ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নিত্য লড়াইয়ে শেখ হাসিনা

প্রকাশিত: ০৩:৪১, ২০ মে ২০১৫

নিত্য লড়াইয়ে শেখ হাসিনা

স্বদেশে, প্রিয় মাতৃভূমিতে প্রত্যাবর্তনের পর শেখ হাসিনাকে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হয়েছে ও হচ্ছে। একদিকে বিএনপি-জামায়াতের মৌলবাদী জঙ্গী তৎপরতা ও প্রবল বিরোধিতা; অন্যদিকে প্রশাসন ও নিজ দলের একাংশের পাকিস্তানী ও হেজাবী মনোভাব- এসবই মোকাবেলা করতে হচ্ছে তাঁকে। এর পাশাপাশি সচল রাখতে হচ্ছে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন। ঘরে-বাইরে শত বাধা-বিঘœ, শত প্রতিকূলতা অতিক্রম করে তবেই তিনি সফল। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মৌলিকত্ব তিনি ফিরিয়ে এনেছেন। তাই বলে এখানেই থেমে থাকলে চলবে না। সাফল্য ও অর্জন যেন তাঁকে আচ্ছন্ন না করে। আগামীতে তাঁকে আরও লড়াই চালিয়ে যেতে হবে, নিরন্তর। ১৯ মে’র চতুরঙ্গ পাতার পর আজ পড়ুন শেষ কিস্তি ... কিন্তু এই রাষ্ট্র গঠন হয়েছিল বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে। এ রাষ্ট্র যখন তার মৌলিকত্ব হারাচ্ছিল এবং রাষ্ট্র ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছিল, তখন শেখ হাসিনা সেই রাষ্ট্রের মৌলিকত্ব ফিরিয়ে এনেছেন অনেকটা এবং ব্যর্থ রাষ্ট্র থেকে তা সম্ভাবনাময় রাষ্ট্রে পরিণত করার কৃতিত্বও আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার। এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও মতৈক্য হয়েছে। যে কারণে বিএনপি-জামায়াতের এক সময়ের মিত্র বিজেপিও শেখ হাসিনার সঙ্গে কংগ্রেস নেতাদের চুক্তি মেনে নিয়েছেন। অথচ, নরেন্দ্র মোদির বিজয়ের পর বিএনপি-জামায়াতীরা মিষ্টির দোকান খালি করে দিয়েছিল। বিএনপি যে নষ্ট রাজনীতির প্রতীক তার সর্বশেষ উদাহরণ ছিটমহল চুক্তি ভারতীয় সংসদে পাস হওয়ার পর খালেদা জিয়া মোদিকে অভিনন্দন জানালেন এবং হাসিনাকে ভারতের দালাল বললেন। কী রাজনীতি! এই বেগমকে কেউ বুঝিয়ে বলেনি, দালালি যদি করতেই হয় তা হলে বিজয়ী ও সফল রাষ্ট্রের দালালি করাটাই ইতিবাচক বা বুদ্ধিমানের কাজ। আর শেখ হাসিনাকে যখন দালাল বলছেন, তখন সেই প্রভুকে এত তোয়াজ করছেন কেন? দালালি পাওয়ার জন্য? কিন্তু যিনি পরিচিত আজীবন পরাজিত ব্যর্থ ও নষ্ট রাষ্ট্রের দালালই শুধু নয় প্রতিনিধি হিসেবে তিনি যখন অন্য কাউকে একই অভিধায় ভূষিত করেন তখন বোঝা যায় চারদিকে ভূমি হারাচ্ছেন তিনি। নষ্ট চরিত্রের মানুষই নষ্ট পরাজিত পশ্চাৎপদ ব্যর্থ হিংস্র রাষ্ট্রের পদলেহন করে। সেই আদর্শ এ দেশে প্রোথিত করতে চায়। এই নষ্টামি, পাকিস্তানী মানসের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনা যে লড়াই শুরু করেছিলেন, তা এখনও শেষ হয়নি। সেটি চালাতে হবে অবিরাম, চলবে। নিরন্তর লড়াইয়ের ফলেই আজ শত্রুর বিষদাঁত ভেঙ্গেছে মাত্র। মরেনি সে। তাই লড়াই চলবে। সংখ্যাগরিষ্ঠ যখন ১৯৭১-এর মতো মনে করবে লড়াইটা সঠিক, লড়াইটা পাকিস্তানী বাঙালীদের নষ্টামির বিরুদ্ধে, হেজাবীদের ভ-ামির বিরুদ্ধে তখনই আমরা খানিকটা বিশ্রাম নিতে পারব এই ভেবে যে, আমরা লক্ষ্য অর্জন করেছি। কিন্তু এ প্রসঙ্গে একটি কথা বলা জরুরী। বার বারই তা বলে আসছি। এবার তিনটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে যে ফলাফল তা আমাদের হতাশ করেছে। এতো সন্ত্রাস, হত্যার পরও পাকিস্তানী বাঙালীরা যে ভোট পেয়েছে তা শঙ্কার কারণ। শেখ হাসিনা বা তার সরকারের এত অর্জনও মাইন্ডসেট পরিবর্তন করতে পারেনি। এর অন্য অর্থ, খালেদা-নিজামী রাজনৈতিক অর্থে জিতেছেন। গত তিন দশকে তারা বাংলাদেশের ৩৫ ভাগ মানুষের মগজে পাকিস্তান গেঁথে দিতে পেরেছেন। বাকি ৫০ ভাগের মধ্যে পাকিস্তান ভালবাসা না থাকলেও হেজাবী মনোভাবটুকু কিছু না কিছু রয়ে গেছে। শেখ হাসিনা যে কারণে লড়াই করে যাচ্ছেন অন্তিমে কী তা হলে ফলদায়ক হবে? উন্নয়ন ভোটের জন্য জরুরী। কিন্তু উন্নয়নের সঙ্গে শিক্ষা-সংস্কৃতির উন্নয়নও দরকার। না হলে শেখ হাসিনার যে সাফল্য তা অনুধাবনেও তারা ব্যর্থ হবে। বর্তমান সরকার উন্নয়নের ওপর সমধিক গুরুত্ব আরোপ করেছে তা স্বাভাবিক। কিন্তু জিডিপির উন্নয়ন মানে সব মানুষের উন্নয়ন নয়। হলে, হাজার হাজার মানুষ এখন অভিবাসী হওয়ার জন্য সাগরে ভেসে বেড়াত না। স্রোতের মতো মানুষ দেশ ত্যাগ করতে চাইছে। এ বিষয়টাও কিন্তু ভেবে দেখা দরকার। রাজনৈতিকভাবে শেখ হাসিনার রাজনীতি বা বাঙালিত্বের লড়াইয়ের বিষয়টা নতুন জেনারেশনের মনে প্রোথিত করতে হবে। মনোজগতে আধিপত্য বিস্তার করতে হবে। আমরা বার বার বলছি, যে শিক্ষা নিয়ে সবাই বলছে সফলতা আসছে, তা ঠিক নয়। আমরা যা বলি তা সঠিক নয় বা জানি না এই দৃষ্টিভঙ্গি কিন্তু সুস্থ রাজনীতির অন্তর্গত নয়। ২০১৫ সালে যে হিউম্যান ক্যাপিটাল রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে, তাতে কিন্তু আমাদের বক্তব্যেরই প্রতিফলন ঘটেছে। রিপোর্ট অনুসারে শিক্ষিত ও দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টিতে বাংলাদেশের অবস্থান ১২৪টি দেশের মধ্যে ৯৯তম। ভুটানের পরই বাংলাদেশের স্থান। নিম্ন আয়ের দেশের মধ্যে কম্বোডিয়া ও তাজিকিস্তানের পর বাংলাদেশের অবস্থান। রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশের ৮২ ভাগ মানুষ যারা কাজ করেন তাদের বয়স ২৪ থেকে ৫৪-এর মধ্যে। এদের মধ্যে মাত্র ৬.৩ ভাগ উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন। কর্মক্ষম ১০ কোটি ৬১ লাখ হলেও কর্মের সঙ্গে যুক্ত ৭১ ভাগ। বাংলাদেশে যে বিজসেন স্কুলসমূহের রমরমা তার মান মাঝারি ধরনের, স্কোর ৭-এর মধ্যে ৩.৭২ ভাগ। এ দেশে প্রকৌশল, উৎপাদন ও নির্মাণ ক্ষেত্রে ডিগ্রী অর্জন করেন মাত্র ১৪ হাজার ও স্বাস্থ্য সেবায় ৫ হাজার। অন্যান্য বিষয়ে কয়েক লাখ। বাংলাদেশ সান্ত¡না পেতে পারে এ ভেবে যে, পাকিস্তানের স্থান ১১৩তম। [বণিক বার্তা, ১৫.৫.১৪] যে জনসংখ্যা আমরা রফতানি করি তারা অধিকাংশই নিচুমানের কাজে জড়িত। এগুলো দেশের সুনাম বৃদ্ধি করে না। প্রায় ১০-১১ রকমের শিক্ষাব্যবস্থা থাকলে এ পরিস্থিতিরই সৃষ্টি হতে পারে। মাদ্রাসা শিক্ষায় গুরুত্ব আরোপ দেশের জন্য শুভ নয়, লাভজনকও নয়। এ সব কিছু মনোজগতে হেজাবী আধিপত্য সৃষ্টিতে সহায়তা করে। যে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় ইতিহাসের স্থান নেই, নিজের দেশের মানুষের আত্মদানের ইতিহাস অনুপস্থিত, সে দেশে প্রজন্ম শেকড়হীন। টিউলিপ জয় পেয়েছে তার রাজনীতির শেকড়ের জন্য। কিন্তু যে প্রজন্ম শেখ হাসিনা রেখে যাচ্ছেন তারা তো শেকড়হীন। তা হলে তার লিগ্যাসি বা সাফল্য লালন করবে কে? এ বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে ভেবে দেখা দরকার। উন্নয়নের সঙ্গে যখন সংস্কৃতি এগোয় তখন এক রকম মানুষ জন্মে, সে পরিবেশে বড় হয়। কম উন্নয়ন ও বিনা সংস্কৃতিতে তারেক রহমানদের শুধু জন্ম নয়, পরিবৃদ্ধি হয়। উন্নয়ন হবে, সঙ্গে হেজাবীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে তা কাম্য নয়। শেখ হাসিনার দলে অনেকে বিশ্বাস করতে পারেন, হেজাবীদের তোয়াজ করলে তারা ভোটের বাক্স ভরে দেবে। মাওলানা শফী ও তার সাঙ্গোপাঙ্গকে তো সরকার অনেক দিয়েছে বলে শুনেছি, কিন্তু তারা কি সরকারের ভোটের বাক্স ভরেছে না তাকে সমর্থন করছে? যে বিএনপি-জামায়াত করে সে নৌকায় ভোট দেবে এ থিসিস যারা দেয় তারা মতলবী, হেজাবীদেরই ফ্রন্ট হিসেবে কথা বলে। সুযোগ-সুবিধা তাদের সাময়িকভাবে চুপ করাতে পারে, সব সময় না। এ কথাটা মনে রাখা উচিত আওয়ামী নেতাদের, যারা খবরের কাগজও পড়েন কিনা সন্দেহ হয়। আওয়ামী লীগ পাকিস্তান ভেঙ্গেছিল, পাকিস্তানী বাঙালীরা এ কথা ভুলতে পারবে? আর হেজাবীদের সব সময়ই তুষ্ট রাখতে হবে আর যারা শেখ হাসিনার জন্য করবেন বা মরবেন তাদের উপেক্ষা করতে হবেÑ এটি বিকৃত মনোভঙ্গি। উন্নয়ন বিপ্লব হচ্ছে, তার সঙ্গে শিক্ষা-সংস্কৃতির বিপ্লব না হোক সংস্কারের কাজটি শুরু করতে হবে। শেখ হাসিনার বিভিন্ন কার্যক্রমের আমরা সমালোচনা করতে পারি, তার অনেক কার্যক্রম আমাদের মনঃপূত নাও হতে পারে, কিন্তু তিনি ফিরে এসে যা করেছেন তাতে ইতিবাচক দিকের সংখ্যাই বেশি। তাঁর পিতা আজন্ম সামরিক বা স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। তিনিও সেই ঐতিহ্য বজায় রেখেছেন এবং সৈন্যরা যাতে উচ্চাকাক্সক্ষী না হয় সে কারণে পঞ্চদশ সংশোধনী এনেছেন যার একটি ধারায় আছে যিনি বন্দুকের সাহায্যে ক্ষমতা দখল করবেন, তিনি ক্ষমতাচ্যুত যখন হবেন [হতেই হবে বাংলাদেশের ঐতিহ্যই তা] তখন তাকে দেশদ্রোহিতার অভিযোগে বিচারের সম্মুখীন হতে হবে। প্রতিবেশীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব ও জঙ্গীবাদ এবং সন্ত্রাস দমনের কারণে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তার গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন পদক্ষেপের দরুন বিশেষ করে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, স্বাস্থ্যসেবা ও নারী উন্নয়নের কারণে বাংলাদেশ অনেকটা রোল মডেলের অভিধা পেয়েছে। বাংলাদেশকে এখন উপেক্ষা করা যায় না। তিনি দেশের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি করেছেন। বাংলাদেশের নিরাপত্তা সংরক্ষণ করেছেন, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মৌলিকত্ব ফিরিয়ে আনছেন। তিনি সাধারণ মানুষের মর্যাদা ফিরিয়ে এনেছেন। বাংলাদেশের এখন বিদেশী সাহায্য না পেলেও চলবে, মুখ থুবড়ে পড়বে না। আলু থেকে জাহাজ সব কিছুই রফতানি করছে বাংলাদেশ। এখন বাংলাদেশে মঙ্গা নেই। দারিদ্র্যের হার কমছে। দারিদ্র্য আছে, কিন্তু ক্ষুধার্ত হয়ে বাংলাদেশে আর কারো মৃত্যু হবে কিনা সন্দেহ। এজন্য তাকে নিত্য লড়াই করতে হয়েছে এবং হচ্ছে পাকিস্তানী বাঙালী, রাজনৈতিক দুর্বৃত্ত ও সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের সবচেয়ে ক্ষতি করেছেন জিয়াউর রহমান। সেই ক্ষতি ও সেই ক্ষত থেকে বাংলাদেশকে শেখ হাসিনা ফিরিয়ে এনেছেন। সামরিক শাসক ও বিএনপি-জামায়াত বাংলাদেশকে প্রায় ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল। তিনি এখন বাংলাদেশকে সবল রাষ্ট্রে পরিণত করেছেন। আমি যা বর্ণনা করলাম তা হলো একটি সংক্ষিপ্তসার মাত্র। ১৯৭৫ সালের পর বাংলাদেশের আর কোন রাজনীতিবিদ বা সরকারপ্রধানের এত অর্জন বা সাফল্য নেই। এত সাফল্য ও অর্জন যেন তাকে অভিভূত বা আছন্ন না করে ফেলে, তাই কামনা করি। তার নিত্যভাবনা যেন হয় তিনি কিছুই করেননি। তার আরও অনেক করার আছে- তাই নিত্য লড়াই করে যেতে হবে তাকেÑ এই কামনাই করি। আগেও বলেছি, আবারও বলছি- তার অনেক সিদ্ধান্ত মনঃপূত না হলেও আমরা বাঙালিত্ব দর্শনে বিশ্বাসী এবং সে কারণে তার নেতৃত্বে আস্থাশীল। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার তিনি করছেন, এ কারণেও তার প্রতি আমরা যারা দীর্ঘদিন আন্দোলন করেছি তারা কৃতজ্ঞ। যারা বিশ্বাসী নয়, বিশেষ করে গত প্রজন্ম, তাদেরকে যতই এ বিষয়ে জ্ঞানদান করা হোক না কেন তাদের আর বিশ্বাসী করা যাবে না। তাদের প্রতিনিধি এক বুড়ো ভাম নয়াদিগন্তে লিখেছেন, শেখ হাসিনার পরিণতি হবে শেখ মুজিবের মতো। এই যে মনোভঙ্গি- এটিই পাকিস্তানী বাঙালীর মনোভঙ্গি। এটিই নষ্টদের চরিত্র তুলে ধরে। নষ্টদের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেছেন শেখ হাসিনা ১৯৮১ সাল থেকে। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়েছেন, আরো পথ পেরুতে হবে। তার এই যাত্রায় আমরা আছি তার সঙ্গে। নষ্টদের বিরুদ্ধে লড়াই চলছে, পাকিস্তানী বাঙালীদের বিরুদ্ধে লড়াই চলছে, তারা উৎখাত না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চলবে।
×