ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

কাউন্সিল কর্মকর্তা-কর্মচারী ছাড়া অন্যদের কোন সুযোগ না থাকলেও কাজটি করছেন বহিরাগতরা

বার কাউন্সিলের ভোটার তালিকা সংশোধন নিয়ে নতুন বিতর্ক

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ১৮ মে ২০১৫

বার কাউন্সিলের ভোটার তালিকা সংশোধন নিয়ে নতুন বিতর্ক

আরাফাত মুন্না ॥ বিতর্ক যেন পিছু ছাড়ছে না বার কাউন্সিল নির্বাচনের। ভোটার তালিকায় অনিয়ম নিয়ে বিতর্কের মুখে এক দফা নির্বাচন পেছানোর পর, এবার ভোটার তালিকা সংশোধনের কাজ করছেন বহিরাগতরা। বার কাউন্সিলের কর্মকর্তা বা কর্মচারী ছাড়া অন্যদের দিয়ে এ কাজ করানোর সুযোগ না থাকলেও খোদ কাউন্সিলের নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যানের কক্ষে বসেই তারা এ কাজ করেন। রবিবার জনকণ্ঠের অনুসন্ধানে এ বিষয়টি ওঠে আসে। বার কাউন্সিলের একাধিক সূত্র জনকণ্ঠকে জানিয়েছে, গত ৯ এপ্রিল প্রকাশিত ভোটার তালিকায় অসংখ্য দ্বৈত ভোটার থাকায় ভোটার তালিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন বার কাউন্সিলেরই বিদায়ী পাঁচ সদস্য। তাদের অভিযোগ কারো নাম ভোটার তালিকার ৫ থেকে ৮ জায়গায় ছাপা হয়েছে। তালিকায় আইনজীবীদের এনরোলমেন্টের তারিখ ও স্ব স্ব বারের সদস্য নম্বর না থাকায় তালিকার সবাই বৈধ ভোটার কি না, তা শনাক্ত করা সম্ভব নয় বলে অভিযোগ করেন ওই পাঁচ সদস্য। এই পাঁচ সদস্যের দাবি এবং গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর গত ১২ মে বার কাউন্সিলের জরুরী তলবি সভা ডাকা হয়। ওই সভায় সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন সম্পন্ন করতে সাতদিন পেছানো হয় ভোট গ্রহণের দিন (২০ মে’র পরিবর্তে ২৭ মে)। এছাড়া ভোটার তালিকা ত্রুটিমুক্ত করতে নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান এজে মোহাম্মদ আলীকে দায়িত্ব দেয়া হয়। সূত্র জানায়, ১৩ মে থেকেই ভোটার তালিকা সংশোধনের কাজ শুরু করেন কাউন্সিলের নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান। তবে এই কাজে কাউন্সিলের কোন কর্মকর্তা বা কর্মচারীকে সঙ্গে নেননি তিনি। বরং কয়েকজন বহিরাগতকে দিয়ে কাজ করাচ্ছেন। জনকণ্ঠের কাছে অভিযোগ আসে, বহিরাগতরা ভোটার তালিকা সংশোধন সংক্রান্ত কাজ শেষ করার পর তা পাঠানো হয় কাউন্সিলের কম্পিউটার বিভাগে। উল্লেখ্য, বার কাউন্সিলের বর্তমান নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান নিজে এবারও নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এ অভিযোগের ভিত্তিতে রবিবার জনকণ্ঠের অনুসন্ধানে যায় বার কাউন্সিলে। শুরুতে এই প্রতিবেদক কাউন্সিলের সচিব (জেলা ও দায়রা জজ) মোহাম্মদ আলতাফ হোসাইনের সঙ্গে দেখা করেন। তার কাছে বার কাউন্সিলের ভোটার তালিকা সংশোধন কাজে কাউন্সিলের বাইরের কারো কাজ করার সুযোগ রয়েছে কি-না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ ধরনের কোন সুযোগ নেই। বার কাউন্সিলের নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান বিষয়টির জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত, তিনিই এই কাজ করবেন। প্রয়োজনে তিনি কাউন্সিলের যে কাউকে সঙ্গে নিতে পারেন। ভোটার তালিকা সংশোধনে বহিরাগতরা কাজ করছে, এমন অভিযোগের কথা বলা হলে, বার কাউন্সিলের সচিব জানান, এ ধরনের কোন খবর তার কাছে নেই। এ বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। পরে বেলা ১১টা ৫০ মিনিটে বার কাউন্সিল ভবনের দ্বিতীয় তলায় নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান এজে মোহাম্মদ আলীর কক্ষে গিয়ে দেখা যায় তিনি সেখানে নেই। তবে দুজন বার কাউন্সিলের ভোটার তালিকা সংশোধনের কাজ করছেন। একজন বসা এবং অন্যজন দাঁড়িয়ে তাকে সহযোগিতা করছেন। এ প্রতিবেদক তাদের পরিচয় জানতে চাইলে বিষয়টি এড়িয়ে যায় তারা। পরে প্রতিবেদক নিজের মোবাইলে তাদের কর্মকা-ের ভিডিও ধারণ করা শুরু করলে বসা ব্যক্তি দাঁড়িয়ে দরজা বন্ধ করে দেন বহিরাগত একজন এবং বলেন, আপনি ছবি তুলেছেন কেন? ছবি ডিলিট করুন। প্রতিবেদক ওই রুম থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করলে তিনি বাধা দেন। পরে প্রতিবেদক আবারও তাদের পরিচয় জানতে চাইলে তিনি বার কাউন্সিলের নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান এজে মোহাম্মদ আলীর জুনিয়র আইনজীবী বলে পরিচয় দেন এবং তার নাম সালেহ উদ্দিন বলে জানান। অন্যজন চেয়ারম্যানের ক্লার্ক বলেও জানান তিনি। ক্লার্কের নাম আমিনুল। পরে সালেহ উদ্দিন ভিডিও ডিলিট করার শর্তে জনকণ্ঠকে বলেন, এজে মোহাম্মদ আলী তাদের সহযোগিতা করতে বলেছেন। তাই তারা কাজ করছেন। তারা দুইজনই বার কাউন্সিলের কেউ নন বলে জানান। পরে এ প্রতিবেদক ভিডিওটি ডিলিট করে কক্ষ ত্যাগ করে আবারও কাউন্সিলের সচিবের কাছে যান (পরে রিকভারি সফটওয়ারের মাধ্যমে ভিডিওটি উদ্ধার করা হয়েছে)। এ সময় তার সঙ্গে সালেহ উদ্দিনও যান সচিবের কক্ষে। বার কাউন্সিলের সচিব মোহাম্মদ আলতাফ হোসাইনের কাছে সালেহ উদ্দিনের কর্মকা- সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কিছুই জানে না বলে জানান। এরপর সালেহ উদ্দিন আবারও নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যানের কক্ষে চলে যান। জনকণ্ঠ অনুসন্ধান টিম আবারও তার পিছু নিলে তিনি ওই কক্ষ থেকে কাগজপত্র নিয়ে দ্রুত বার কাউন্সিল এলাকা ত্যাগ করেন। এ বিষয়ে বার কাউন্সিলের নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান এজে মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে কথা বলতে তার মোবাইল একাধিকবার ফোন করা হলে তিনি রিসিভ করেননি। বিতর্কের শুরু ॥ গত ২৫ মার্চ এ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর ৯ এপ্রিল ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হয়, যাতে কাউন্সিলের ভোটার সংখ্যা দেখানো হয় ৪৮ হাজার ৪৬৫ জন। তবে এ তালিকায় ‘অস্পষ্টতা ও একই নাম একাধিকবার’ থাকার কথা জানিয়ে কাউন্সিলের বিদায়ী পাঁচ সদস্য এবং ১০১ জন আইনজীবী গত ২৯ এপ্রিল আলাদাভাবে কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ও সচিবকে চিঠি দেন। এতে অভিযোগ আসে, আইনজীবীদের নিয়ন্ত্রক সংস্থা হলেও কাউন্সিল নিজস্ব নথিপত্রের সাহায্য না নিয়ে আইনজীবী সমিতিগুলোর পাঠানো সদস্য তালিকা ধরেই ভোটার তালিকা তৈরি করেছে। কাউন্সিলের যে পাঁচ সদস্য তালিকা নিয়ে আপত্তি তুলে চিঠি দিয়েছেন তারা হলেন- সৈয়দ রেজাউর রহমান, এইচ আর জাহিদ আনোয়ার, আব্দুল মতিন খসরু, এম এম মুজিবুর রহমান ও তানিয়া আমীর। তালিকা প্রকাশের কোন প্রক্রিয়ার সঙ্গে তারা ছিলেন না জানিয়ে চিঠিতে বলা হয়, এ ভোটার তালিকা ‘স্বচ্ছভাবে’ হয়নি। কোন নির্বাচিত সদস্য এ কাজের সঙ্গে ছিলেন বলেও তারা জানেন না। এ ভোটার তালিকায় আইনজীবীদের তালিকাভুক্তির নম্বর ও তারিখ, ভলিউম নম্বর ও সনদের পৃষ্ঠা সংখ্যার কোন কলাম নেই বলেও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। দুই কেন্দ্রের ভোটার তালিকায় নাম এসেছে, এমন সাতজন আইনজীবীর উদাহরণ তুলে ধরে এতে চিঠিতে বলা হয়, এ রকম হাজারও ভোটারের নাম একাধিকবার এসেছে বলেই তাদের সন্দেহ। ১০১ জন আইনজীবীর স্বাক্ষরে বার কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ও সচিবকে পাঠানো চিঠিতেও ভোটার তালিকা নিয়ে আপত্তি তোলা হয়। চিঠিতে বলা হয়, একাধিক জেলা বারের সদস্য হিসেবে অনেকের নাম একাধিক জেলা বারের তালিকায় স্থান পেয়েছে। আবার সুপ্রীমকোর্ট বার ও ঢাকা বারের ভোটার তালিকায় থাকা এক ব্যক্তির নামও দুইবার কাউন্সিলের ভোটার তালিকায় এসেছে। এ অবস্থায় ‘জালিয়াতি ঠেকাতে’ তালিকা সংশোধন করে পুনঃপ্রকাশের দাবি জানান ১০১ আইনজীবী। বার কাউন্সিল নির্বাচন স্থগিত চেয়ে দুটি রিট ॥ বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের নির্বাচনের তফসিল অবৈধ ঘোষণা ও নির্বাচন স্থগিত চেয়ে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় দুটি রিট দায়ের করা হয়েছে। রিটকারী আইনজীবী ইউনুছ আলী আকন্দ জানিয়েছেন, আজ সোমবার বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি আবু তাহের মোঃ সাইফুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চে রিটের শুনানী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। রিটকারী আইনজীবী জানিয়েছেন, নির্বাচনের তফসিল অবৈধ ও নির্বাচন স্থগিত চাওয়ার পাশাপাশি ২০০৩ সালের বার কাউন্সিল সংশোধনী এ্যাক্টের ৩ ধারা কেন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে না তাও জানতে চাওয়া হয়েছে। এ ছাড়া একজন আইনজীবী ১৪টি ভোট দেয়ার ক্ষমতা রাখেন। কিন্তু ১৯৭২ সালের মূল আইনটি পরিবর্তন করে ৭টি ভোট কমিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু ১৯৭২ সালের রুলস পরিবর্তন করা হয়নি। রুলসে ১৪টি ভোট দেয়ার কথা উল্লেখ করা আছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের নির্বাচন ২৭ মে অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সম্মিলিত আইনজীবী সমন্বয় পরিষদ, জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ঐক্য প্যানেল, ঐক্যবদ্ধ আইনজীবী সমাজসহ পাঁচটি প্যানেল রয়েছে। বার কাউন্সিলের সাতটি সাধারণ আসনে ৩২ জন ও সাতটি গ্রুপ আসনে ২৯ জন সহ মোট ৬১ জন এবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। সারা দেশের ৮০টি বারের মধ্যে ৭৭টি কেন্দ্রে এবার ৪৮ হাজার ৪৬৫ আইনজীবী আগামী তিন বছরের জন্য নেতৃত্ব নির্বাচন করবেন।
×