ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পাকিস্তানী মালিকানাধীন সিটি স্কুলের কার্যক্রম নিয়ে নানা অভিযোগ

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ১৮ মে ২০১৫

পাকিস্তানী মালিকানাধীন সিটি স্কুলের কার্যক্রম নিয়ে নানা অভিযোগ

বিভাষ বাড়ৈ ॥ বাংলাদেশে পরিচালিত পাকিস্তানী মালিকাধানাধীন সিটি স্কুল ইন্টারন্যাশনালের কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রশ্ন উঠেছে প্রয়োজনীয় অনুমোদন ছাড়া রাজধানী ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত এ প্রতিষ্ঠানে বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশের সংস্কৃতি বাদ দিয়ে উর্দু শেখানো নিয়েও। এছাড়া পাকিস্তান থেকে এখানে এসে শিক্ষক-কর্মকর্তা হিসাবে যারা কাজ করছেন তাদের অনেকেরই বাংলাদেশে অবস্থানের বৈধতা ও কর্মকা- নিয়েও উঠেছে অভিযোগ। মোটা অঙ্কের বেতন নিয়ে নিম্নমানের শিক্ষাদান, শিক্ষকদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ, বাংলাদেশে পাকিস্তানী উর্দু ভাষা ও সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার পাঁয়তারা চালানো হচ্ছে অভিযোগ তুলেছেন খোদ অনেক শিক্ষক ও অভিভাবকরাই। এ ধরনের অভিযোগ এসেছে শিক্ষা অধিদফতরেও। অভিযোগের প্রেক্ষিতে বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশ স্টাডিজ বিষয় না পড়ানো এবং শিক্ষা বোর্ডের অনুমোদন না থাকার বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। জানা গেছে, বিদেশী শিক্ষার্থীদের জন্য আন্তর্জাতিক মানের স্কুলগুলোতে তাদের নিজ নিজ ভাষা শেখানোর সুযোগ থাকে। তবে যে দেশে স্কুলটি থাকবে সে দেশের ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে একটি পাঠ থাকতে হবে। কেবল তাই নয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বোর্ডের বিধান অনুসারে প্রথমত প্রতিষ্ঠানটিতে নিবন্ধিত হতে হবে। এছাড়া এখন বিদেশী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হলেও সেখানে বাংলাদেশ স্টাডিজ বিষয়টি হতে হবে বাধ্যতামূলক। ইংরেজী মাধ্যম হলেও এখন তাদের শিক্ষাক্রমের বাইরে পড়াতে হবে বাংলাদেশ স্টাডিজ। কিন্তু অভিযুক্ত সিটি স্কুলে ইংলিশ মিডিয়াম বলে প্রতিষ্ঠা করা হলেও ইংরেজীর সঙ্গে উর্দু ভাষা শেখানো হচ্ছে। বাংলা কিংবা বাংলাদেশ বিষয়ক কোন পাঠ্যই নেই। এমনকি এখানে উর্দু ভাষার প্রভাবে বাংলাদেশী শিক্ষার্থীরাও বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষা নিয়ে কোন বিষয় পড়তে পারছে না। রাজধানীর বনানী ও গুলশানের অভিজাত পাড়ায় সিটি স্কুলের দুটি ক্যাম্পাস রয়েছে। স্কুলের বিভিন্ন অনিয়মের খোঁজ জানতে এসব ক্যাম্পাসে গেলে বেরিয়ে আসে আরও অনেক তথ্য। অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাংলাদেশে ক্যাম্পাস স্থাপন করে পাকিস্তানী মালিকাধানাধীন সিটি স্কুল ইন্টারন্যাশনাল অনুমোদন ছাড়া সম্পূর্ণ অবৈধভাবে উর্দু শেখাচ্ছে শিক্ষার্থীদের। পাকিস্তান থেকে আসা উর্দু শিক্ষকদের অনেকেরই বাংলাদেশে কাজ করার নেই বৈধ অনুমোদন। সিলেবাসে উর্দু ভাষা যুক্ত করতে প্রতিষ্ঠানটি শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা অধিদফতর থেকে নেয়নি কোন ছাড়পত্র। ইংরেজী মাধ্যমের এ স্কুলে বাংলাদেশ সম্পর্কিত কোন পাঠও রাখা হয়নি প্রতিষ্ঠানটির কেন্দ্র পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষের নির্দেশে। ফলে বাংলাদেশে অবস্থান করেও এদেশ প্রসঙ্গে ‘অজ্ঞ’ থেকে যাচ্ছে সিটি স্কুলের শিক্ষার্থীরা। স্কুলটির মালিক পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আত্মীয় হওয়ায় ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণও করছে বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে। পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও বর্তমানে তেহরিক-ই-ইনসাফের পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা খুরশিদ মাহমুদ কাসুরীর শালিকা ড. ফারজানা ফিরোজ এ স্কুলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ১৭০টিরও বেশি শাখা আছে স্কুলটির। যদিও সেইসব শাখায় সংশ্লিষ্ট দেশের বিধিবিধান মেনে প্রয়োজনীয় অনুমোদন নিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। ব্যতিক্রম বাংলাদেশে। পাকিস্তানে ১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এ স্কুলটি বাংলাদেশে কার্যক্রম শুরু করে ২০০৩ সালে। তখন থেকেই নিয়মবহির্ভূতভাবে উর্দু শেখানোসহ নানা অনিয়ম করে যাচ্ছে স্কুল কর্তৃপক্ষ। ধারাবাহিকভাবে এসব অনিয়ম বেড়েই চলছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সিটি স্কুলের দুটি ক্যাম্পাসে বাংলাদেশী শিক্ষার্থীর পাশাপাশি বাংলাদেশে বসবাসরত পাকিস্তানের বেশ কিছু শিক্ষার্থী রয়েছে। এছাড়াও শ্রীলঙ্কা, নেপালসহ কয়েকটি দেশের শিক্ষার্থীরাও এ স্কুলে পড়ছে। কেবল পাকিস্তানী শিক্ষার্থীদের ‘বিশেষভাবে’ গুরুত্ব দিয়ে সেখানে দেদারসে শেখানো হচ্ছে উর্দু ভাষা। উর্দু শেখানোর জন্য পাকিস্তান থেকে আনা হচ্ছে শিক্ষক। বাংলাদেশে কাজ করার বৈধ অনুমোদন না থাকলেও তারা নির্দিধায় অবস্থান নিয়ে উর্দু শিখিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে এ উর্দু শিক্ষক হিসেবে রয়েছেন পাকিস্তানের নাগরিক আনজুমান ও জুবদা। এ দুজনের বাংলাদেশে কাজ করার কোন বৈধ অনুমোদন নেই বলে অভিযোগ উঠেছে। তবুও তারা এদেশে অনায়াসে শিক্ষকতার কাজ করে যাচ্ছেন। এর আগে একই পন্থায় উর্দু শিখিয়ে গেছেন পাকিস্তানের সায়মা ও জেবা। স্কুলটির প্রিন্সিপাল মারিয়া কাশিফও পাকিস্তানের নাগরিক। তবে তার কাজের অনুমোদন রয়েছে বলে দাবি করছে কর্তৃপক্ষ। অভিভাবকরা অভিযোগ করেছেন, এ স্কুলে বাংলাদেশের কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে ‘বুড়ো আঙ্গুল’ দেখিয়ে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করা হচ্ছে। বাংলাদেশের কোন জাতীয় দিবসই ঠিকভাবে পালন করা হচ্ছে না। এমনকি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসেও স্কুলজুড়ে থাকে পাকিস্তানী ভাষা নিয়ে নানা আয়োজন। বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দুর জন্য নানা আয়োজন নিয়ে প্রশ্ন তুললেন বাংলাদেশী এক শিক্ষক। বাংলাদেশী এ শিক্ষক আক্ষেপ করে বলেন, প্রয়োজনের তাগিদে এখানে চাকরি করছি। কিন্তু এ স্কুলে বাংলা ভাষার প্রতি কোন শ্রদ্ধাই নেই। তারা উর্দু শেখাতেই বেশি ব্যস্ত। যেসব শিক্ষার্থী উর্দু ভাষা শিখতে ইচ্ছুক নয়, উর্দু ক্লাস শুরু হলে স্কুলে তাদের অলস সময় কাটানো ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না। বিকল্প ক্লাস না থাকায় অনেক শিক্ষার্থীর এ সময়টা বিফলেই যায়। অভিভাবকদের একজন নাদিয়া বলছিলেন, ইন্টারন্যাশনাল স্কুল বলে বাচ্চাকে এখানে দিয়েছি। এখন তো দেখি উল্টো হয়েছে। ইংরেজীর নামে উর্দুকেই তারা বেশি প্রাধান্য দিচ্ছি। বাংলা ভাষার গুরুত্ব এদের কাছে নেই। এদিকে ভাড়া করা বাড়িতে স্কুলটি পরিচালিত করায় ছোট ক্লাসরুমে একাধিক শিক্ষার্থীকে পড়ে পাঠ নিতে হচ্ছে। এমনকি স্কুলটি সায়েন্স ল্যাব, লাইব্রেরিয়ান এবং ল্যাবরেটরি সহকারীসহ প্রয়োজনীয় জিনিস ও জনবল নেই। প্রতি মাসে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিলেও শিক্ষার অনেক অনুষঙ্গ থেকে বঞ্ছিত করা হচ্ছে তাদের। অভিভাবকদের পাশাপাশি এমন অভিযোগ করেছেন স্কুলটির একাধিক শিক্ষকও। বাংলা বাদ দিয়ে উর্দু পড়ানো ও অনুমোদন না থাকার বিষয়টি ইতোমধ্যেই নজরে এসেছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি)। অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ফাহিমা খাতুন বলেন, বাংলাদেশে যেই স্কুল খুলুক বাংলাদেশের নিয়ম মেনেই চালাতে হবে। বাংলাদেশে বসে অবৈধভাবে উর্দু শেখালে সে বিষয়ে অবশ্যই তাদের সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে বিষয়টি নিয়ে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডও চাইলে ব্যবস্থা নিতে পারে এ আমি বিষয়টা দেখছি। এ বিষয়ে ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, এ ধরনের কোন প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন নেই। এছাড়া ইংরেজী মাধ্যম বলে দাবি করা হলেও সেখানে এখন বাংলাদেশ স্টাডিজ পড়াতেই হবে। এদিকে সিটি স্কুল কেবল শিক্ষার্থীদের উর্দুতেই উদ্বুব্ধ করছে না, শিক্ষকদের সঙ্গেও করছে বৈষম্যমূলক আচরণ। স্কুলটির পাকিস্তানী অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। স্বৈরাচারী কায়দায় তিনি স্কুল পরিচালনা করেন বলে একাধিক শিক্ষক ও কর্মকর্তা অভিযোগ করেছেন। শিক্ষকদের জন্য তৈরি করা সার্ভিস রুল না মানা, যখন তখন শিক্ষক ছাঁটাই ও বেতন বৈষম্যের অভিযোগও আছে স্কুল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। এ বিষয়গুলোর জন্য অধ্যক্ষ মারিয়া কাশিফকেই দুষেছেন অনেকে। স্কুলের এক সিনিয়র শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এখানে কোন সার্ভিস রুল মানা হচ্ছে না। প্রিন্সিপাল তার ইচ্ছামতো যা খুশি, তাই করছে। শিক্ষকদেরও যখন তখন ছাঁটাই করে দিচ্ছে। স্কুলটির সাবেক প্রশাসনিক কর্মকর্তা জামান বলেন, স্কুলের অনিয়ম শুরু থেকেই ছিল। এসব অনিয়ম বন্ধে আমি একাধিকবার উর্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে লিখেছি। শেষ পর্যন্ত ঠিক হয়নি বলে আমি চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। স্কুলের প্রিন্সিপাল মারিয়া কাশিফের সঙ্গে প্রথমে যোগাযোগ করা হলে প্রথমে ব্যস্ততা দেখিয়ে ১০ দিন পরে আবার যোগাযোগ করার কথা বলেন। সে অনুযায়ী ১০ দিন পরে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।
×