ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

সমুদ্রে পেতেছি শয্যা শেষ;###;মানব পাচার বেড়েছে ৫ শতাংশ

জাতিসংঘের হিসাবে প্রতি বছর শরণার্থী হচ্ছে সাড়ে চার কোটি মানুষ

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ১৭ মে ২০১৫

জাতিসংঘের হিসাবে প্রতি বছর শরণার্থী হচ্ছে সাড়ে চার কোটি মানুষ

রাজন ভট্টাচার্য ॥ বিশ্ব ইতিহাসে মানব পাচার বা দাসত্ব নতুন কোন ঘটনা নয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর আদল পরিবর্তন হয়েছে মাত্র। সব সময়েই সমাজের শোষিত ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠীই পাচারের মতো ভয়াবহতার শিকার হয়েছে। ইতিহাস বলছে, মূলত দাসপ্রথার চরম বিকাশ ও দাস মালিক দ্বারা চরম নির্যাতন গ্রীক-রোমান সাম্রাজ্যে দেখা যায়। প্রাচীনকালে এবং মধ্যযুগেও সমাজে মানুষ বেচা-কেনার প্রথা ছিল। বিভিন্ন মূল্যের বিনিময়ে মানুষ কেনা যেত। এই প্রচলিত প্রথাটিকেই দাস প্রথা বলা হয়ে থাকে। বর্তমানে যেমন পণ্য বেচা-কেনার বাজার রয়েছে। অতীতে সেরকমই দাস-দাসী বিক্রি অথবা ক্রয়ের জন্য আলাদা বাজার ছিল। তখন দাস-দাসী আমদানি এবং রফতানিতে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন হতো এবং তা দেশের অর্থনীতিতে প্রভাব রাখত। সাধারণত দাস-দাসীরা আফ্রিকান হতো। আফ্রিকান দাসদের মধ্যে হাবশি ও কাফ্রির চাহিদা ছিল বেশি। বাংলায় এসব দাস-দাসী ৫ থেকে ৭ টাকায় কেনা যেত। সুস্বাস্থ্যের অধিকারী দাস কিনতে লাগত ২০ থেকে ২২ টাকা। দাসদের দিয়ে দুই ধরনের কাজ করানো হতো- কৃষিকাজ ও গার্হস্থ্য কাজ। তখন দাস রাখা একটি সামাজিক মর্যাদার ব্যাপার ছিল। তাছাড়া উচ্চবিত্তরা দাসদের দিয়ে বিভিন্ন কায়িক পরিশ্রমের কাজ করাত। যেমন ঘানি ভাঙানো, আখ মাড়াই, হাল চাষ, সেচের পানি, গবাদী পশুপালন, বৃক্ষাদির পরিচর্যা ইত্যাদি। দাসীদের রাখা হতো সাধারণত যৌন লালসা চরিতার্থ করার জন্য। তাদের উপপতœী করে রাখা হতো এবং তাদের সন্তানদের দাস রূপে রাখা হতো বা বিক্রি করা হতো। ওইসব সন্তানরা স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির ওয়ারিশ হতে পারতো না। ব্রিটিশ সরকার ১৮৪৩ খ্রীস্টাব্দে এবং আমেরিকার সরকার ১৮৬২ খ্রীস্টাব্দে দাস-দাসী আমদানি ও রফতানি সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করে। এরপর মানব পাচারে শুরু হয় নতুন মাত্রা। এখন গরিব, উন্নয়নশীল যুদ্ধবিধ্বস্ত, সন্ত্রাস কবলিত দেশগুলোকে মানব পাচারের লক্ষ্যবস্তু হিসেবে বেছে নিয়েছে পাচারকারীচক্র। বর্তমানে পাচারের ভয়াবহতার কারণে নড়ে বসেছে গোটা বিশ্ব সম্প্রদায়। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও এ ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে। তারা বলছেন, মানব পাচার গোটা বিশ্বে প্রকট আকার ধারণ করেছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা জোরপূর্বক শ্রম দেয়াকে দাসত্ব হিসেবে গণ্য করে না। তাদের হিসাব অনুযায়ী এখনও বিশ্বের ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ জোরপূর্বক শ্রম, দাসত্ব ও দাসপ্রথার কাছে বন্দী। অন্য সময়ের তুলনায় মানব পাচার বেড়েছে পাঁচ ভাগ। বিশ্বের ১২৪টি দেশে মানব পাচারের ঘটনা ঘটছে। বছরে ২৪ লাখের বেশি মানুষ পাচারের শিকার। তাদের মধ্যে ৮০ ভাগ নারী ও শিশু। বছরে তিন হাজার কোটি ডলার আয় করছে পাচারকারী চক্র। এছাড়া বছরে শরণার্থী হচ্ছে সাড়ে চার কোটি মানুষ। তাদের মধ্যে অর্ধেক দেশ ত্যাগ করছে। হচ্ছে পাচার। পাচার রোধে হিমশিম খাচ্ছে এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা, অট্রেলিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ। ক্ষমতাধর আমেরিকাও এ সমস্যার বাইরে নয়। ক্রীতদাসবিরোধী গোষ্ঠী ওয়াক ফ্রি বলছে। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার শূন্য দশমিক পাঁচ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ৩ কোটি ৬০ লাখ মানুষ আধুনিক ক্রীতদাসের জীবনযাপন করে। মানুষকে জোরপূর্বক শ্রমে বাধ্য করা, ঋণের দায়ে আটকে পড়া, পাচারের শিকার হওয়া ইত্যাদি বিষয়কে আধুনিক ক্রীতদাসের লক্ষণ বলছে ওয়াক ফ্রি। বিশ্বের ১৬৭টি দেশে ক্রীতদাসের প্রমাণ পাওয়া গেছে। আফ্রিকা এবং এশিয়ার দেশগুলোই এ সমস্যা বেশি মোকাবেলা করছে। ইউরোপে এই সমস্যা অনেক কম। ক্রীতদাস সূচকে বিশ্বে সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি ক্রীতদাস ভারতে রয়েছে। আর জনসংখ্যার শতকরা হারে সবচেয়ে বেশি ক্রীতদাস রয়েছে মৌরিতানিয়ায়। ভারতে ১ কোটি ৪০ লাখ লোক ক্রীতদাসের মতো জীবন কাটায়। এরপরেই আছে চীন। এখানে ৩০ লাখেরও বেশি লোক ক্রীতদাসের জীবন পার করে। তৃতীয় ও চতুর্থ স্থানে রয়েছে পাকিস্তান, উজবেকিস্তান। ক্রীতদাস সূচকের পঞ্চম স্থানে আছে রাশিয়া। এই দেশটির নির্মাণ শিল্প ও কৃষি খাত অভিবাসী ক্রীতদাসদের শ্রমের ওপর নির্ভরশীল। মৌরিতানিয়ায় সেই জনসংখ্যার ৪ শতাংশ ক্রীতদাসের জীবন যাপন করে। আফ্রিকার অনেক দেশের মানুষ উত্তরাধিকার সূত্রে ক্রীতদাসের জীবন পার করতে বাধ্য হন। উজবেকিস্তানে মোট জনসংখ্যার ৩ দশমিক ৯ শতাংশ মানুষ ক্রীতদাসের জীবন কাটায়। জনসংখ্যার হারে এর পরের দেশগুলো হলো হাইতি ২ দশমিক ৩ শতাংশ, কাতার ১ দশমিক ৩৬ শতাংশ, ভারত ১ দশমিক ১৪ শতাংশ। জাতিসংঘ যা বলছে, প্রতিবছর সাড়ে চার কোটি মানুষ শরণার্থী হচ্ছে। এর মধ্যে পৌনে তিন কোটিই সীমান্ত অতিক্রম করে অন্য দেশে যাচ্ছে। এদের ৫৫ শতাংশই যুদ্ধের কারণে দেশ ত্যাগ করছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দারিদ্র্য বেড়ে যাওয়ার কারণে সাগর কিংবা দুর্গম স্থল পথে মানব পাচার যে কোন সময়ের তুলনায় বেড়েছে। ফিরে দেখা ॥ ভারতবর্ষে আর্যদের আগমনের সঙ্গে দাসপ্রথার বিকাশ ঘটে। তবে গ্রিস ও রোমে যেভাবে দাসদের নির্মম এবং অমানবিকভাবে অত্যাচার করা হতো ভারতবর্ষে তেমনই ছিল না। দাসদের উৎপাদনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হতো না বরং ঘরের কাজেই তাদের ব্যবহার করা হতো। মূলত আধুনিক দাসরা নানা কাজে ব্যবহৃত হয়। অপরাধমূলক কার্যক্রম, মাদক চোরাচালান থেকে শুরু করে এমন কোন কাজ নেই যেখানে দাসরা ব্যবহৃত হচ্ছে না। ওয়াক ফ্রি বলছে, বাংলাদেশের ৬ লাখ ৮০ হাজার ৯শ’ মানুষ আধুনিক দাসের জীবন যাপন করে। নারী ও শিশুরা ইটভাটা থেকে শুরু করে রফতানিমুখী শিল্পসমূহে দাস হিসেবে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। আদিম থেকে আধুনিক সমাজ বিকশিত হয়েছে, কিন্তু দাসপ্রথা আধুনিক সমাজ থেকে উঠে যায়নি। ১৮৪৩ সালে এ্যাক্ট ফাইভ আইন দ্বারা ব্রিটিশ সরকার সকল দাস আমদানি-রফতানি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে। কিন্তু দাসপ্রথা থেমে থাকেনি। বরং তা আধুনিক রূপ পেয়েছে। আধুনিক যুগে শিশুরা দাসত্বের শিকার হচ্ছে এটাই নির্মম পরিহাস। শিশুদের দাসত্ব শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে রাখলে সমাজ ও রাষ্ট্রের অগ্রগতি কোনভাবেই সম্ভব নয় বলে মনে করেন সমাজবিজ্ঞানীরা। তারা বলছেন, দাসত্বের শৃঙ্খলে প্রায় ৭ লাখ লোক থাকবে এমন বাংলাদেশে কাক্সিক্ষত উন্নতি আশা করা যায় না। থাইল্যান্ড ॥ এখন মানব পাচারের শক্তিশালী এক রুট বলা হয় থাইল্যান্ডকে। এখান দিয়ে মানুষ পাচার হয় ও অনুপ্রবেশ ঘটে। মানব পাচারের শক্তিশালী এই রুটে ছোট-বড় বেশ কয়েকটি চক্র সক্রিয় রয়েছে। এরা বিভিন্ন দেশের অবৈধ মানুষ থাইল্যান্ডে ঢুকতে যেমন সাহায্য করে তেমনি পার্শ্ববর্তী দেশে অবৈধ পাচারের ব্যবস্থা করে থাকে। থাইল্যান্ডে পাচারকৃত নারীদের যৌন কাজে বাধ্য করা ও অবৈধ নাগরিকদের স্বল্প বেতনে দিনমজুর হিসেবে কাজ দেয়া হয়। এই দেশে পাচারকৃত মানুষদের ইতিহাস ঘেঁটে দেখা গেছে এদের বেশিরভাগই গৃহহারা, বাস্তুহারা, সংখ্যালঘু। ধর্মীয় উত্তেজনায় নিরাপত্তা হারানো ও অবৈধ অভিবাসীদের তালিকাও এখানে বেশ লম্বা। সিরিয়া ॥ ২০১১ সাল থেকে সিরিয়ান সরকার মানব পাচারের শক্তিশালী চক্রের সঙ্গে লড়াই করে আসছে। কিন্তু যেখানে সরকার ব্যবস্থারই স্থিতিশীলতা নিয়ে উত্তেজনা সর্বত্র সেখানে মানব পাচার রোধে কার্যকর কোে উদ্যোগই নেই। টিয়ার-৩ তালিকাভুক্ত এ দেশটিতে গত কয়েক বছরে মানব পাচার নিয়ন্ত্রণে বাইরে চলে গেছে। অবস্থা হয়ে উঠেছে ভয়াবহ। ইতোমধ্যে দেশটিতে ৯ হাজার মানুষের মৃত্যু সেই ভয়াবহতার চিত্রই ফুটিয়ে তোলে। সিরিয়ার সীমান্ত ব্যবহার হয়ে থাকে মানব পাচারের নিরাপদ রুট হিসেবে। ফিলিপাইন, সোমালিয়া, ইথিওপিয়া, ইন্দোনেশিয়া থেকে মানুষ এখানে পাচার হয়ে আসে, নয়ত এই রুট ব্যবহার করে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে অবৈধভাবে প্রবেশ করে থাকে। দুবাইয়ে যাওয়ার রুট হিসেবেও এখন সিরিয়ার বিপজ্জনক সীমান্ত ব্যবহৃত হয়ে থাকে। লিবিয়া ॥ সাব-সাহারান অঞ্চল থেকে পাচার হওয়া মানুষদের জন্য উল্লেখযোগ্য রুট লিবিয়া। লিবিয়া সরকারের দুর্বল সীমান্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থার কারণে এই রুটে পাচার বেড়েই চলেছে। টায়ার-৩ ক্যাটাগরির এ দেশটিতে পুরুষদের জোরপূর্বক স্বল্প বেতনের কাজে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এছাড়া নারী ও শিশুদের দিয়ে করানো হয় পতিতাবৃত্তি। এ নিয়ে আন্তর্জাতিক মানব পাচারবিষয়ক প্রতিষ্ঠানগুলো সরব হয়ে উঠলেও অবস্থার খুব একটা পরিবর্তন ঘটেনি। এ দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার কারণেও আশপাশে দেশগুলোর সীমান্ত ব্যবহার করছে পাচারকারী চক্র। দেড় থেকে দুই লাখ মানুষের পাচার হয়ে থাকে এ রুটে। এই মানুষগুলো পাচার হচ্ছে সাব-সাহারান দেশগুলোতে। পাশ্চাত্যে নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ইউরোপের দেশগুলোতে মানব পাচারের বৃহত্তম বাজার সৃষ্টি করেছে। অভিবাসন আইনে পরিবর্তন এবং মহিলাদের মধ্যে দারিদ্র্য বেশি থাকায় নারী ও কন্যারা মানব পাচারকারীদের সহজ শিকারে পরিণত হচ্ছে। বিশ্বের ১৩০ কোটি দরিদ্রের মধ্যে শতকরা ৭০ ভাগই নারী ও শিশু। সংসারের অর্থ সঙ্কট দূর করা ও পরিবারের সদস্যদের ভবিষ্যত অর্থনৈতিক অবস্থাকে স্বচ্ছল করার আশা অনেক নারীকে মানব পাচারকারীদের ফাঁদে আকৃষ্ট করে। আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ ॥ মানব পাচার রোধের জন্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। যেমন, পালেরোমা চুক্তি নামে একটি আন্তর্জাতিক প্রটোকল প্রণয়ন। বর্তমানে বিশ্বের ১৩৩টি দেশ এই প্রটোকলে স্বাক্ষর করেছে। এ প্রটোকলে নব্য দাসপ্রথাসহ জোর করে কাজ করানো বা দাসপ্রথার সব ধরনের রূপের নিন্দা করা হয়েছে এবং মানব পাচার রোধের ওপর গুরুত্ব দিতে বিশ্ব সমাজের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। মানব পাচার রোধের জন্য এ প্রটোকলে তিনটি মূলনীতি ঘোষিত হয়েছে। এ নীতিগুলো হলো, মানব পাচারের সঙ্গে সম্পর্কিত অপরাধ প্রতিহত করা, অপরাধীদের শাস্তির ব্যবস্থা করা এবং মানব পাচারের শিকার ব্যক্তিদের সহায়তা করা। দুঃখজনকভাবে মানব পাচার রোধের জন্য আন্তর্জাতিক সমাজের পদক্ষেপে খুব একটা প্রত্যাশিত ফলাফল অর্জিত হয়নি। জাতিসংঘের রিপোর্টে বলা হয়েছে, পশ্চিম ইউরোপই মানব পাচারের প্রধান লক্ষ্যস্থল। এই দেশগুলোই বিশ্বের সবচেয় ধনী দেশের অন্তর্ভুক্ত। সেখান জীবনযাত্রার মানও উন্নত। অথচ জাতিসংঘের রিপোর্ট অনুযায়ী এই দেশগুলোতেই হাজার হাজার নারী ও সদ্য যৌবনে উপনীত মেয়েরা পতিতালয়ে যৌন দাসী হিসেবে বন্দী। বিশ্বজুড়ে দাশপ্রথার সময়ে মানুষের মর্যাদা দেয়া হতো না। দার্শনিক এ্যারিস্টটলের মতে, দাস ব্যবস্থা প্রকৃতিরই নিয়ম। ক্ষমতাবানরাই মানুষকে দাস বানিয়ে তাদের দিয়ে বিভিন্ন কাজকর্ম করাত। দাসপ্রথার শুরু কখন থেকে তা সঠিক জানা যায়নি। তবে ধারণা করা হয় দাসত্বের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা প্রথম সমাজ হলো গ্রীক সভ্যতার সমাজ ব্যবস্থা। গ্রীক সভ্যতার সূচনা যিশুর জন্মের আনুমানিক দু’হাজার বছর আগে মাইনোয়ান যুগে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রাচীন সভ্যতায়ও দাসের প্রচলন ছিল। সুমেরীয় এবং ব্যাবিলনীয় সভ্যতায় দাসের প্রচলন ছিল। মিসরীয়দেরও প্রচুর দাস ছিল, এদের মধ্যে ইহুদী, ইউরোপীয় এবং ইথিওপীয় দাসও ছিল। গ্রীক এবং রোমানরা ভৃত্য, সৈনিক ও সরকারী দাফতরিক কাজে দাস ব্যবহার করেছে। রোমানরা বৃটেন, ফ্রান্স এবং জার্মানি থেকে দাস সংগ্রহ করেছে। অটোমান এবং মিসরীয়রা তাদের সৈন্যবাহিনীতে দাস ব্যবহার করেছে। আফ্রিকার অনেক দেশে দাসের প্রচলন হয়। রাশিয়াতেও সার্ফ নামে দাস প্রথা চালু ছিল। ঊনিশ শতকের প্রথমার্ধে রাশিয়ার জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশই ছিল এ ধরনের দাস। এক সময়ে দাসদের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করার কারণে তারা সংঘবদ্ধভাবে মালিকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে। এর প্রায় সবকটিই ব্যর্থ হয়েছে। পরিণামে তাদের উপর আরও বেশি জুলুম নির্যাতন নেমে আসে। ১৭৯১ সালে হাইতির দাস বিদ্রোহকে সফল বিদ্রোহ বলেছেন অনেক ইতিহাসবিদ। শানজিদ রশিদ অর্ণবের লেখা থেকে বুঝা যায় হাইতির দাস বিদ্রোহ শুরু হয় ১৭৯১ সালের ২২ আগস্ট। দাসদের সেই বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে দাবানলের মতো। বিদ্রোহীরা বাগিচা মালিকদের হত্যা করে। দাসপ্রথা বিলুপ্ত হওয়ার ইতিহাস খুব দূরের নয় এবং সারা দুনিয়া থেকে এই দাসপ্রথা এক দিনেও উঠে যায়নি। ১৮৬০ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হন আব্রাহাম লিংকন। লিংকন আমেরিকার পশ্চিমাংশে দাসপ্রথা প্রসারের বিরোধিতা করেন। ১৮৬১ সালের ১২ এপ্রিল শুরু হয় আমেরিকায় গৃহযুদ্ধ। ১৮৬৩ সালে প্রেসিডেন্ট লিংকন ‘দাসপ্রথাবিরোধী ঘোষণা’ জারির মাধ্যমে আমেরিকার দক্ষিণাংশের কনফেডারেট রাজ্যগুলোর দাসদের দাসত্ব মোচন করেন। ১৮৬৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের ১৩তম সংশোধনীর মাধ্যমে দেশ থেকে দাসপ্রথা বিলোপ করা হয়। পৃথিবীর কয়েকটি দেশে দাসপ্রথা বিলোপের সময়কাল এরকম। সুইডেন- ১৮৪৬, আর্জেন্টিনা-১৮৫৩, মেক্সিকো- ১৮২৯, ডেনমার্ক-১৮৪৮, কিউবা-১৮৮৬, ব্রাজিল-১৮৮৮, মাদাগাস্কার- ১৮৯৬, চীন-১৯১০, আফগানিস্তান- ১৯২৩, ইরাক- ১৯২৪, ইরান- ১৯২৮, মিয়ানমার- ১৯২৯, সৌদি আরব- ১৯৬২, সংযুক্ত আরব আমিরাত- ১৯৬৩, নেপাল-১৯২৬। দাসপ্রথার প্রাচীন পদ্ধতি বিলুপ্ত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু নতুন পদ্ধতিতে এই দাসপ্রথা এখনও টিকিয়ে রেখেছে বর্তমানের ক্ষমতাবানরা সারা দুনিয়াতেই। এই দাসপ্রথা আর আগের দাসপ্রথার মধ্যে বাহ্যিক কিছু পার্থক্য থাকলেও মূলগত তেমন পার্থক্য নেই।
×