ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ওয়ার্ড কমিশনারদের স্থায়ী কার্যালয় নেই ঢাকার দুই সিটিতে

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ১৬ মে ২০১৫

ওয়ার্ড কমিশনারদের স্থায়ী কার্যালয় নেই ঢাকার দুই সিটিতে

মশিউর রহমান খান ॥ সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ঢাকার দুই সিট করপোরেশনের মেয়র ও কাউন্সিলর পদের নির্বাচনে ৯৩টি ওয়ার্ডের নির্বাচিত কমিশনারদের মধ্যে বেশিরভাগের বসার জন্য স্থায়ী কোন কার্যালয় নেই। জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে এসব কমিশনার নির্বাচিত হলেও এর আগে কোন মেয়র বা সরকারই এসব কমিশনারদের ওয়ার্ড পরিচালনার ও উন্নয়ন কর্মকা- সম্পাদন করতে কোন স্থায়ী কার্যালয় তৈরি করেননি। এমনকি তা তৈরিতে উদ্যোগ পর্যন্ত নেননি। নিয়মানুযায়ী ওয়ার্ডের উন্নয়নসহ সার্বিক কর্মকা- পরিচালনার জন্য একটি করে কার্যালয় প্রতিষ্ঠা করার কথা থাকলেও নাগরিকদের সুবিধার কথা বিবেচনা না করে কমিশনাররা ইচ্ছামতো স্থানে ওয়ার্ড কার্যালয় স্থাপন করে কর্মকা- পরিচালনা করছেন। কমিশনারের কার্যালয় হিসেবে বাদ পড়েনি মৃত্যুর পর শেষ ঠিকানা গোরস্তান থেকে শুরু করে প্রাথমিক বিদ্যালয়, স্বাস্থ্য ক্লিনিক, ব্যায়ামাগার, বিনোদনের জন্য তৈরি করা কমিউনিটি সেন্টারসহ সরু গলির রাস্তার শেষ মাথার অতি অপরিচিত বাড়িও। কমিশনারের কার্যালয়ের স্থান হিসেবে সরকারের কোন নির্ধারিত নিয়ম বা নীতিমালা না থাকায় আজ পর্যন্ত নির্দিষ্ট স্থানে কমিশনারের কার্যালয় তৈরি করা হয়নি। নির্বাচিত মেয়রদের জন্য সরকার সিটি কর্পোরেশন শুরুর পর থেকেই অফিস ও বাড়ি বরাদ্দ প্রদান করলেও কাউন্সিলরদের কর্মকা- পরিচালনার জন্য আজ পর্যন্ত কোন সরকারই কোন উদ্যোগ হাতে নেয়নি। ফলে উত্তর ও দক্ষিণ সিটির ৯৩ ওয়ার্ডের সাধারণ ও সংরক্ষিত নারী কমিশনারদের স্থায়ী অফিস নেই। সারাদেশের সকল স্থানে উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদের নিয়মিত সেবা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কার্যালয় তৈরি করা হলেও আজ পর্যন্ত রাজধানী ঢাকার নাগরিকগণ তাদের ওয়ার্ডের সমস্যা সমাধানের জন্য ও কমিশনারদের সেবা পরিচালনার জন্য নির্দিষ্ট কোন কার্যালয় তৈরি করা হয়নি। ফলে ওয়ার্ডের নাগরিকগণ নতুন নির্বাচিত কাউন্সিলরের ইচ্ছামাফিক স্থানে তৈরি ব্যক্তিগত কার্যালয়ে গিয়ে সেবা গ্রহণ করতে হয়। একেক সময় একেক স্থানে কমিশনারের কার্যালয় তৈরি করায় সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে স্থানীয় নাগরিকদের। সরেজমিনে দেখা গেছে, কবরস্থান, প্রাথমিক বিদ্যালয়, হাসপাতাল, কমিউনিটি সেন্টার, মার্কেট ও শরীরচর্চা কেন্দ্রে রয়েছে কিছু ওয়ার্ডের কার্যালয়। এর মধ্যে গত বুধবার ৩৬ সাধারণ ও ৩১ সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলর শপথ নিয়েছেন। শপথকৃত কমিশনারদের আপাতত বাসাবাড়ি অথবা ব্যক্তিগত কার্যালয়ে অফিস করতে হবে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) সচিবের দফতর থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, সংস্থাটির ৫টি জোনের ১০টি ওয়ার্ডে কোন কার্যালয় নেই। এতে সাবেক কমিশনারের ব্যক্তিগত কার্যালয়কেও ওয়ার্ড কার্যালয় হিসেবে দেখানো হয়েছে। যাদের মধ্যে কয়েকজন ছাড়া বেশিরভাগই এবারের নির্বাচনে অংশ নেননি বা জয়ী হতে পারেনি। এছাড়া কয়েকটি ভাড়া করা ভবনেই অফিস করতে হয় ওয়ার্ডগুলোর কাউন্সিলরকে। ফলে নির্বাচনে হেরে যাওয়া প্রার্থীর কার্যালয় আর অফিস হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, একটি ওয়ার্ডের কমিউনিটি সেন্টারে ২ থেকে ৩টি ওয়ার্ডের কার্যালয় বানানো হয়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সিটি কর্পোরেশনের মাত্র ৩টি নিজস্ব স্থায়ী কার্যালয় রয়েছে। এছাড়া কমিউনিটি সেন্টারে ৫৩টি, মার্কেটে ৫টি, কবরস্থানে ৩টি, স্বাস্থ্য ক্লিনিকে ১টি, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১টি, শরীরচর্চা কেন্দ্রে ৫টি ওয়ার্ড কার্যালয় রয়েছে। অথচ সিটি কর্পোরেশন এসব প্রতিষ্ঠানকে নাগরিকদের সুবিধার্থে সম্পূর্ণ আলাদা আলাদা সেবা প্রদানের জন্য তৈরি করেছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এসব উদ্যোগ বাস্তবায়নে বাধার সৃষ্টি করছে। অনুসন্ধানে আরও দেখা গেছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৩, ৯, ১৪, ১৫, ১৯, ২৭, ৩৭, ৫৫, ৫৬ ও ৫৭ ওয়ার্ডে কোন কার্যালয় নেই। নির্বাচিত এসব ওয়ার্ডের কমিশনারদের ভাড়া করা অফিসে তাদের কর্মকা- পরিচালনা করতে হবে। তবে কর্পোরেশন সূত্র জানায়, নবনির্বাচিত কমিশনাররা শিগগিরই অফিস ভাড়া পাচ্ছেন না। তাদের অফিসে বসে কর্মকা- পরিচালনা করার জন্য আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা (আনিক) কর্তৃক স্থানীয় কমিশনারের সঙ্গে পরামর্শ করে ওয়ার্ডের নাগরিকদের যোগাযোগে সুবিধা হবে এমন সুবিধাজনক স্থান নির্বাচিত করবেন। উক্ত স্থানকে কার্যালয় হিসেবে স্থাপনের প্রস্তাব পাঠানোর পর মেয়র কর্তৃক অনুমোদনের পরই কেবল অফিস হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। সরেজমিনে জানা গেছে, ১৩ নং ওয়ার্ডে অবস্থিত পল্টন কমিউনিটি সেন্টার। এখানে সর্বোচ্চ এই ওয়ার্ডের কার্যালয় হতে পারে। কিন্তু ১১ ও ১২ নম্বর ওয়ার্ড কার্যালয়টিও এ কমিউনিটি সেন্টারে অবস্থিত। একই অবস্থা রয়েছে ১, ৫, ৪৪, ৪৫ ও ৪৭ নম্বর ওয়ার্ডে। এ ওয়ার্ডগুলোর মধ্যে ১নং ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের নাগরিক সেবা নিতে হবে ৪নং ওয়ার্ডের বাসাবো কমিউনিটি সেন্টারে। ৫নং ওয়ার্ডের নাগরিকদের আসতে হবে ৬নং ওয়ার্ড মুগদা কমিউনিটি সেন্টারে। ৪৪ ও ৪৫নং ওয়ার্ডবাসীকে সেবা নিতে আসতে হবে ৪৬নং ওয়ার্ডে অবস্থিত জহির রায়হান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে। এছাড়াও ২৩নং ওয়ার্ডে নবাবগঞ্জ পার্ক ব্যায়ামাগার, ২৬নং ওয়ার্ডে লালবাগ শরীর চর্চা কেন্দ্র ও ৩৪নং ওয়ার্ডে নাজিরাবাজার শরীরচর্চা কেন্দ্রেই বসে অফিস করতে হবে সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ড কমিশনারদের। নাম না প্রকাশ না করার শর্তে অনিচ্ছুক বিএনপি সমর্থিত নির্বাচিত একজন কমিশনার বলেন, এর আগেরবার আমরা নির্বাচিত হয়েও কোন স্থায়ী কার্যালয় পাইনি। এবারও ওয়ার্ডের কর্মকা- পরিচালনায় কোন কার্যালয় পাব কি না জানি না। মনে হচ্ছে আমার বাড়ির নিচের একটি কক্ষের ব্যক্তিগত অফিসই কমিশনারের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। তবে ওয়ার্ডের নাগরিকদের সুবিধার্থে সবসময়ের জন্য চিহ্নিত স্থায়ী কার্যালয় থাকা প্রয়োজন। প্রাথমিক শিশুদের শিক্ষার জন্য নির্মিত প্রাথমিক বিদ্যালয়েও রয়েছে সংস্থাটির ওয়ার্ড কার্যালয়। এটি সংস্থাটির ৫১নং ওয়ার্ডের আবু হাজী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়। আর ৫৩ নম্বর ওয়ার্ডবাসীকে নাগরিক সেবা পেতে আসতে হবে স্থানীয় জুরাইনে অবস্থিত সূর্যের হাসি চিহ্নিত ক্লিনিকে। কমিউনিটি সেন্টর, শরীরচর্চা কেন্দ্র ও স্বাস্থ্য ক্লিনিকেই শেষ হয়নি ডিএসসিসির ওয়ার্ড কার্যালয়। মৃতব্যক্তির শেষ ঠিকানা কবরস্থানেও রয়েছে সংস্থাটির ওয়ার্ড কার্যালয়। সংস্থার ৪৭, ৫২ ও ৫৪ নম্বর ওয়ার্ড কার্যালয় গোরস্তানে। ওয়ার্ডগুলোর মধ্যে ৪৭ ও ৫৪ নম্বর ওয়ার্ডবাসীকে সেবা নিতে আসতে হবে জুরাইন কবরস্থানে ও ৫২নং ওয়ার্ডবাসীকে আসতে হবে স্থানীয় মুরাদপুর শিশু কবরস্থানে। নগরবাসীর বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য ডিএসসিসির আওতায় নির্মাণ করা হয়েছে ৩৬টি কমিউনিটি সেন্টার। মূলত এখন এসব বিনোদন কেন্দ্রকেই স্থায়ী ওয়ার্ড কার্যালয় হিসেবে ধরা হচ্ছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা বিরাজ করছে। সংস্থাটির ৩৬টি ওয়ার্ডের মধ্যে ২৬ টিতেই নেই নিজস্ব কার্যালয়। এগুলো হচ্ছে- ৩, ৪, ৫, ৬, ৭, ৯, ১০, ১১, ১২, ১৩, ১৪, ১৫, ১৬, ১৭, ১৮, ২১, ২২, ২৩, ২৫, ২৬, ২৭, ২৮, ৩০, ৩২, ৩৩ ও ৩৬ নম্বর ওয়ার্ড। ফলে নিজস্ব বাসা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কিংবা ভাড়া করা ভবনেই কমিশনারের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। সাধারণ কমিশনার ছাড়াও নিজস্ব কার্যালয় নেই দক্ষিণের ১৯টি ও উত্তরের ১২টি সংরক্ষিত মহিলা ওয়ার্ড কাউন্সিলরের। ফলে তাদেরও ওয়ার্ডের কাউন্সিরদের অফিস নিয়ে একই পরিণতি ভোগ করতে হবে। সংশ্লিষ্টদের মতে, আগের কোন মেয়র বা সাবেক কমিশনারই এ বিষয়ে কোন নজর দেননি। এ কারণেই ওয়ার্ডগুলোতে নিজস্ব কোন কার্যালয় গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হওয়ার পর তাদের সেবার জন্য কোন স্থায়ী কার্যালয় প্রতিষ্ঠা না করা দুঃখজনক বটে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের সচিব খান মোহাম্মদ রেজাউল করিম জনকণ্ঠকে বলেন, নাগরিকদের সুবিধার্থে কর্পোরেশনের স্বাভাবিক কর্মকা- পরিচালনার জন্য ওয়ার্ডের নির্বাচিত সাধারণ ও নারী কমিশনারদের অবশ্যই নির্দিষ্ট অফিস থাকা প্রয়োজন। স্থায়ী কোন কার্যালয় না থাকায় সরকারী বিভিন্ন আদেশ নির্দেশ বাস্তবায়নে অনেক সময় সমস্যার সৃষ্টি হয়। তবে ডিএসসিসির যেসব ওয়ার্ডে কার্যালয় নেই আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তাগণ সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের কমিশনারের সঙ্গে পরামর্শ পূর্বক কার্যালয়ের স্থান ঠিক করবেন। আর যেসব ওয়ার্ড কার্যালয় বর্তমানে ভাড়া হিসেবে নেয়া হয়েছে তা ভাড়া হিসেবে রাখা হবে। নতুন অফিসের ক্ষেত্রে সেসব ওয়ার্ডের কমিশনারদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেই অফিস ভাড়া নিবেন। তবে এই মুহূর্তে তাদের পছন্দমতো স্থানে অফিস না পেলেও কমিশনারদের কাজে কিছুটা সমস্যা হতে পারে।
×