ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আপনিই বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৩:৫২, ১৭ মে ২০১৫

আপনিই বাংলাদেশ

১৯৮১ সালের ১৭ মে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ সন্তান বাংলাদেশের তৃতীয়বারের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা প্রায় ছয় বছর নির্বাসিত জীবনযাপন করে বাংলাদেশের মাটিতে পদার্পণ করেন। তাঁর সেই স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিবসটিতে বাংলার আকাশ মেঘাচ্ছন্ন ছিল। একটা গুমোট আবহাওয়া অনুভূত হয়েছিল সেদিন। বাংলাদেশ যেন ছয় বছরের ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে অপেক্ষা করছিল। বর্তমান শাহ্জালাল বিমানবন্দরে তিনি অবতরণের পর পরই বেদনায় ভারাক্রান্ত বাংলা মা আর যেন অপেক্ষা করতে পারেনি; ভেতরের সমস্ত আবেগকে ক্রন্দনের মাধ্যমে সে যেন বারংবার মনে করিয়ে দেয়Ñ বিশ্বসমাজে আমাকে রাষ্ট্র হিসেবে যে পরিচিতি দেয়, তার হত্যাকাণ্ডজনিত বেদনার ভার আমি আর বইতে পারছি না; তুমি আমার সেই জনকের কন্যা। তাঁর রক্তের উত্তরাধিকার, তোমার নৈবেদ্য আজ আমি আমাকে সমর্পণ করছি। সব বেদনা আমরা এখন ভাগাভাগি করে নেই। সেদিনের ঢাকা অঝোর বর্ষণে প্লাবিত হয়েছিল; পাশাপাশি কালবৈশাখীরও মৃদু আভাস মিলেছিল। প্রকৃতি যেন এটাও বুঝিয়ে দিয়েছিল ‘এই বাংলায় তোমার পথ কণ্টকমুক্ত নয়’। ’৮১ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত দীর্ঘ কণ্টকাকীর্ণ পথ তাঁকে অতিক্রম করতে হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে তাঁকে অনেক রুচিহীন, সংস্কৃতিবিবর্জিত ও রাজনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত আক্রমণের শিকার হতে হয়েছে। জীবনের ওপর বড় ধরনের আক্রমণ হয়েছে কয়েকবার। তবুও তিনি ছিলেন পথচলায় দৃঢ়, অবিচল ও প্রত্যয়ী। সাহসিকতায় অনেক ক্ষেত্রেই তিনি জনককে অতিক্রম করেছেন। সমস্ত বাধা-বিপত্তিকে অতিক্রম করে, অন্তর্দলীয় কোন্দলকে নিরসন করে, আওয়ামী লীগের খণ্ড খণ্ড গ্রুপগুলোকে একত্রিত করে তিনি এই দলকে ’৯৬-এ রাষ্ট্রক্ষমতায় নিয়ে আসেন এবং দায়িত্ব গ্রহণের পর পরই দীর্ঘদিনের ঝুলে থাকা বাংলাদেশ-ভারত পানিচুক্তি তাঁর নেতৃত্বে সম্পাদিত হয়। এতে বাংলাদেশ শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গার ৩৩ হাজার কিউসেক পানি পাওয়ার অধিকার লাভ করে। এরপর রক্তাক্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তির সুবাতাস বইতে শুরু করে। দীর্ঘকাল আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সমালোচনা ছিল যে, তারা সেনাবাহিনীর বিপক্ষের দল, প্রচারণা চালানো হতো- আওয়ামী লীগ ভারতের দালাল, ইসলামের শত্রু। শেখ হাসিনা এসব অপপ্রচারকে অসার প্রমাণ করেছেন। তাঁর সময়কালে যত রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট তৈরি হয়েছে- বাংলাদেশে তা অতীতে কখনও হয়নি। তাঁর শাসনকালের ৩টি পর্যায়ে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল থাকায় জনজীবনে এক ধরনের স্বস্তি ও নিরাপত্তা বিরাজ করে। বাংলার গ্রামাঞ্চলে আষাঢ় ও আশ্বিন অভাবের মাস হিসেবে পরিচিত ছিল; গ্রামের নিম্নবিত্ত মানুষ এই সময়ে কাজ ও খাদ্যের অভাবে হাহাকার করত। এখন এই অবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। শেখ হাসিনা বাংলাদেশে সেনানিবাসভিত্তিক রাজনীতির অবসান ঘটিয়েছেন। রাজনীতির বিষয়টি রাজনীতিবিদগণ সমাধান করবেন- এক্ষেত্রে সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপ করবে না; তিনি বাংলাদেশকে সেই সংস্কৃতির দিকে এগিয়ে নিয়েছেন। শেখ হাসিনার অন্যতম সাফল্য বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী, জাতীয় চার নেতার হত্যকারী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা এবং তা বাস্তবায়ন করা। সাম্প্রতিককালের বৃহৎ শক্তিসমূহের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেও তিনি তাঁর উদ্দেশ্যে অবিচল থেকেছেন। তিনি জন কেরি বা হিলারি ক্লিনটনকে আমলে নেননি। এক্ষেত্রে তিনি শুধু তাঁর পিতা ও বাঙালী জাতির জনককে অতিক্রম করেননি; বরং এদেশে বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি চালু হয়েছিল, তা বন্ধের প্রক্রিয়ায় এ এক অভাবনীয় অভিযাত্রা। এক সময়ে এদেশে রাজাকার শিরোমণিরা শুধু গাড়িতে জাতীয় পতাকা উড়িয়েছে তাই নয়, সমাজের সর্বস্তরে তারা মান্যবর হয়ে উঠেছিল। ধর্মীয় লেবাসে তাদের সকল কুকীর্তি চাপা পড়ে গিয়েছিল এবং মুক্তিযুদ্ধ যেন একটি অন্যায় বিষয় ছিল- এমন আবহ দেশে তৈরি করা হয়েছিল। শেখ হাসিনা সেই জায়গা থেকে বাংলাদেশকে বের করে নিয়ে এসেছেন। ফারুক-রশীদ গং আশির দশকে মঞ্চের উপরে স্টেনগান তাক করে জনসভায় বলতেন- আমরাই শেখ মুজিবকে হত্যা করেছি। সেই আস্ফালন আজ ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত। এদেশে মুক্তিযোদ্ধা বলতে শুধুমাত্র যারা মাঠে অস্ত্র হাতে সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল, তাদেরই বোঝানো হতো। বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্বে সর্বস্তরের মানুষ যে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল, সামরিক সরকারগুলোর প্ররোচনার কারণে তা চাপা পড়ে গিয়েছিল। শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী-শ্রমজীবী-ছাত্র-শিক্ষক সবাই যে এই যুদ্ধের অংশীদার, তা প্রদীপের নিচে চলে যায়। এসব বিষয়সহ আড়ালে পড়ে যাওয়া সম্মুখযুদ্ধের বাইরে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক যুদ্ধ, স্বাধীন বাংলা বেতারের যুদ্ধ, শিল্পীর সঙ্গীত ও কবিতার যুদ্ধকে শেখ হাসিনা আলোর সামনে নিয়ে এসেছেন। বিদেশী বন্ধুদের সহায়তাকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়েছেন। এতে বাংলাদেশ এক অনন্য উচ্চতায় আসীন হয়েছে। যে বাংলাদেশের মানুষ জয়বাংলা সেøাগানকে আওয়ামী লীগের দলীয় সেøাগান হিসেবে মনে করত, তা আবার প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলসমূহের কাছে গ্রহণীয় ও সমাদৃত। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চকে এক্ষেত্রে আমরা সম্মুখে দেখলেও এর পেছনে শেখ হাসিনার উদার ও সহনশীল মনোভাব রয়েছে বলে মনে হয়। এরই ধারাবাহিকতায় সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে বাংলাদেশে একটি ধর্মনিরপেক্ষ মননশীল সমাজ তৈরি হবে এবং জয়বাংলার বিস্তৃতিতে সাম্প্রদায়িকতার বিনাশ ঘটবে। বাংলাদেশে নারী ও শিশু অধিকারের ক্ষেত্রে তাঁর যে উদ্যোগ, অতীতে কেউ তা গ্রহণ করেনি। পিতার সম্পত্তিতে পুত্র-কন্যার সমান অংশীদারিত্ব, হিন্দু বিবাহে নিবন্ধনকে বাধ্যতামূলক করার বিষয়টি ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর তৎপরতার কারণে স্থগিত থাকলেও এক সময় শেখ হাসিনা এটি বাস্তবায়ন করবেন তা অনেকেই বিশ্বাস করেন। চাকরির পাশাপাশি মানুষকে আত্মকর্মসংস্থানে উৎসাহিত করার কাজটি শেখ হাসিনাই করেছেন। ফলে লাখ লাখ যুবক দেশে বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। প্রযুক্তি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ গত পাঁচ বছরে কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে তা আজ বিবেচ্য। বিদ্যুতের অতীত ও বর্তমান, শিক্ষার বিদ্যমান পরিস্থিতি, স্বাস্থ্য খাতের উত্তরোত্তর সমৃদ্ধির বিষয়টি আলোচনায় এলে কৃতিত্ব তো শেখ হাসিনাকেই প্রদান করতে হবে। কিন্তু তাঁর নাম শুনলে কারও কারও ঘুম নষ্ট হয়ে যায়। তিনি যে সাহসিকতার সঙ্গে এক ঘোষণায় ২৬ হাজার বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করলেন, বাংলাদেশে গত ৪২ বছরে এই কাজটি যে আর কেউ করেননি, তা ষড়যন্ত্রকারীরা দেখেও না দেখার ভান করেন। বাংলাদেশে আজ পদ্মা সেতু একটি বাস্তবতা। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের তৎপরতায় (কথিত আছে) ওবামা-হিলারির পরামর্শে বিশ্বব্যাংক এর অর্থায়ন থেকে সরে গেলেও শেখ হাসিনা বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নে এটি বাস্তবায়নের এক দুঃসাহসী উদ্যোগ নেন। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধের সময় চলমান জাতীয় সংসদের অধিবেশনে তিনি এ প্রসঙ্গে যে ভাষণ দেন, তা সমকালীন বিশ্বে সবচেয়ে সাহসী ও উদ্দীপক ছিল নিঃসন্দেহে। ওই বক্তৃতার পর অনেক রিক্সাওয়ালা, কৃষক, শ্রমিক ও সবজি বিক্রেতাকে বলতে শোনা গেছেÑ আমি এক শ’ টাকা দিয়ে হলেও পদ্মা সেতুতে অংশীদার হতে চাই। একজন নেতা এভাবেই তাঁর দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেন। মানুষের মধ্যে দেশপ্রেম সৃষ্টি করেন। জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলেন। এক্ষেত্রে শেখ হাসিনা সাম্প্রতিককালে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তিনি যদি এখন শুধু দুর্নীতির বিরূদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারেন, তাহলে অবশ্যই তিনি বাংলাদেশের মাহাথির মোহাম্মদ হবেন। ছিটমহল সমস্যার চূড়ান্ত সমাধানে আর মাত্র কয়েকদিনের অপেক্ষা। শুধু আনুষ্ঠানিকতা বাকি। এরপরই ছিটমহলবাসীর দীর্ঘকালের লাঞ্ছনা, বঞ্চনা ও যাতনার অবসান ঘটবে। সিরিয়া-লেবানন দীর্ঘ বছরেও তাদের সীমান্ত সমস্যা সমাধান করতে পারেনি। ইরাক-ইরানের মধ্যকার শাত-ইল-আরব সীমানা বিবাদ হাজার বছরের, চীন-ভারত সীমান্ত সমস্যা অনেক পুরনো, কাশ্মীর ভারত-পাকিস্তানের বিষফোঁড়া; কিন্তু শেখ হাসিনার আপ্রাণ চেষ্টায় বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত সমস্যার সমাধান হয়েছে। এই সাফল্যের স্বীকৃতি কোন পুরস্কারে পূর্ণতা পায় না। ছিটমহলবাসীর হৃদয়ের অর্ঘ্য তাঁর পুরস্কার। সবশেষে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন তাঁর একটি অনন্যসাধারণ উদ্যোগ। আবহমান বাঙালী সংস্কৃতির ধারক ও পৃষ্ঠপোষক হিসেবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বাঙালীর সঙ্গীত, নাটক, লোকসাহিত্যসহ সংস্কৃতি বিষয়ক বিষয়াবলী পঠিত হবে। পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞান ও কৃষি প্রযুক্তি চিন্তারও প্রতিফলন ঘটবে এখানে। সমুদ্রসীমা বিজয়ের পর তিনি যেমন ম্যারিটাইম বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেন, ঠিক তেমনি স্থলসীমানা বিজয়ের মুহূর্তে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেছেন। বঙ্গবন্ধুর পর শেখ হাসিনার মুখেই নিপীড়িত মানুষ বাংলাদেশের মানচিত্র দেখতে পায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে শুভেচ্ছা। লেখক : উপাচার্য, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়
×