ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মুনতাসীর মামুন

নিত্য লড়াইয়ে শেখ হাসিনা

প্রকাশিত: ০৬:০৬, ১৯ মে ২০১৫

নিত্য লড়াইয়ে শেখ হাসিনা

প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ ক্রমাগত উন্নতির পথে এগিয়ে গেলেও এখনও তাঁর পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়, বরং বড় বেশি কণ্টকাকীর্ণ, বিপদসঙ্কুল। একদিকে বিএনপি-জামায়াত ও হেফাজতী নেতৃত্বের মৌলবাদী জঙ্গী মনোভাব, অন্যদিকে গণতন্ত্রের নামে একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী, এলিট শ্রেণী ও এনজিও গোষ্ঠীর প্রবল বিরোধিতা- এসবই মোকাবেলা করতে হচ্ছে তাঁকে। নিজের দল আওয়ামী লীগের একাংশসহ প্রশাসনের অসহযোগিতাও কম নয়। ১৮ মে’র পর আজ পড়ুন চতুর্থ কিস্তি ... আওয়ামী লীগ দল হিসেবে শিথিল হয়ে যাচ্ছে। বিরোধী দলে থাকলে তারা যত আদর্শগতভাবে ঐক্যবদ্ধ থাকে, এখন সে অবস্থা নেই। বিএনপির মতো সুবিধাবাদীদের প্লাটফর্মে দলটি পরিণত হলে শেখ হাসিনা যে অর্জন করেছেন, সে অর্জন ধরে রাখা যাবে না। শুধু তাই নয়, এত সাফল্য নেতা বা নেতাদের বিচ্ছিন্ন ও একনায়কী করে তোলে। এটি ব্যক্তি ও সমষ্টির জন্য শুভ নয়। আগামী দিনের দল ও নেতৃত্ব তাই নিজ স্বার্থেই এখন থেকেই নির্মাণ করা বিধেয়। এখনও অনেকে দুই নেত্রীকে একত্রে দেখার চেষ্টা করেন। কিন্তু দিন দিন সে অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। আরো হবে। যারা গোলাপী নেশায় বুঁদ হয়ে, হেজাবি চরিত্র নিয়ে ভাবছেন আগের মতো একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করবেন, তা বোধহয় হবে না। তবে একটি কথা মানতে হবে, যা সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে প্রতিফলিত হয়েছে, তা হলো, আমাদের মনোজগতে হেজাবি আধিপত্য একেবারে বিনষ্ট হয়নি। কমপক্ষে ৩৫ ভাগ লোকের মনোজগতে যে তারা আধিপত্য বিস্তার অক্ষুণœ রেখেছে, এটি তাদের বিপুল সাফল্য। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ বা শেখ হাসিনা সাফল্য দেখাতে পারেননি। কেন পারেননি বা কেন আধিপত্য বিস্তার করতে চাচ্ছেন না, তা আমার মতো ছোট মাপের মানুষের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে মনোজগতে যদি বাঙালিত্বের আধিপত্য না ঘটে, তাহলে এইসব যুদ্ধ ও অর্জন বৃথা যাবে। শুধু উন্নয়ন মানুষের মনের নষ্টামি দূর করে না। শেখ হাসিনা নষ্টদের থেকে সব কিছু এখনও নিজের অধিকারে আনতে পারেননি। হয়ত পারবেনও না। দুটি জেনারেশন এই বিকৃত রোগে আক্রান্ত। কিন্তু যে লড়াইটা তিনি শুরু করেছিলেন, তা শেষ হয়নি। এত তাড়াতাড়ি শেষ হবে না। তা এখনও চলছে। যে সাফল্য তিনি অর্জন করেছেন, তা এখন সংহত করার সময়। সেজন্য লড়াইটা চালিয়ে যেতে হবে। শেখ হাসিনার বিরোধীরা যে এখন আরো জমি হারাচ্ছে, তা ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। মিডিয়ার যে অংশ তাঁর বিরুদ্ধে সব সময় তৎপর, তারা এখন হঠাৎ নমনীয় বলব না, কেমন যেন নিরপেক্ষ। মতলববাজরা কখন কী করতে হবে, তা আগেই বোঝে। খুব সম্ভব পরিস্থিতি এখন আর হেজাবীদের অনুকূলে নয়। নতুন কম্পিউটার জেনারেশনের সংখ্যাগরিষ্ঠ হেজাবীদের বিরুদ্ধে। হেজাবীদের পক্ষে থাকা এখন মডার্নিটি বা স্মার্ট নয়। সে কারণেই তারা নিরপেক্ষ হওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে পরানের গহীন গভীরে এক টুকরো হেজাবী তারা সযতেœ লুক্কায়িত রাখবে। লন্ডনে শেখ হাসিনার ভাগ্নি, শফিক-রেহানা কন্যা টিউলিপ সংসদ নির্বাচনে জিতেছেন। এসব ঘটনাও কিন্তু বাংলাদেশের মানুষকে প্রভাবিত করে। কারণ, বাঙালীদের মধ্যে ট্রাইবাল মনোভাব এখনও প্রচুর। টিউলিপের জেতাটা টুঙ্গিপাড়া থেকে জেতার চেয়েও ছিল কঠিন। গ্লেন্ডা জ্যাকসনের মতো ডাকসাইটে মহিলা মাত্র কয়েক ভোটে সেখানে জিতেছিলেন। টিউলিপ সেই ভোটের পরিধি বাড়িয়ে জিতেছেন। কলকাতার দৈনিক স্টেটসম্যানের সম্পাদক মানস ঘোষ আমাকে ফোন করে উল্লসিত স্বরে বললেন, দেখলেন কী হলো? হাসিনার ভাগ্নি জেতে আর খালেদা জিয়ার পুত্র পাঁক ঘাঁটে। কেন এমন হয়? উত্তরে বললাম, পাঁকে পদ্মফুল ফোটার কথা বলা হয় বটে, কিন্তু যারা পাঁকে বড় হয় পাঁক ঘাঁটা তাদের স্বভাবই হয়ে দাঁড়ায়। আম গাছে কি আম হবে না গাব? গাব গাছে কি আম ধরবে যতই যতœ নেন না কেন গাব গাছের। এর কারণ পেডেগ্রি। বংশের ব্যাপারটা বা নাগরিক বৈদগ্ধের কথাটা আগে খুব একটা মানতাম না। এখন খানিকটা হলেও মানি। দু’তিন জেনারেশনের শিক্ষিতের সঙ্গে প্রথম জেনারেশনের শিক্ষিতের একটা বড় তফাৎ হয়ে-ই যায়। আর যার কোন জেনারেশনই শিক্ষিত নয়, তার কথা কী বলব? দু’জনের চিন্তাধারা, দৃষ্টিভঙ্গিতেই প্রবল পার্থক্য দেখব। বিশ্ববিদ্যালয়েই তো দেখছি। শেখ হাসিনা রাজনৈতিক পরিবার থেকে এসেছেন। এমন একটি পরিবার, যেখানে আত্মত্যাগের ও আদর্শের প্রতি অনুগত থাকার একটি ঐতিহ্য আছে। রাজনীতি সচেতন তিনি এবং পূর্ব ঐতিহ্যের কারণে যতটা সম্ভব আদর্শের প্রতি অনুগত থাকার চেষ্টা করেন। তাঁর পরিবারের আত্মত্যাগের একটা ইতিহাস আছে। বৃহত্তর সমাজ কিন্তু এগুলো মনে রাখে। খালেদা জিয়া সুবিধাভোগী ক্ষমতালোভী সামরিক আমলা পরিবেশেই বড় হয়েছেন। যেখানে ষড়যন্ত্র করে ক্ষমতায় যাওয়ার বিষয়টাই মুখ্য। শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার পুত্র কন্যাদের গরিবি হালে কষ্ট করে শিক্ষিত হতে হয়েছে। খালেদার পুত্ররা বৈভব থেকে এবং রাষ্ট্রীয় খরচে বড় হয়েও শিক্ষিত হননি, বরং ড্রাগ এডিক্ট ও লুটেরা হয়েছেন। টিউলিপের পিতা আমার সহকর্মী ও বন্ধু। কী অবস্থায় তার পরিবার প্রতিপালিত হয়েছে, আমি জানি। টিউলিপ যে ভোটে জিতেছেন তার কারণ, তাকে সব অর্জন করতে হয়েছে, রাজনীতি সচেতন হয়েছেন, প্রতিপক্ষকে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে পরাভূত করতে উদ্যত হননি পারিবারিক রাজনৈতিক ঐতিহ্যের কারণে। তারেক রহমান বঙ্গবন্ধু থেকে এমন কেউ নেই যাকে প্রতিনিয়ত গালিগালাজ করেননি। কুৎসিত ভাষায় গালিগালাজ করেছেন এবং তিনি কী ধরনের পরিবার থেকে এসেছেন তা পরিস্ফুট করেছেন। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী লিখেছেন, তারেকের অনুসারীরা সেই লন্ডনেও টিউলিপকে নোংরা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে হারাবার চেষ্টা করেছেন। কয়লা ধুলেও ময়লা যায় না। নষ্ট রাজনীতি ও নষ্টামির মধ্যে যে বড় হয়, সে নষ্টই থাকে এবং তাকে নষ্টরাই সমর্থন করে। কিন্তু সেই সুদূরেও টিউলিপকে বিএনপি-জামায়াত বেকায়দায় ফেলতে পারেনি। এরকম নেতা ও নেতৃত্ব যারা সমর্থন করে, তারা শুধু গোলাপী নেশায় মত্ত তা নয়, নষ্টদের অধিকার তারা ফেরত আনতে চায়, যেখানে তাদের পরিবৃদ্ধি। একটি উদাহরণ দিই। পৃথিবীর কোথাও মানবতাবিরোধীদের কেউ সমর্থন করেনি, করে না। বিএনপি করেছে পাকিস্তানী মানসের কারণে এবং সেই একটি কারণে তার রাজনীতিই বন্ধ করে দেয়া উচিত, জামায়াতের তো বটেই। জঙ্গীবাদ সমর্থন এবং গত এক বছর তারা যে সন্ত্রাস চালিয়েছে সাধারণ মানুষ ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, সেখানে তাদের নিছক সন্ত্রাসী ছাড়া অন্য কিছু ভাবা বিধেয় নয়। তারপরও মিডিয়ার একটি অংশ, এনজিওর একটি অংশ, এলিটদের একটি অংশ যখন গণতন্ত্র এবং গণতন্ত্র চর্চার নামে এদের সমর্থন করে তখন বলতে হয়, এরাও নষ্ট রাজনীতির অন্তর্গত। না হলে এই সেøাগান কেউ তোলে না যে, আওয়ামী লীগ জিতলে সব শেষ, বিএনপি জিতলে সব ঠিক। বা, ড. এমাজউদ্দিনের মতো বলতে হয়, গত ৪৩ বছরে তিনি এমন খারাপ নির্বাচন দেখেননি, যা তিনি সিটি নির্বাচনে দেখেছেন। এদের মতো মানুষজনই একজন অর্ধশিক্ষিত, সংস্কৃতিহীন যুবককে নেতা বলে মেনে নেয়। কারণ, তাদের আর যাই থাকুক চরিত্র বলতে কিছু নেই। বস্তুগত কিছু পাওয়াই তাদের একমাত্র অভীপ্সা। উপসংহারে আবারও বলব, আওয়ামী লীগ ধোয়া তুলসীপাতা নয়। তারা এবং তাদের সরকার যা করে, তার সব কিছু গ্রহণযোগ্য নয়। নববর্ষে মহিলাদের লাঞ্ছনার প্রতিবাদ করলে মহিলাদেরই এখন লাঠিপেটা করা হয়, সেক্যুলারিস্টদের হত্যা করলে যখন তদন্ত শ্লথ হয়ে যায়, সুবিধাবাদী লোকগুলোকে যখন সরকারের আনুকূল্য পেতে থাকে, তখন বিতৃষ্ণাই জাগে। সরকার ও আওয়ামী দলে হেজাবীদের সংখ্যা খারাপ নয়। আওয়ামী লীগ নেত্রী বা তার সম্পাদক বলেন, জামায়াতকে একবিন্দু ছাড় দেয়া হবে না। শেখ হাসিনা বলেছেন, এমন আকাল পড়েনি যে আওয়ামী লীগে জামায়াত কর্মী নিতে হবে। সেখানে দলের যুগ্ম সম্পাদকই জামায়াতের নেতাকর্মীদের সস্নেহে বাহুডোরে আবদ্ধ করে দলে নেন। স্থানীয় পর্যায়ে আওয়ামী নেতারা হেজাবীদের আনুকূল্য দিতে ভালোবাসেন। হেজাবীদের জন্য তাদের উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা দেখলে অভিভূত হবেন। দেশে সুশাসনের সুবাতাস বইছে, এমন কথাও বলব না। (চলবে)
×