ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মিলু শামস

বাংলাদেশ ॥ সমৃদ্ধ জনপদের উত্তরসূরি

প্রকাশিত: ০৩:৩৯, ২০ মে ২০১৫

বাংলাদেশ ॥ সমৃদ্ধ জনপদের উত্তরসূরি

বাংলাদেশের ভূমি পলিমাটিতে গঠিত বলে এখানে সভ্যতার বিকাশ অল্পদিনের- প্রচলিত এ ধারণা মিথ্যা প্রমাণ করেছে প্রতœতাত্ত্বিক উয়ারি-বটেশ্বর। অনেক অঞ্চল পলি গঠিত হলেও হাজার শুধু নয়, লাখো বছরের পুরনো ভূমিও রয়েছে এ দেশে। পার্বত্য চট্টগ্রাম, সিলেট, কুমিল্লার লালমাই, মধুপুর গড়, উত্তরবঙ্গের বরেন্দ্রভূমি তার প্রমাণ। সবশেষ উয়ারি-বটেশ্বর সে সত্যকে আরও নিশ্চিত করেছে। যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক প্রতœতত্ত্ব বিভাগের ইমিরেটাস অধ্যাপক ড. দিলীপ কুমার চক্রবর্তী এ নিদর্শনকে মহাজনপদ সময় বা সমতট জনপদের সমসাময়িক মনে করছেন। এমনকি এখানকার প্রত্নবস্তুগুলোর ব্যাখ্যায় এতদিনের ধারণা সমতট অঞ্চলের সময় পঞ্চম খ্রিস্টাব্দকেও অতিক্রম করতে পারে বলে তার ধারণা। ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম দিককার রাষ্ট্র মহাজনপদগুলো বিকশিত হয়েছিল আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ছয় শতক থেকে চার শতকের মধ্যে। অনেক মহাজনপদ ছিল এখানে। সমতট তার একটি। প্রতœতাত্ত্বিকদের ধারণা উয়ারি-বটেশ্বর মহাজনপদের অংশ ছিল এবং এখানে গঙ্গাঋদ্ধি জাতি বাস করত। এখানে অনেক রিচুয়ালের বস্তুগত নিদর্শন পাওয়া গেছে, যার বেশিরভাগকে বৌদ্ধধর্মের অনুষঙ্গ মনে করা হচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ প্রত্ন স্থান উয়ারি-বটেশ্বর পুরনো এক দুর্গ নগর। এ অঞ্চলের পঞ্চাশটি প্রতœস্থানে পাওয়া নিদর্শন থেকে বিশেষজ্ঞরা এ বিষয়ে মোটামুটি নিশ্চিত হয়েছেন। ধারণা করা হয়, ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকায় গড়ে ওঠা এ নগরে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল। স্বাভাবিকভাবেই সমৃদ্ধ এক নদীবন্দরও ছিল। এখানে পাওয়া স্যান্ডউটচ কাঁচের পুঁতি ও রোলেটেড মৃৎপাত্রের প্রতœ বিশ্লেষণে ধারণা করা হয় উয়ারি-বটেশ্বরের সঙ্গে রোমান সাম্রাজ্যের বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল। অনেক ধরনের পুঁতি তৈরির কারখানা ছিল এখানে, যার কাঁচামাল হিসেবে বিশেষ ধরনের পাথর আসত বাইরে থেকে। পশ্চিমবঙ্গের রাজমহল পাহাড়, বিহারের ছোট নাগপুর ও দক্ষিণ ভারতের বিন্ধ্য পর্বত থেকেও পুঁতি তৈরির কাঁচামাল আসার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পেয়েছেন প্রতœতাত্ত্বিকরা। পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম পর্যায়ের নগর সভ্যতা গড়ে উঠেছিল পাঁচ হাজার বছর আগে মিসর, চীন, মেসোপটেমিয়া ও ভারতে। খ্রিস্টের জন্মের ছয় শ’ বছর আগে দ্বিতীয় পর্যায়ের নগর সভ্যতা শুরু। উয়ারি-বটেশ্বর এ পর্যায়ের নিদর্শন। বগুড়ার মহাস্থানগড়ও। মহাস্থানগড়ের প্রতœতাত্ত্বিক গবেষণা শুরু হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে। উয়ারি-বটেশ্বরে প্রথাগত প্রতœতাত্ত্বিক অনুসন্ধান শুরু উনিশ শ’ ছিয়ানব্বই সাল থেকে ড. সুফি মোস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে। বলা যায়, এদেশে প্রতœতত্ত্বের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রায় শুরুর সঙ্গে জড়িয়ে আছে প্রাচীন এ প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন উদ্ঘাটন প্রক্রিয়া। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতœতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক ড. সুফি মোস্তাফিজুর রহমান সহকর্মী ও শিক্ষার্থীদের নিয়ে প্রথম থেকে কাজ করেছেন উয়ারি-বটেশ্বর খনন কাজে। মাটি খুঁড়ে ইতিহাস বের করার কাজটি যে শুধু ক্লাস রুমে পাওয়া তত্ত্বের প্রায়োগিক চর্চা নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে নিজস্ব সংস্কৃতির প্রতি অনুগত এক স্বপ্নময় ভালবাসা ও দুর্দান্ত আবেগÑ ড. রহমানের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর এ কথা মানতেই হয়। মানুষের সঙ্গে সহজে মিশে যাওয়া এবং প্রতœতত্ত্বের মতো বিষয়কে সহজে উপস্থাপন করার ক্ষমতাই হয়ত পারিপার্শ্বিকতাকে তার অনুকূলে এনেছে। তবে চলার শুরুটা সহজ ছিল না। সে কথা বলেছেন নিজেই- ‘আমাদের আবিষ্কার ও গবেষণার ফলাফল নিয়ে একশ্রেণীর প্রতœতাত্ত্বিক, অধ্যাপক, গবেষক সন্দেহ পোষণ করতে শুরু করেন। তাঁরা উয়ারি-বটেশ্বরে যে নগর সভ্যতা গড়ে উঠেছিল, সেটা অস্বীকার করেন। আড়াই হাজার বছরের প্রাচীনত্ব নিয়ে সন্দেহ-সংশয় প্রকাশ করেন। কেউ বলেন, ইতিহাস পাল্টে দেয়ার ভ্রান্ত আয়োজন, কেউ আমাদের বলেন, কপট প্রতœতাত্ত্বিক, কেউ কেউ মুসলিম-পূর্ব যুগে চুন-সুড়কির ব্যবহার ছিল না বলে জোর দাবি করেন। এ জাতীয় অনৈতিক ও অসাধু অভিমত যে কোন প্রতœতাত্ত্বিকের প্রত্যয় ও দৃঢ়তাকে ভেঙ্গে দিতে পারত। শুরুতে প্রবল বিরোধিতার মধ্যে আমাদের গবেষণা পরিচালনা করতে হয়েছিল। কিন্তু ল্যাবরেটরি পরীক্ষা-নিরীক্ষা, নতুন নতুন আবিষ্কার ও প্রামাণিক তথ্য প্রকাশ হতে থাকলে উয়ারি-বটেশ্বর ইতিহাসে দৃঢ়ভাবে জায়গা করে নেয়।’ ইতিহাসের সেই শহরের ওপর ঘুরছি ফিরছি আমরা আড়াই হাজার বছরের পরের মানুষেরা। নগরের চারদিকে উঁচু মাটির প্রাচীর ঘিরে ছিল পরিখা। আরও একটি দুর্গ রয়েছে এখানে, নাম অসম রাজার গড়। ছাপাঙ্কিত প্রচুর মুদ্রা পাওয়া গেছে যা থেকে অনুমান করা হয় বাণিজ্যকেন্দ্রের পাশাপাশি একটা প্রশাসনিক শহরও ছিল। উয়ারি-বটেশ্বরে প্রথাগত প্রতœতাত্ত্বিক গবেষণা উনিশ শ’ ছিয়ানব্বই সাল থেকে হলেও জায়গাটির প্রতœমূল্য প্রথমে উপলব্ধি করেছিলেন হানিফ পাঠান নামে এক স্কুলশিক্ষক। উনিশ শ’ তেত্রিশ সালে মাটির নিচে পাওয়া কিছু রুপার মুদ্রা ইতিহাস ও প্রতœতত্ত্ব সচেতন হানিফ পাঠানকে কৌতূহলী করে। তাঁর উৎসুক মন খোঁজ পায় অনেক নিদর্শনের। এরপর এ নিয়ে তিনি লেখালেখি শুরু করেন। উনিশ শ’ পঞ্চান্ন সালে দৈনিক আজাদের রবিবাসরীয় সংখ্যায় প্রকাশিত হয় ‘পূর্ব পাকিস্তানে প্রাগৈতিহাসিক সভ্যতা’ নামে হানিফ পাঠানের প্রবন্ধ। তাঁর সন্তান হাবিবুল্লাহ তখন ক্লাস এইটের ছাত্র। প্রতœতত্ত্বের প্রতি বাবার কৌতূহল সংক্রমিত হয় সন্তানের মধ্যে। হানিফ পাঠানের রিলেরেসের কাঠি হাতে এরপর এগোতে থাকেন হাবিবুল্লাহ পাঠান। উয়ারি-বটেশ্বরের প্রতœ এলাকায় দাঁড়িয়ে স্মৃতিচারণ করছিলেন সেদিনের ক্লাস এইটের ছাত্র আজকের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক প্রবীণ হাবিবুল্লাহ পাঠান- বাবার উদগ্র কৌতূহলের উত্তরাধিকার বহন করে কিভাবে গোটা জীবন পার করে দিলেন কিছু ‘মাটির ঢিবি’র পেছনে। পিতা-পুত্রের অসীম ধৈর্য আজকের উয়ারি-বটেশ্বরকে এভাবে উন্মেচিত করতে পেরেছে বললে বোধহয় বেশি বলা হবে না। প্রতœ বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান ছাড়াই শুধু নিজেদের অর্জিত জ্ঞান ও পড়াশোনা দিয়ে ইতিহাসের এত বড় অর্জনের পথরেখা স্পষ্ট করেছিলেন গ্রামের দু’জন স্কুলশিক্ষক অথচ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা পাওয়া অনেক তাত্ত্বিক আজও এর গুরুত্ব বোঝেন না বা বুঝতে চান না। কী অমূল্য সম্পদ আমাদের আছে সে খোঁজ আমরা না রাখলেও অন্য দেশের কৌতূহলী পর্যটকরা রাখেন। ব্রিটিশ এক পর্যটক কনসালটেন্টও উয়ারি-বটেশ্বরে ঘুরছিলেন আমাদের সঙ্গে। বাংলাদেশের প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো দেখে মুগ্ধ তিনি। তাঁর কথার মূল বক্তব্য ছিল, এত সমৃদ্ধ ঐতিহ্য আমাদের আছে কিন্তু বাইরের দুনিয়া সে সম্পর্কে কিছুই জানে না। গরিব, দয়াদাক্ষিণ্য প্রার্থী দেশ হিসেবেই আজও বাংলাদেশের পরিচিতি। আমরা জানাতে পারিনি সে ব্যর্থতা আমাদের। পাশাপাশি এও সত্য, অন্যকে জানানোর আগে নিজেদের জানাটা বেশি জরুরী। আমরা কি আমাদের সন্তানদের নিজেদের দেশ চেনাতে পারছি? বোঝাতে পারছি কি আমাদের সংস্কৃতির শিকড় অনেক গভীরে? গত শতকের বিশের দশকে হরপ্পা-মহেঞ্জোদাড়ো আবিষ্কারের আগে সিন্ধু সভ্যতার প্রাচীনত্ব স্বীকার করা হতো না। প্রতœতত্ত্ববিদরা মাটি খুঁড়ে সে সত্য প্রতিষ্ঠা করেছেন। উয়ারি-বটেশ্বরও তেমনি আড়াই হাজার বছরের বাঙালী সংস্কৃতির সত্যতা প্রমাণ করেছে। জাতি হিসেবে আমাদের এ গৌরব ছড়িয়ে দিতে হবে পৃথিবীময়। প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্যে জায়গা পাওয়ায় চমক আছে হয়তÑ যদিও তা ব্যর্থ হয়েছে। পর্যটক আকর্ষণের যে যুক্তি তুলে এ নিয়ে প্রচার চালান হয়েছে সে যুক্তি আরও মজবুত হয় প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শনের ক্ষেত্রে। এ নিদর্শনগুলো ঠিকভাবে উন্মোচন ও প্রচার করতে পারলে এ দেশে পর্যটকের সংখ্যা বাড়বে তো নিশ্চয়ই, ঐতিহ্য সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে পৃথিবীতে আমাদের পরিচিতিও প্রতিষ্ঠিত হবে। একজন সচেতন মানুষ হিসেবে পৃথিবীতে নিজের অবস্থান জানা যেমন জরুরী তেমনি রাষ্ট্রেরও দায় থাকে দেশের কৃষ্টি ও ঐতিহ্যকে মেলে ধরে পৃথিবীতে নিজের সম্মানজনক অবস্থান নিশ্চিত করার।
×