয়ে তো কোন হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে না। এখানেই পরিষ্কার প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের কারণেই আমাদের আজকের সঙ্কটের মুখে পড়তে হয়েছে। এক পর্যায়ে এনসিটিবির সদস্য প্রফেসর সরকার আব্দুল মান্নান বলেন, ‘প্রিন্টার্সদের ফাঁদে ফেলার সব আইনী বিধিবিধান প্রত্যাহার করা দরকার। তাদের অযথা হয়রানি করা উচিত নয়।’ এনসিটিবির অপর সদস্য প্রফেসর রতন সিদ্দিকী বলেন, ‘অনেক সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে, যা যৌক্তিক হয়নি। বিনামূল্যে বই বিতরণ সরকারের অনেক সফল প্রজেক্টের মধ্যে একটি। এটিকে কোনক্রমেই নষ্ট করা যাবে না।’
×