ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

হরতাল ও অবরোধের তিন মাস

পরিবহন খাতে আর্থিক ক্ষতি আট হাজার কোটি টাকা

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ১৫ মে ২০১৫

পরিবহন খাতে আর্থিক ক্ষতি আট হাজার কোটি টাকা

রাজন ভট্টাচার্য ॥ রাজনৈতিক কর্মসূচীর নামে বিএনপি-জামায়াত জোটের টানা তিন মাসের হরতাল-অবরোধে পরিবহন সেক্টরে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় আট হাজার কোটি টাকা। বাস ও ট্রাকে অগ্নিসংযোগের ফলে আর্থিক ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে প্রায় সোয়াশ’ কোটি টাকা। যাত্রী ও পণ্যবাহী পরিবহনের চালক, শ্রমিক মারা গেছেন ৯০ জন। ক্ষতিগ্রস্ত তিন সহস্রাধিক পরিবহনের মধ্যে প্রায় দেড় হাজার পরিবহনে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। বাদবাকি পরিবহনে ভাংচুর করেছে অবরোধ সমর্থকরা। পেট্রোলবোমায় অগ্নিদগ্ধসহ হামলার শিকার হয়ে আহত শতাধিক পরিবহন শ্রমিক। এদিকে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবহন মালিকদের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ক্ষতিপূরণ দেয়া হচ্ছে প্রায় নয় কোটি টাকা। আরও তিন শতাধিক ক্ষতিগ্রস্ত পরিবহনের প্রায় ১৭ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পরিবহন মালিক সমিতির পক্ষ থেকে তালিকা পাঠানো হয়েছে। তিন মাসে এই সেক্টরে আর্থিক ক্ষতি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, বিএনপি-জামায়াত জোটের এবারের আন্দোলনে পরিবহন সেক্টর অচল করা সম্ভব হয়নি। তবে ক্ষতি হয়েছে। তিনি বলেন, একদিন সারাদেশে পরিবহন চলাচল বন্ধ থাকলে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়। এবার যাত্রীদের ভোগান্তির কথা চিন্তা করে আন্দোলনের শুরু থেকেই সারাদেশে প্রায় অর্ধেক পরিবহন চলাচল করে। এ কারণে প্রতিদিনের হিসেবে প্রায় এক মাস আর্থিক ক্ষতি দেড়শ’ কোটি টাকা। পরবর্তী দুই মাস দিনে প্রায় ৫০ কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে বলে জানান তিনি। আহত ও নিহত শ্রমিক এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের সরকারের পক্ষ থেকে আর্থিক সহযোগিতা দেয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবহন মালিকদের প্রধানমন্ত্রীর অনুদান ॥ হরতাল অবরোধের শুরু থেকেই পরিবহন মালিকদের প্রতি গাড়ি চালাতে সরকারের পক্ষ থেকে আহ্বান জানানো হয়েছিল। এক পর্যায়ে ঘোষণা আসে ক্ষতিগ্রস্ত গাড়ির মালিকদের সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার। এর পর পরই সড়ক-মহাসড়কে পরিবহন চলাচল বাড়তে থাকে। এরি ধারাবাহিকতায় গেল ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৫৬টি পোড়া গাড়ির মালিকদের চার কোটি ২০ লাখ ৬৫ হাজার টাকা অনুদান দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর ১২ মার্চ ২৬৫টি পোড়া ও ভাংচুর হওয়া গাড়ির মালিকদের হাতে এক কোটি ৫৪ লাখ ৯১ হাজার টাকা অনুদান দেয়া হয়। ২৯ এপ্রিল ৬৫টি পোড়া গাড়ির অনুদান হিসেবে দেয়া হয় দুই কোটি ছয় লাখ ৪০ হাজার টাকা। ১৩ মে রাজধানীতে ভাংচুর হওয়া ১৯২টি গাড়ির মালিকদের হাতে তুলে দেয়া হবে ৩৫ লাখ ৪৯ হাজার ১৪০ টাকা। ১৮ মে বিভিন্ন জেলায় ভাংচুরের শিকার ১৩৬টি গাড়ির মালিকদের ৪৩ লাখ ৩৭ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা দেয়া হবে। পরিবহন মালিক সমিতির নেতৃবৃন্দ জানিয়েছেন, সর্বশেষ ক্ষতিগস্ত পরিবহনের আরও দু’দফা তালিকা পাঠানো হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে। এর মধ্যে রাজধানীতে চলাচলকারী ১০৫টি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবহনের জন্য চাওয়া হয়েছে দুই কোটি ১৭ লাখ দুই হাজার টাকা। আন্তঃজেলা রুটে চলা ১৯২টি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবহনের জন্য ক্ষতিপূরণ হিসেবে চাওয়া হয়েছে ১৪ কোটি ১১ লাখ নয় হাজার ১০০ টাকা। পরিবহন মালিক সমিতির নেতা এনায়েত উল্যাহ জানান, সরকারের ক্ষতিপূরণ দেয়ার আশ্বাসের প্রেক্ষিতে মালিক শ্রমিকরা আন্দোলন উপেক্ষা করে গাড়ি চালিয়েছেন। তবে সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষতিগস্তদের আর্থিক সহযোগিতাও মিলছে। তিনি জানান, ইতোমধ্যে তিন পর্বে প্রধানমন্ত্রী নিজেই ক্ষতিগ্রস্ত পরিবহন মালিকদের অনুদানের অর্থ তুলে দিয়েছেন। আরও তিনশ’ বেশি চেক আমাদের হাতে প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে পাঠানো হয়েছে। ১৮ মে মধ্যে দুই পর্বে এ সব চেক ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে বিতরণ করা হবে বলে জানান তিনি। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ২০ ক্যাটাগরিতে নিবন্ধিত গাড়ির সংখ্যা ২১ লাখ ৩০ হাজার ২৭৮টির বেশি। এর মধ্যে বাস-মিনিবাসের সংখ্যা ৬০ হাজার, ট্রাক ১ লাখ ৭ হাজার ৩০৯টি, কাভার্ডভ্যান ১৪ হাজার ৩৭২টি ও কার্গোভ্যান ৫ হাজার ৫৩৯টি। এর বাইরে বিপুলসংখ্যক নিবন্ধনহীন বাস-ট্রাক চলাচল করে। বাংলাদেশ ট্রাক, কাভার্ডভ্যান ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোঃ আবদুল মোতালেব জনকণ্ঠকে জানান, সারাদেশে সোয়া ১ লাখ ট্রাক-কাভার্ডভ্যান রয়েছে। হরতাল-অবরোধের শুরুর দিকে প্রতিদিন অর্ধেকের বেশি ট্রাক-কাভার্ডভ্যান পণ্য পরিবহন করেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি চলাচল বাড়ে। তিনি বলেন, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পণ্যবাহী পরিবহন। তিনি জানান, হরতাল-অবরোধে ট্রাক-কাভার্ডভ্যান বন্ধ থাকায় প্রতিদিন অন্তত ২০ কোটি টাকা আয় থেকে বঞ্চিত হয়েছেন মালিকরা। গাড়ি চলাচল না করায় ২০ লাখ শ্রমিক কর্মহীন ছিল। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী জনকণ্ঠকে বলেন, তিন মাসের রাজনৈতিক কর্মসূচীতে প্রায় ৯০ জন চালক ও শ্রমিক নিহত হয়েছেন। নিহত ও আহত পরিবারগুলোতে সরকারের পক্ষ থেকে আর্থিক সহযোগিতা দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের দাবি সবাই যেন চলতে পারে এরকম আর্থিক সহযোগিতা সরকারের পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা উচিত। মালিক সমিতির নেতৃবৃন্দ বলছেন, সংগঠনের পক্ষ থেকে যাত্রী ও পণ্যবাহী পরিবহনের ক্ষয়-ক্ষতি ও আহত নিহতের হিসাব করা হয়েছে। শ্রমিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ বলছেন, দেশের সকল পরিবহনের ক্ষয়-ক্ষতি ও আহত নিহতদের পরিসংখ্যান তুলে আনা হয়েছে সংগঠনের পক্ষ থেকে। মালিক সমিতির হিসাব অনুযায়ী একদিন সারাদেশে পরিবহন চলাচল বন্ধ থাকলে আর্থিক ক্ষতি হয় প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। পরিবহন নেতাদের দাবি, আন্দোলনের শুরুর দিন থেকেই সারাদেশে প্রায় অর্ধেক পরিবহন চলাচল করেছে। এ হিসেবে দিনে ১৫০ কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতি ধরা হলে এক মাসে ক্ষতি হয়েছে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা। পরবর্তী দুই মাসে ৫০ কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতি ধরা হলে মোট ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় তিন হাজার কোটি টাকা। তবে অটোরিক্সা, হিউম্যান হলারসহ দেশের সকল পরিবহনের হিসাব ধরা হলে আর্থিক ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ হবে দ্বিগুণেরও বেশি। এদিকে পরিবহন মালিক শ্রমিক নেতারা জানিয়েছেন, চলতি বছরের শুরু অর্থাৎ ৫ জানুয়ারি থেকে আন্দোলনে মাঠে নামে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। অবরোধ ও হরতাল কর্মসূচী সফল করতে যোগাযোগ সেক্টরকে অচল করার চেষ্টা চলে শুরু থেকেই। এজন্য একের পর এর দেশের বিভিন্ন জেলায় যাত্রী ও পণ্যবাহী পরিবহনের ওপর চোরাগোপ্তা হামলা চলে। আন্দোলনকারীদের হামলার কবল থেকে বাদ যায়নি গবাদি পশু থেকে শুরু করে মুরগির বাচ্চাও। কুমিল্লায় যাত্রীবাহী বাসে পেট্রোলবোমা হামলায় নিহত হন নয় জন। অগ্নিদগ্ধ হন ৩০ জনের বেশি যাত্রী। পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের প্রায় ১৫ জেলায় সবচেয়ে বেশি তা-ব হয়েছে। জামায়াত-শিবির ও বিএনপির নেতাকর্মীরাই এ সব হামলার সঙ্গে জড়িত বলছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। সবচেয়ে বেশি নাশকতা হয়েছেÑ পাবনা, সিরাজগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, দিনাজপুর, রংপুর, ময়মনসিংহ, লালমনিহাট, পিরোজপুর, সিলেট, গাইবান্ধা, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, বগুড়া, নোয়াখালী। এছাড়াও নরসিংদী, লক্ষ্মীপুর, ফরিদপুর, মানিকগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় বিচ্ছিন্নভাবে সহিংস ঘটনা ঘটেছে।
×