ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

পুলিশের বুট জঙ্গী ও নারী নির্যাতকদের জন্য নয়!

প্রকাশিত: ০৪:১৭, ১৮ মে ২০১৫

পুলিশের বুট জঙ্গী ও নারী নির্যাতকদের জন্য নয়!

পুরো পুলিশ বাহিনীর জন্য অতি অবমাননাকর, অতি অসম্মানজনক এবং আমাদের জন্য প্রবল ক্রোধ সঞ্চারকারী দৃশ্যÑ স্বাধীন বাংলাদেশের লক্ষো শহীদের আত্মত্যাগের ফলে অর্জিত দেশের পুলিশ বাহিনী কর্তৃক বাংলা নববর্ষের দিনে ঘৃণ্য নারী নির্যাতকদের গ্রেফতার দাবিতে মিছিলরত নিরীহ নিরস্ত্র তরুণ-তরুণী ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর বুটের লাথি এবং হাতের লাঠি দিয়ে চালানো বেপরোয়া তাণ্ডব দেখে শিউরে উঠলাম! পুলিশের আইজিকে বলবÑ ঐ ক’জন তরুণ-তরুণী কি চাপাতি-কিরিচ-বন্দুক নিয়ে মুখোশ পরে আপনাদের আক্রমণ করতে গিয়েছিল? ওদেরকেই তো নারী নির্যাতক, জঙ্গীর চাপাতি থেকে আপনাদের রক্ষা করার কথা! তাই নয় কি? স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীসহ আপনাদের সবাইকে প্রশ্ন করছিÑ ১. আইজিকে ঘেরাও করতে যাওয়া ছাত্র ইউনিয়নের ভদ্র, সভ্য ছোট একটি দলের ওপর আপনারা মশামারতে কামান দাগার ব্যবস্থা গ্রহণ করে নিজেদের অসংখ্য অর্জনকে মলিন করলেন কেন? এটা জানি, পুলিশ সদস্য যে দু-তিনজন নিরস্ত্র তরুণ-তরুণীদের ওপর জঘন্য বুটের হামলা, তরুণদের ওপর লাঠিচার্জ, টিয়ারশেল ছুড়ে অপ্রয়োজনীয় শৃঙ্খলা রক্ষার সীমা লঙ্ঘন করেছে, তারা অবশ্যই বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নতুন অর্জিত সম্মানকে আঘাত ও ম্লান করার কাজটিই করেছে! এরা আর যাই হোক বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার রাজনীতির প্রতি অনুগত নয়, যার প্রমাণ তাদের অতি আস্ফালন-তাণ্ডবই যথেষ্ট! ২. স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ বাহিনী নিশ্চয় জানে যে ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতি করা ছাত্র-ছাত্রী, তরুণরা কোনদিন কোন মারপিট, বন্দুকবাজি, টেন্ডারবাজি, অর্থ নিয়ে অনর্থ করার অপরাজনীতি করেনি। এবং কখনও নিয়োজিত হয়নি খুন-খারাবির মতো অপ-রাজনৈতিক কাজে। এদের ওপর যখন বাঙালী পুলিশের বুটের লাথি, লাঠিচার্জ, টিয়ারশেল পরিচালিত হচ্ছিল, তখন অন্য জেলায় ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগের অন্তর্দ্বন্দ্বে, গোলাগুলিতে মানুষ খুন হচ্ছিল! এই সেদিন ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র নিহত হলো! প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর ঘোষণাÑ আইন সবার ক্ষেত্রে একই পথে চলবে, তা কেন এ ক্ষেত্রে চলেনি, সে দায় পুলিশের ঐ দু-তিনজনকে নিতে হবে এবং সরকারের ভাবমূর্তি ম্লান করার জন্য দণ্ড দিতে হবে। ৩. এবার মূল ঘটনার প্রতি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। সংবাদপত্র সূত্রে জনগণ জানতে পেরেছে ২০১৩ সালেই ঐ ‘তেঁতুল হুজুর’, যে নারীকে তেঁতুলের মতো জিভে জল আসা খাদ্যবস্তু হিসেবে উল্লেখ করেছিল, তারই দল হেফাজতে ইসলাম যখন নরখাদক খালেদার নির্দেশে ঢাকায় তাণ্ডব চালিয়ে ঢাকা অচল, সরকার পতন, দেশ ধ্বংসের কাজটি করেও ব্যর্থ হয়, তারপর সরকারকে ৮৪ জন তরুণ, বিজ্ঞানমনস্ক ব্লগের লেখকের তালিকা তুলে দিয়েছিল তাদের সংজ্ঞায় ‘অ-মুসলিম’, ‘নাস্তিক’ হিসেবে বিচার করার জন্য! এ তথ্য জেনে বিস্ময়বোধ করছি যে, নারীকে তেঁতুল গণ্য করার জন্য যে ব্যক্তির বিচার ও দণ্ড আমরা দাবি করতে পারি এবং অবশ্যই নারীকে তেঁতুল গণ্য করা যখন পশ্চিমা সংস্কৃতির মতোই নারীকে ভোগ্যপণ্য করার সঙ্গেই একমাত্র তুলনীয়, মূর্খ যে লোক গার্মেন্ট বা অফিসে চাকরি করাকে ‘যৌন কর্ম’ করতে যাওয়া গণ্য করে, নারীর উচ্চশিক্ষাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে, তখন তার ও তার অনুসারীদেরই তো বর্তমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষার যুগে বিচারের আওতায় আনার জন্য জনগণ, দেশের নারী ও পুরুষ সবাই দাবি জানায় এবং ঠিক করে দেয়! সে সময় কথিত কোটি কোটি টাকার আদান-প্রদানের প্রমাণ না থাকলেও, ঐ হেফাজত-মোল্লারা নিজেরাই সবার চাইতে বেশি জানে, তারা কে কত কোটি টাকা গ্রহণ করে খালেদার নির্দেশে ‘ঢাকা-তাণ্ডব’ সংঘটিত করেছিল! তারা তো ধার্মিক, ইসলামী মোল্লা, তারা মিথ্যা বলতে পারে না, তারাই বলুক, তারা কি আর ইসলাম ধর্ম মতের অনুসারী রয়েছে? ব্লগাররা কি নারীকে ভোগ্যপণ্য হিসেবে কখনও চেয়েছে? অথবা তারা কি দেশের কোন জমি দখল করে দেশ ধ্বংসকারী জঙ্গী দলের জন্ম দিয়েছে? তারা কি কখনও কোটি কোটি টাকার বিনিময়ে দেশ ধ্বংসের নাশকতামূলক কোন কাজ করেছে? হেফাজতওয়ালা মোল্লারা উপরোক্ত প্রতিটি প্রশ্নের উত্তরে মনে মনে না-সূচক উত্তরই পাবে! বরং তাদের কাছে প্রশ্ন, পহেলা বৈশাখে যে সাদা পাঞ্জাবি দাড়িওয়ালা, লম্বা ব্যক্তিটি চার-পাঁচজন টিশার্ট পরিহিত তরুণদের সন্ধ্যায় সোহরাওয়ার্দী মাঠের গেটের কাছে ’৭১-এর রাজাকারদের মতোই কয়েকজন নারীর সম্ভ্রম বিনষ্ট করছিল, তারা কি হেফাজতি মতে ‘খাঁটি মুসলিম’-এর কাজ করছিল? হেফাজত-মোল্লার নীরবতা ঐ জঙ্গী নারী নির্যাতকদের জন্মদাতাই প্রমাণ করে, তাই নয় কি? ঐ নারীর সম্ভ্রম হানিকারীরা কি তাহলে তাদের তেঁতুল হুজুরের অনুসারী নারীকে অন্দরে বন্দী রাখার পক্ষে হেফাজতের ইশারায় পদক্ষেপ নিয়েছিল? এরাই কি ইসলামের খাঁটি অনুসারী? এরা যতই জামায়াতের মতো ইসলামকে পুঁজি করে ধন-সম্পদ আর জঙ্গী তৈরির কারখানা স্থাপন করুক, জনগণ নিঃসন্দেহ যে, এরাই মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধের ধর্মনিরপেক্ষতা, বাঙালীর দেশের মাটি থেকে উৎসারিত উৎসব- অনুষ্ঠান, যাত্রাপালা, মেলা, লোকনৃত্য, সঙ্গীত এমন কি মাতৃভাষা বাংলার বিরোধী শুধু নয়, এসবের ওপর হামলাকারী! ছাত্র ইউনিয়নের যে তরুণটি ঐ ভিড়ের মধ্যে আক্রান্ত তরুণীদের রক্ষার চেষ্টা করে পরে একজন হামলাকারীকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়, সে হামলাকারীকে থানা পুলিশ সসম্মানে কেন ছেড়ে দেয়? এর চাইতে পুলিশ বাহিনীর আইজি ও অন্য কর্মকর্তার জন্য বিব্রতকর অবস্থা আর কিছু কি হতে পারে! এটা স্পষ্ট যে, ঐ হামলাকারীরা তো বাংলা নববর্ষে বাঙালী তরুণীদের অংশগ্রহণকে বন্ধ করতেই ঐ পরিকল্পিত নারীর ওপর হামলা পরিচালনা করেছিল! আইজি বলেছেন- ওখানে শত শত পাবলিক ছিল, তারা হামলাকারীদের ধরল না কেন? এর উত্তর হচ্ছেÑ তাহলে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী পুলিশের প্রয়োজন কি? তাদের বেতন-ভাতা কেন দেবে জনগণ? তাদের কর্তব্য কি? লিটন নন্দী তো একজনকে ধরেছিল, কেন পুলিশ কিসের বিনিময়ে তাকে ছেড়ে দিল? ওখানে পুলিশ ছিল, ঘটনা ঘটতে দিয়ে পরে জঙ্গীদের চলে যেতে এবং তারপর বীরবিক্রমে দিয়ে নিরীহ তরুণদের ওপর লাঠিচার্জ করেছে! এই নাটক আমরা আর দেখতে চাই না! তারপর এখনও দীর্ঘদেহী, সাদা পাঞ্জাবি পরা, দাড়িওয়ালা মধ্যবয়সী জঙ্গী গ্রেফতার হয় না কেন? তার নির্দেশ পালনকারী টিশার্ট পরা, দাড়িহীন জঙ্গীরা গ্রেফতার হয় না কেন? এখানে আমি আইজিসহ পুলিশ কর্মকর্তাদের দৃঢ়ভাবে বলতে চাইÑ আমাদের দেশের পুলিশকে আমি আমেরিকা, যুক্তরাজ্যের পুলিশের চাইতে অনেক দক্ষ ও বুদ্ধিমান মনে করি, যারা ওপর মহলের বাধা না থাকলে, নির্দেশ পেলে অসম্ভব স্থান থেকেও জঙ্গী, গোলাবারুদ, জেহাদী বই পুস্তক, অস্ত্রসহ গ্রেফতার করতে সক্ষম। সুতরাং জনগণ, আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ এবং এর নেত্রী শেখ হাসিনার সুরক্ষার জন্য চিন্তিত থাকি, তাদের সহজ এবং পরিষ্কার দাবি হচ্ছেÑ ১. পহেলা বৈশাখের সন্ধ্যায় নারী নিগ্রহকারী ও এর নেপথ্য পরিকল্পকদের দ্রুত গ্রেফতার ও বিচার। ঐ স্থানের সিসিটিভির ফুটেজ, ’৭১ টিভির প্রতিবেদন, উপস্থিত তরুণ-তরুণীদের সাক্ষ্যসহ অন্যান্য পরোক্ষ প্রমাণের ভিত্তিতে তাদের শনাক্ত করে গ্রেফতার করা অসম্ভব নয় বলে মনে করি। এছাড়া ধরে দেয়া হামলাকারী কে, তাকে কি হেফাজতের হুমকিতে ছেড়ে দেয়া হয়েছে? থানায় তার নাম, ঠিকানা নিশ্চয় লিখিত আছে, ফটোও তুলে রাখার কথা, তাকে আবার ধরুন এবং তার কাছ থেকে গোপন তথ্যগুলো জেনে কাজ করুন। তাকে ছেড়ে দিয়েছে যে থানা কর্মকর্তা, তার বিচার ও শাস্তিও হতে হবে। ২. পহেলা বৈশাখে নারী নিগ্রহকারীদের গ্রেফতার দাবিকারী স্বল্পসংখ্যক ছাত্র ইউনিয়নের নেতাকর্মীর ওপর অকারণ বর্বরোচিত হামলায় তরুণ-তরুণীদের ওপর বুটের লাথি, লাঠিচার্জকারী পুলিশদের অবশ্যই গ্রেফতার করে চাকরিচ্যুত করা ও উপযুক্ত দণ্ড দিতে হবে। এভাবে পুলিশ বাহিনী থেকে মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধী, খালেদা-জামায়াত জঙ্গীপন্থীদের বের করে দিয়ে বাহিনীকে আরও মানবিক, দায়িত্বশীল, দেশ ও জাতি-প্রেমিক করে তোলা সম্ভব হবে। অন্যথায় ওদের মধ্যে হেফাজত, জামায়াত, খালেদাপ্রেমীরা মুক্তিযুদ্ধপন্থী সরকারের ভাবমূর্তি বিনষ্টে একের পর এক ঘটনা ঘটিয়ে যেতেই থাকবে। সব শেষে বলব, রাজীব, দ্বীপ, ওয়াশিকুর, অভিজিত, অনন্ত আরও যারা জঙ্গীদের হাতে খুন হয়েছেÑ তাদের নাম হেফাজতের তৈরি ‘অমুসলিম’দের তালিকায় যখন আছে, তখন এবার জনগণকে ‘তরুণ-তরুণীদে’র সঙ্গে নিয়ে প্রগতিশীল মুক্তিযুদ্ধপন্থীরা-‘ভ- মুসলিম’দের একটি তালিকা প্রণয়ন করতে হবে, যাদের মধ্যে বড় যুদ্ধাপরাধীদের নাম থাকবে এবং নারীকে তেঁতুলের সঙ্গে তুলনা করে ভোগ্যসামগ্রী বানানোর দোষে দোষীদেরও নাম থাকবে, নাম থাকবে মাদ্রাসা, এতিমখানার, মসজিদের ভেতরে জঙ্গী কারখানাগুলোর। হেফাজতওয়ালাদের মনে রাখতে হবেÑ এদেশের জন্মের তারা বিরোধিতাকারী! তাদের বিচার সরকার না করলে সাধারণ একজন ব্লগার, যে কোন নাগরিক শুরু করতে পারে! তাদের তৈরি তালিকাটি কিন্তু এই ব্লগার হত্যাকাণ্ডের সূচনা করেছে, ঠিক যেভাবে ’৭১-এ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা তৈরি করে হত্যা করা হয়েছিল! সুতরাং খুনীদের সমান দোষে তারাও দোষী! আরও মনে রাখতে হবেÑ ইসলাম কোন মসজিদ, মাদ্রাসা, হেফজখানা, এমন কি আরবি ভাষায় বন্দী নয়। তাহলে জ্ঞান অর্জনের জন্য চীনে যেতে মোহাম্মদ (স.) বলতেন না। এসব অশুভ, অন্ধ ধারণার অনুসারীরা হত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে পারবে, কিন্তু আধুনিক শিক্ষা ও বিজ্ঞান শিক্ষাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারবে না। জ্ঞান বিজ্ঞান তার নিজস্ব পথে তরুণ প্রজন্মের হাত ধরে এগিয়ে যাবেই। শেষ পর্যন্ত, শেষ লড়াই যুগের সঙ্গে তাল রেখে চলতে সক্ষম তরুণ-তরুণীরাই জিতবে। সব শেষে, সরকারপ্রধানকে বলবÑ ভয়ঙ্কর দেশবিরোধী শক্তির সঙ্গে কোন এ্যাপিজমেন্ট চুক্তিতে যাবেন না, ওতে কখনও শেষ রক্ষা হয় না। আপনার, আমাদের সুরক্ষাকারীরা হচ্ছে আধুনিক দেশপ্রেমিক, শিক্ষিত তরুণ-তরুণী। সেজন্য ওদের হাতে চাপাতি, কিন্তু এদের হাতে বই-কলম-ল্যাপটপ। ওরা নির্দয়, নিষ্ঠুর; কিন্তু এরা যুক্তিবোধ দৃঢ় ও দেশপ্রেমিক। নাটকের শেষ অঙ্কে মুক্তিযোদ্ধাই জেতে, যুদ্ধাপরাধীরা পরাজিত হয়।
×