ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সমুদ্রে পেতেছি শয্যা ১;###;মানব পাচার ৪১ জেলা থেকে ;###;অর্ধেকই রোহিঙ্গা ;###;তিন শতাধিক দালালচক্র ৬ পয়েন্টে সক্রিয় ;###;এক বছরে পাচার বেড়েছে ৬১ ভাগ;###;পাচার পথে অন্তত তিনবার হাতবদল

অন্ধকারের যাত্রী

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ১৫ মে ২০১৫

অন্ধকারের যাত্রী

রাজন ভট্টাচার্য ॥ পাচারের নামে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া হচ্ছে সহজ-সরল মানুষকে। সোনার হরিণের আশায় কেউবা প্রলোভনে পা রাখছেন অন্ধকারের জগতে। তাই সবকিছু উপেক্ষা করে হাতের মুঠোয় জীবন নিয়ে সমুদ্রযাত্রা। মানব পাচারে নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে বাংলাদেশের সমুদ্রপথ। পরিসংখ্যান বলছে, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায়সহ বিভিন্ন দেশে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের মধ্যে প্রায় অর্ধেক মিয়ানমারের। বাংলাদেশের ৪১ জেলা থেকে মানুষ পাচার হচ্ছে। এর মধ্যে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ বেশি। এজন্য তিন শতাধিক দালালচক্র কক্সবাজারসহ সমুদ্র এলাকায় ৬০টির বেশি পয়েন্টে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। চলতি বছরের তিনমাসে ২৫ হাজার বাংলাদেশী ও রোহিঙ্গা বিভিন্ন দেশে পাচার হয়েছে। তাদের মধ্যে নির্যাতিত হয়ে ও খাবার সঙ্কটে মারা গেছে তিন শতাধিক মানুষ। সবচেয়ে উদ্বেগজনক খবর হলো সমুদ্রপথে এক বছরে মানব পাচার বেড়েছে ৬১ ভাগ। তিন দশকে দশ লাখের বেশি মানুষ পাচারের শিকার। কক্সবাজার, টেকনাফ, উখিয়া ও মহেলখালি সমুদ্র পয়েন্টে বেশি মানুষকে পাচার করা হচ্ছে। মধ্য ও নিম্নবিত্ত পরিবারের লোকজন ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য পাচারের শিকার হচ্ছেন। তাদের অনেকেই নদীভাঙ্গা কিংবা সহায়সম্বলহীন। সম্পদ বিক্রি করে অল্প অর্থে অবৈধভাবে বিদেশ পাড়ি দেয়ার চেষ্টা তাদের। বলতে গেলে বাণিজ্যিকভাবেই চলছে মানবব পাচারের রমরমা বাণিজ্য। স্থানীয় প্রভাবশালী গোষ্ঠী মূলত মানব পাচারের মূল হোতা। তারা দালালচক্রের ছায়া হিসেবে কাজ করে। এর সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যের জড়িত থাকারও অভিযোগ আছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, অন্তত তিন হাত বদল হয়ে পাচারকারীদের হাতে সাধারণ মানুষকে তুলে দেয়া হয়। সমুদ্রপথে আরও অন্তত তিনবার হাতবদল হয় অভাগা মানুষগুলো। এদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনিয়ম, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনা না থাকাসহ প্রভাবশালী পাচারচক্রের কারণে মিয়ানমারের নাগরিকদের কোনভাবেই বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ ঠেকানো যাচ্ছে না। প্রতিটি ঘটনার বিচার না হওয়ায় রোধ হচ্ছে না মানব পাচারের মতো জঘন্যতম অপরাধ। মানব পাচার প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে পাচার হয়ে যাওয়া শনাক্ত বাংলাদেশীদের দেশে ফিরিয়ে আনা হবে। পাচার বাংলাদেশীদের দেশে ফিরিয়ে আনতে সরকারী উদ্যোগের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, যেসব দেশে বাংলাদেশীদের পাচার করা হয়েছে, সেসব দেশের সঙ্গেও কথা বলব। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডের কাছাকাছি সমুদ্রে ভাসমান পাচার বাংলাদেশীদের বিষয়েও দ্রুত পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার। এছাড়া পাচার রোধে সরকারী পদক্ষেপ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জলসীমায় নিরাপত্তা বাড়ানো হবে। গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে। সরকার বার বার চোরাইপথে বিদেশ যাওয়ার বিষয়ে নিরুৎসাহিত করছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতেও কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার কথা জানান স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। তিনি বলেন, কক্সবাজারের টেকনাফ, মহেশখালী, রংপুর সীমান্ত এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার সীমান্তপথে পাচার ঠেকাতে বিজিবির টহল বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত হয়েছে। সাগরপথের বর্তমান চিত্র ॥ সাগরপথে অবৈধভাবে মানব পাচার বন্ধে ৩০০ পাচারকারীর তালিকা ধরে অভিযানে নেমেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিশেষ নির্দেশনার পর পুলিশ, বিজিবি, কোস্টগার্ড, র‌্যাব এবং বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের ভিত্তিতে মানব পাচারকারীর এ তালিকা করা হয়েছে। তালিকার অধিকাংশই কক্সবাজার জেলার বাসিন্দা। এরা স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় কক্সবাজার উপকূল দিয়ে মিয়ানমারের সীমান্ত হয়ে মালয়েশিয়ায় মানব পাচার করছিল। গত সপ্তাহে থাইল্যান্ডে মানব পাচারকারীদের একটি বন্দী শিবিরের এক গণকবর থেকে ২৬টি দেহাবশেষ উদ্ধারের পর বাংলাদেশে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে মানব পাচার ঠেকাতে তৎপরতা বাড়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। মঙ্গলবার পর্যন্ত পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় পাচারকারীদের পাঁচজন। চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি মোঃ শফিকুল ইসলাম জানান, পুলিশ তালিকা ধরে পাচারকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে। বিজিবি, র‌্যাব ও কোস্টগার্ডও তাদের অভিযান পরিচালনা করছে। কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ আলী হোসেন বলেন, সমুদ্রপথে মানব পাচার ঠেকাতে আমরা সব সময়ই সচেতন। মানব পাচারকে সামাজিক সমস্যা আখ্যা দিয়ে তা প্রতিরোধে স্থানীয়দের সহায়তা প্রত্যাশা করেন কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তোফায়েল আহমেদ। তিনি বলেন, শুধু কক্সবাজার নয়, চট্টগ্রামের উপকূলবর্তী উপজেলাগুলোতেও জড়ো করে মালয়েশিয়াগামীদের কাঠের ট্রলারে সেন্টমার্টিন দ্বীপের নিকটবর্তী মিয়ানমারের জল সীমান্তে অপেক্ষমাণ বড় ট্রলারে নেয়া হয়। এসব কাজে বিভিন্ন পর্যায়ের তিন শ’র মতো পাচারকারী যুক্ত। এদের মধ্যে মিয়ানমারের নাগরিকও রয়েছেন। যেভাবে পাচার হয় ॥ নিজ দেশের মানুষকে পাচারের মতো জঘন্যতম কাজটি করে থাকেন নিজেরাই। শুধু তাই নয়, পাচার মানেই মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া। গত বছরের ডিসেম্বরে পুলিশ সদর দফতরে মানব পাচার নিয়ে গঠিত কমিটির দেয়া প্রতিবেদন অনুযায়ী, স্থানীয় দালালরা মালয়েশিয়া গমনেচ্ছুদের কাঠের ট্রলারে করে মিয়ানমার সীমান্তবর্তী গভীর সমুদ্রে অপেক্ষায় থাকা বড় ট্রলারে নিয়ে যায়। সেখানে আরেক শ্রেণীর দালালের কাছে তাদের হস্তান্তর করা হয়। সেখান থেকেই শুরু হয় অনিশ্চিত যাত্রা। অবৈধভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগর পাড়ি দেয়ার সময় তারা মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার ও বাংলাদেশের পাচারকারীদের মধ্যে হাতবদল হয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার শাহপরীর দ্বীপসহ বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে মালয়েশিয়াগামীদের জড়ো করার হার বেশি বলে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়। পুলিশের তথ্যমতে, এর বাইরে কক্সবাজার সদর উপজেলার নয়টি, মহেশাখালীর চারটি, উখিয়ার ছয়টি, টেকনাফের ১৭টি, চকরিয়ার দুটি, পেকুয়ার দুটি, চট্টগ্রাম জেলার পাঁচটি এবং নগরীর তিনটি পয়েন্ট দিয়ে মালয়েশিয়াগামীদের জড়ো করে ট্রলারে তুলে দেয় দালালরা। এছাড়া নোয়াখালী, পটুয়াখালী, সাতক্ষীরা, খুলনা জেলার উপকূল থেকেও দালালরা মালয়েশিয়াগামীদের ট্রলারে করে মিয়ানমার সীমান্তবর্তী মানব পাচারকারীদের ট্রলারে তুলে দেয়। সাগরপথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় মানব পাচার কাজে উপকূলীয় এলাকায় শক্তিশালী সিন্ডিকেট রয়েছে। প্রায় ২৫ থেকে ৩০ জনের সিন্ডিকেটের মধ্যে গডফাদার রয়েছে। আগে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাসহ এই অঞ্চলের মানুষ নৌকায় করে মালয়েশিয়ায় যাত্রা করত। কিছু মানুষ থাইল্যান্ড পৌঁছে মোটা অঙ্কের টাকা পরিশোধ করে গন্তব্যে পৌঁছলেও অনেকেই ট্রলারডুবির ঘটনায় মারা যাচ্ছেন। অনেকে নিখোঁজ হচ্ছেন। আবার অনেকে ধরা পড়ে মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের কারাগারে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। অধিকাংশ দালাল যাত্রীদের সমুদ্রে নিয়ে জলদস্যুদর হাতে তুলে দিচ্ছেন। দসু্যুরা বেদম পিটিয়ে যাত্রীদের সর্বস্ব লুট করছে। ঘটছে ধর্ষণের মতো ঘটনাও। জলদস্যু, সন্ত্রাসী বাহিনী আর দালালের যোগসাজশে চলছে উপকূলে মানব পাচারের রমরমা বাণিজ্য। মানব পাচারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, গত তিন বছরে সমুদ্রপথে ১০ থেকে ১৫ হাজার মানুষ মালয়েশিয়ায় রওনা দিয়েছেন। এর মধ্যে একাধিক ট্রলারডুবির ঘটনায় অন্তত ৫০০ জনের মৃত্যু হয়েছে। নিখোঁজ দেড় হাজারের বেশি মানুষ। উপকূলে অনুসন্ধান চালিয়ে তারা এই তথ্য পেয়েছেন বলে জানান। বর্তমানে কক্সবাজার, বান্দরবান, চট্টগ্রাম, লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, কিশোরগঞ্জ, ঢাকা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, পাবনা, পঞ্চগড়, যশোর, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, জয়পুরহাট, সাতক্ষীরা, ময়মনসিংহ, ভোলা ও ঝিনাইদহসহ ৪১ জেলা থেকে সারা বছর মালয়েশিয়ায় মানব পাচারের জন্য কক্সবাজারের টেকনাফ,উখিয়া ও মহেশখালীতে পাচারকারী চক্র সংশ্লিষ্ট জেলার স্থানীয় দালালদের মাধ্যমে কমিশনের ভিত্তিতে লোক সংগ্রহ করে কক্সবাজারে পাঠায়। এ পাচারকারী চক্রের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য মোবাইল নম্বর দেয়া হয়। তারা ওই এলাকার দালালদের সঙ্গে যোগাযোগ করে মালয়েশিয়ার পথে রওনা হয়। ৬০টি স্থান দিয়ে মানব পাচার ॥ কক্সবাজার শহরের নুনিয়াছটা, ফিশারিঘাট, নাজিরাটেক, সমিতিপাড়া, মহেশখালীর সোনাদিয়া, গোরকঘাটা, কুতুবজোম, ধলঘাটা, উখিয়ার সোনারপাড়া, রেজুরখাল, ইনানী, ছেপটখালী, মনখালী, টেকনাফের বাহারছড়া, সাবরাং, শাহপরীরদ্বীপ, ঘোলারপাড়া, মাঝরপাড়া, পশ্চিমপাড়া, কাটাবনিয়া, খুরেরমুখ, হাদুরছড়া, জাহাজপুরা, কচ্ছপিয়া, শামলাপুর, সদরের ঈদগাঁও, খুরুশকুল, চৌফলদ-ী, পিএমখালী, চকরিয়া, পেকুয়া, চট্টগ্রামের বাঁশখালী, আনোয়ারা, পটিয়াসহ অন্তত ৬০টি স্থান দিয়ে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ সমুদ্রে নেমে বিপদে পড়ছেন। কিন্তু এসব স্থানে সর্বক্ষণিক পুলিশের নজরদারি নেই। এসব স্থান দিয়ে মানব পাচার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তোফায়েল আহমেদ বলেন, ৬০ কেন, ১২০ কিলোমিটারের পুরো সাগর উপকূলটাই আদম পাচারের নিরাপদ পয়েন্ট। এদিকে দেশের ৪১টি জেলা থেকে মানব সংগ্রহ করেছে পাচারকারীরা। চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, নরসিংদী ও উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলার সহজ-সরল লোকেরাই হচ্ছেন পাচারকারীদের প্রধান টার্গেট। জাতিসংঘের প্রতিবেদন ॥ ২০১৫ সালের প্রথম তিন মাসে বঙ্গোপসাগর দিয়ে নৌকায় করে প্রায় ২৫ হাজার বাংলাদেশী এবং রোহিঙ্গা পাচার করা হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় দ্বিগুণ বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা (ইউএনএইচসিআর)। গত শুক্রবার জেনেভায় এক সংবাদ সম্মেলনে ইউএনএইচসিআর-এর মুখপাত্র এ্যাড্রিয়ান এডওয়ার্ডস এক বিবৃতিতে এই তথ্য জানান। ইউএনএইচসিআর’র বিবৃতিতে বলা হয়, ঝুঁকি সত্ত্বেও অনেক মানুষ এই বিপদসঙ্কুল পথ ব্যবহার করে বিদেশ পাড়ি দিচ্ছেন। যার ফলে ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে প্রায় ২৫ হাজারের মতো বাংলাদেশী এবং রোহিঙ্গা মানবপাচারের শিকার হয়েছে। বেঁচে যাওয়া অভিবাসীদের তথ্যের উপর ভিত্তি করে বলা হয়েছে, ২০১৫ সালের প্রথম তিন মাসে অনাহার, পানিশূন্যতা এবং পাচারকারীদের নির্যাতনে আনুমানিক ৩০০ জন মানুষ সমুদ্রে মারা গেছে। ইউএনএইচসিআর-এর মুখপাত্র এ্যাড্রিয়ান এডওয়ার্ডস জানান, মানবপাচার করা একটি লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। ফলে শিশুদেরও অপহরণ এবং জোর করে মানবপাচারের উদ্দেশ্যে নৌকায় তোলা হয়। এছাড়া যারা বিদেশ যাওয়ার জন্য এসব পাচারকারীদের টাকা দেন তারা ভাবতেও পারেন না, তাদের থেকে জোর করে টাকা আদায় করা হবে। সমুদ্রপথে সর্বশেষ পাচারকারীদের তালিকা ॥ কক্সবাজার উপকূল দিয়ে সাগরপথে অবৈধভাবে মানব পাচারে ৭৯ জন গডফাদারের তালিকা প্রণয়ন করেছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। এই ৭৯ জন নামের তালিকা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশও করা হয়েছে। স্বারষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো তালিকায় এর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে খোদ কক্সবাজারের উখিয়া টেকনাফের আওয়ামী লীগের দলীয় সাংসদ আবদুর রহমান বদি, টেকনাফ পৌরসভার প্যানেল মেয়র-১ ও এমপি বদির ভাই মৌলভী মুজিবুর রহমান ও টেকনাফ উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আহমদের নাম শীর্ষে আছে। এই তালিকায় স্থান পাওয়া সকলের বাড়ি কক্সবাজার জেলায়। টেকনাফ ও উখিয়া এলাকায় এদের আধিপত্য রয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চার-পাঁচ বছর আগেও কক্সবাজার জেলার লোকজন পাচারকারীদের ২০ থেকে ৮০ হাজার টাকা দিয়ে অক্টোবর-ফেব্রুয়ারি মাসে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যেত। যাত্রাপথে ট্রলারসহ যেসব যাত্রী আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে ধরা পড়ত তাদের মধ্যে ৭০-৮০ শতাংশ যাত্রীই মিয়ানমার থেকে অনুপ্রবেশকৃত রোহিঙ্গা। মানবপাচার বন্ধ না হওয়ার কারণ হিসেবে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মানবপাচারকারী গডফাদারদের শনাক্তপূর্বক আইনের আওতায় না আনা এবং যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে তাদের আটক করে শাস্তি নিশ্চিত না করার কারণে মানবপাচার বন্ধ হচ্ছে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের অভিবাসন এবং শরণার্থী বিষয়ে গবেষণা সংস্থা রামরুর গবেষক ড. তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, বাংলাদেশ ছাড়িয়ে এই পাচার চক্র থাইল্যান্ড এবং মালেয়েশিয়ায়াতেও বিস্তৃত। থাই জলদস্যু থেকে শুরু করে, বাংলাদেশের দালাল চক্র এবং মালয়েশিয়ার একশ্রেণীর নিয়োগকর্তা মিলে এই চক্রটি পরিচালনা করছে। জাতিসংঘের দেয়া হিসাবে, বর্তমানে নৌকা করে থাইল্যান্ড হয়ে মালয়েশিয়ায় রওনা হওয়া লোকজনের ৪০ শতাংশের মতো বাংলাদেশী। তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বৈধ উপায়ে মালয়েশিয়া যাওয়ার সুযোগ সীমিত হওয়ায় বাংলাদেশীরাও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেদেশে যাওয়ার চেষ্টা করছে। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, গত তিন বছরে মাত্র সাড়ে সাত হাজারের মতো মানুষ বাংলাদেশ থেকে বৈধপথে মালয়েশিয়া যেতে পেরেছে। পরিসংখ্যান ॥ যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ‘ট্রাফিকিং ইন পার্সনস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, পাচাররোধে বাংলাদেশ ‘টায়ার-২’ এ অবস্থান করছে। যার অর্থ, পাচার বন্ধে বাংলাদেশ ন্যূনতম মাপকাঠিও পূরণ করতে সক্ষম হয়নি। অন্যদিকে ভারতে যৌনবাণিজ্যে বাংলাদেশী নারীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে দিল্লী­ সরকার। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের তথ্যে, প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে ১০ থেকে ১৫ হাজার মানুষ পাচারের শিকার হচ্ছে। আর বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির তথ্যে এ সংখ্যা ২০ হাজার। ভারতের ‘টাইমস অব ইন্ডিয়ায়’ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৫০ হাজার লোক পাচারের শিকার হচ্ছে। ‘ট্রাফিকিং ইন পার্সনস’ শীর্ষ প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে সংশ্লিষ্টদের পাচারের শিকার ব্যক্তিদের শনাক্তকরণে যথাযথ ব্যবস্থা জানা নেই। বাংলাদেশ হচ্ছে মানবপাচারের উৎসস্থল এবং এ দেশ থেকে পাচার হওয়া নারী-পুরুষ ও শিশুরা জোরপূর্বক শ্রম ও যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে ভারত ও পাকিস্তানে পাচার হওয়া নারী-শিশুদের যৌন ব্যবসার শিকার হতে হচ্ছে। এ দেশ থেকে রোহিঙ্গাদের পাচার হওয়ার ঘটনাও বৃদ্ধি পেয়েছে। সমুদ্রপথে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত হয়ে এক বছরের ব্যবধানে মানব পাচার বেড়েছে ৬১ শতাংশ। প্রধানত মালয়েশিয়ার উদ্দেশে পাচার হওয়া এসব মানুষের মধ্যে বাংলাদেশীদের পাশাপাশি রোহিঙ্গাও রয়েছে। গত বছর জাতিসংঘের উদ্বাস্তুবিষয়ক হাইকমিশনের (ইউএনএইচসিআর) বার্ষিক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৩ সালের জুলাই থেকে ২০১৪ সালের জুন পর্যন্ত মালয়েশিয়ার উদ্দেশে বঙ্গোপসাগর দিয়ে অবৈধভাবে গেছেন ৫৩ হাজার লোক। আগের বছর এ সংখ্যা ছিল প্রায় ৩৩ হাজার। অক্টোবর থেকে জানুয়ারি মাসে সবচেয়ে বেশি পাচারের ঘটনা দেখা গেছে। অভিবাসন ও মানব পাচারবিষয়ক দেশীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিফিউজি এ্যান্ড মাইগ্রেটিং মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট বা রামরুর মতে, এক বছরের ব্যবধানে মানব পাচার বৃদ্ধির এই পরিসংখ্যান খুবই উদ্বেগজনক। পাচাররোধে সরকারের পক্ষ থেকে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় এ সংখ্যা বেড়েছে। রামরুর হিসাবে, ২০১৪ সালে পাচারের সময় বাংলাদেশীদের মধ্যে ৫৪০ জন গভীর সমুদ্রে মারা গেছেন। নিখোঁজ রয়েছেন অনেকেই। তাঁদের মধ্যে কেবল সিরাজগঞ্জ জেলার বাসিন্দা প্রায় ৫০০। একই জেলার ২৫০ জনের সন্ধান মিলেছে থাইল্যান্ডের বিভিন্ন কারাগারে। তিন হাজার ৫০০ পরিবারের অধিকাংশ থেকেই মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ আদায় করেছে পাচারকারীরা। রামরুর ও ইউনিভার্সিটি অব সাসেক্সের করা যৌথ সমীক্ষায় দেখা যায়, জলবায়ু দুর্যোগের কারণে ১ কোটি ৬০ লাখ থেকে ২ কোটি ৬০ লাখ মানুষের স্থায়ী নিবাস থেকে স্থানান্তরিত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এসব ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকেই টার্গেট করা হচ্ছে পাচারের জন্য। রামরুর পরিচালক তাসনীম সিদ্দিকী বলেন, সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ভোলা, সিরাজগঞ্জ, বরিশাল, রংপুর ও কুড়িগ্রামের মতো ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, নদীভাঙন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার এলাকার লোক, যাঁরা অন্য জেলায় স্থানান্তরের কথাও চিন্তা করতেন না, তাঁরাই এখন সমুদ্রপথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার দুঃসাহস দেখাচ্ছেন। কারণ, তাঁদের সামনে উন্নতির আর কোন পথ নেই। সম্প্রতি থাইল্যান্ডের মতো মালয়েশিয়াতেও মানব পাচারকারীদের বন্দীশিবিরের সন্ধান পাওয়া গেছে। আর সংখ্যায় তা অনেক বেশি। গত সপ্তাহে থাইল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলীয় গভীর জঙ্গলে কমপক্ষে ছয়টি বন্দীশিবির এবং সেখানকার কবর থেকে ৩২ জন বাংলাদেশী ও রোহিঙ্গা অভিবাসীর দেহাবশেষ ও কঙ্কাল উদ্ধার করা হয়। তারপর থেকে এ অভিযোগ উঠেছে। চলতি বছর জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত মাত্র তিন মাসে বঙ্গোপসাগর দিয়ে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের উদ্দেশে পাড়ি দিয়েছে ২৫ হাজার বাংলাদেশী ও রোহিঙ্গা। ২০১৩ সালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালিয়ে ১০২৮ জন অবৈধভাবে সাগরপথে মালয়েশিয়াগামীকে উদ্ধার করে। এ ঘটনায় আটক করে ১১৩ জন পাচারকারীর দলের সদস্যকে। এ ব্যাপারে ৪২৭ জনকে আসামি করে ৮১টি মামলা লিপিবদ্ধ করা হয়। ২০১৪ সালের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালিয়ে ২৩৫ জন অবৈধভাবে সাগরপথে মালয়েশিয়াগামীকে উদ্ধার করে। এ ঘটনায় আটক করে ৬৩ জন পাচারকারীর দলের সদস্যকে। এ ব্যাপারে ১৯০ জনকে আসামি করে ৫৮টি মামলা লিপিবদ্ধ করা হয়। ইউএনডিপির তথ্য ॥ এক দশকে বাংলাদেশ থেকে ১২ থেকে ৩০ বছর বয়সী প্রায় তিন লাখ নারী ও শিশু পাচার হয়েছে। বিভিন্ন মানবাধিকার, নারী ও শিশুকল্যাণ সংগঠনের গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত তিন দশকে বাংলাদেশ থেকে ১০ লাখের বেশি মানুষ পাচার হয়েছে। সবচেয়ে বেশি পাচারের শিকার হয়েছে সীমান্তবর্তী জেলার বাসিন্দারা। তবে সম্প্রতি সাগরপথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার বাসিন্দাদের ভাল চাকরির আশ্বাস দিয়েও পাচার করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা জানান, পাচারকৃত বাংলাদেশী নারীদের যৌনবৃত্তি, গৃহকর্মী, পর্নো চলচ্চিত্র নির্মাণ কাজে এবং শিশুদের অঙ্গহানি করে ভিক্ষাবৃত্তি, মাদক বহন ও উটের জকি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি নির্বাহী পরিচালক, সালমা আলী বলেন, বাংলাদেশে মানব পাচার অপরাধের শিকার ব্যক্তিদের সুরক্ষা ও অধিকার বাস্তবায়ন, নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিত করা এবং পাচারকারীদের শাস্তির জন্য রয়েছে মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন, ২০১২। মানব পাচার প্রতিরোধ সংক্রান্ত জাতিসংঘ কনভেনশন ২০০০ এবং সার্ক কনভেনশন অনুসরণ করে সংঘবদ্ধভাবে সংঘটিত আন্তঃদেশীয় অপরাধগুলো প্রতিরোধ ও দমনের জন্য আন্তর্জাতিক মানদ-ের সঙ্গে এ আইনকে সঙ্গতিপূর্ণ করা হয়েছে। এই আইন অভ্যন্তরীণ ও আন্তঃদেশীয় সব ধরনের মানব পাচারকে অপরাধ বলে গণ্য করার পাশাপাশি পৃথক ট্রাইব্যুনাল গঠন করে অপরাধীদের কঠোর শাস্তির বিধান করেছে, যদিও অদ্যাবধি এ ধরনের পৃথক ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়নি। তিনি বলেন, তাছাড়া সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি কর্তৃক অপরাধ মানব পাচার সংক্রান্ত মামলাগুলো নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে পরিচালিত হচ্ছে, যার ফলে মামলাজট আশঙ্কতাজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তদন্ত কাজ ৯০ দিনের মধ্যে সম্পন্ন করার বিধান থাকলেও সমিতির এ্যান্টি ট্রাফিকিং সেল কর্তৃক ৩০টি মামলা মনিটর করে দেখা যায়, গড়ে তদন্ত কাজ শেষ করতে সময় লেগেছে ১৯৫ দিন। এদিকে থাইল্যান্ডে আটক দুই শতাধিক বাংলাদেশী ও রোহিঙ্গা অভিবাসীদের বিচারের মুখোমুখি করা হবে বলে জানিয়েছে দেশটির পুলিশ। বৃহস্পতিবার থাই পুলিশের এক বিবৃতির বরাত দিয়ে এ খবর জানিয়েছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম। দেশটিতে অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে তাদেরকে বিচার করা হবে বলে বিবৃতিতে জানায় পুলিশ। এর আগে, থাইল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলীয় এক জঙ্গলে ‘গণকবরের’ সন্ধান পাওয়ার পর দেশটিতে মানব পাচারবিরোধী অভিযান শুরু করে পুলিশ। এরই প্রেক্ষিতে গত প্রায় ১৫ দিনে আড়াই শতাধিক বাংলাদেশী ও মিয়ানমারের রোহিঙ্গা আটক হয়েছে বলে জানা গেছে। থাইল্যান্ড পুলিশের উপপ্রধান আয়েক আংসানানন্ট জানান, পুলিশ এরই মধ্যে এক শ’ ৮৭ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছে। এবার এসব মামলার আইনী প্রক্রিয়া শুরু হবে। এদিকে অবৈধ অনুপ্রেবেশকারীদে বাংলাদেশ সহ মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বৃহস্পতিবার মালয়েশিয়ার এক সরকারী কর্মকর্তার বরাত দিয়ে এ খবর দিয়েছে দেশটির সংবাদপত্র ব্যাংকক পোস্ট ও রয়টার্স। প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশটির পেনাং রাজ্যের উত্তর সমুদ্র উপকূলে তাদের খাবার ও ওষুধ দিয়ে ফেরত পাঠানো হয়। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার তথ্য মতে, মালয়েশিয়ায় অবৈধ অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা দেড় লাখ। এরমধ্যে ৪৫ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা।
×