ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সদস্যরা কেউ কাউকে চেনে না

ব্লগার কিলিং মিশনে জঙ্গীদের সিøপার সেল

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ১৪ মে ২০১৫

ব্লগার কিলিং মিশনে জঙ্গীদের সিøপার সেল

শংকর কুমার দে ॥ ভয়ঙ্কর প্রকৃতির সিøপার সেল। এই সিøপার সেল গঠন করেই ব্লগার কিলিং মিশনে নেমেছে জঙ্গী সংগঠন। একেকটি জঙ্গী সংগঠনে সিøপার সেল রয়েছে শতাধিক। সিøপার সেলের সদস্যদের একজন সদস্যের সঙ্গে অন্য সদস্যের থাকে না কোন পরিচয়। এমনকি কিলিং মিশনে অংশ নেয়ার আগ পর্যন্ত সিøপার সেলের সদস্যরা একে অপরের কাছে থাকে অচেনা, অপরিচিত। ব্লগার হত্যা করা তাদের ওপর ‘ফরজ’ বলে নাজিল হয়েছে। বেহেস্ত পেতে হলে তাদের এ হত্যা করতেই হবে। এ কারণে একজন সদস্য অপর সদস্যের ব্যাপারে বিস্তারিত কোন তথ্যই জানেন না বা জানতে দেয়া হয় না। সিøপার সেলের প্রধান তাদের নির্দিষ্ট ব্যক্তির ছবি দেখিয়ে দেয়। ঐ ব্যক্তির অবস্থান সম্পর্কে রেকি করা হয়। এরপর নির্দিষ্ট সময় চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। সর্বশেষ সিলেটে যে মুক্তমনা লেখক ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ খুন হলেন, তার খুনের ধরনও আগের মুক্তমনা লেখক ব্লগারদের মতোই। এ কারণেই ব্লগার হত্যাকারীদের চিহ্নিত করতে বা চিহ্নিত হলেও গ্রেফতার করতে পারছে না র‌্যাব, পুলিশ, গোয়েন্দাসহ আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। জঙ্গী সংগঠনের সিøপার সেলের মাধ্যমেই সিলেটে মুক্তমনা লেখক ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ, মিরপুরে ব্লগার আহমেদ রাজীব, ঢাবি ক্যাম্পাসে লেখক ও ব্লগার অভিজিত রায়, রাবি শিক্ষক ড. মোহাম্মদ ইউনুস, ড. এ কে এম শফিউল ইসলাম, ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবু, শান্ত-মারিয়ম ইউনিভার্সিটির ব্লগার নেয়াজ মোর্শেদ বাবু, ডেফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আশরাফুল ইসলামকে হত্যা করা হয় বলে গোয়েন্দারা মনে করেন। একটি সিøপার সেলের সদস্যরা অন্য সিøপার সেলের সদস্যদের চিনে না। তেজগাঁওয়ে ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবু খুনের সময় হাতেনাতে গ্রেফতার হওয়া জিকির ও আরিফকে জিজ্ঞাসাবাদ করে সিøপার সেল সম্পর্কে এই ধরনের তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দারা। উইকিপিডিয়াতে ‘সিøপার সেল’ সম্পর্কে বলা আছে, একদল মানুষ লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে কোন সন্ত্রাসী বা সহিংস কর্মকা- না করা পর্যন্ত তাদের জানা যায় না। এদের ‘সিøপার সেল’ বলা হয়। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও যুক্তরাজ্যে সামরিক বাহিনী ও গোয়েন্দা বাহিনীতে সিøপার সেল গঠন করে অপারেশন চালানোর ঘটনার উদাহরণ আছে। ইউরোপে আয়ারল্যান্ডে প্রভিশনাল আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি (পিরা) নামে একটি সংগঠনে সিøপার সেল গঠনে তথ্য জানা যায়। এশিয়া মহাদেশে সর্বপ্রথম ভিয়েতনামে কোন সরকারের বিরুদ্ধে এই সিøপার সেল অপারেশন চালায়। দক্ষিণ ভিয়েতনামের ন্যাশনাল ফ্রন্ট অব লিবারেশন (এনএফএল) নামে একটি সংগঠনে সিøপার সেল গঠন করে অপারেশন চালানো হয়। মধ্যপ্রাচ্যের আফগানিস্তানে আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন আল কায়েদায় হামলা চালানো হচ্ছে। এরই ধারবাহিকতায় বাংলাদেশে জঙ্গী সংগঠনগুলোর মধ্যে এ ধরনের সিøপার সেল এখন সক্রিয় বলে জানতে পেরেছে গোয়েন্দারা। র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার একজন কর্মকর্তা বলেন, জঙ্গী সংগঠনগুলোর মধ্যে সিøপার সেল সদস্যরাই ব্লগার খুনে একই ধরনের হত্যা কার্যক্রম চালাচ্ছে। জেএমবি, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, হিযবুত তাহরীরসহ বেশ কয়েকটি জঙ্গী সংগঠনের মধ্যে শতাধিক সিøপার সেল সক্রিয়। তারা প্রযুক্তিগতভাবেও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা জানান, সিøপার সেলে কমপক্ষে ৫জন থেকে সর্বোচ্চ সাতজনের সদস্য মিলে একটি গ্রুপ। এর মধ্যে একজন থাকে দলনেতা। তাদের প্রত্যেককে একে অপরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় মূল পরিকল্পনাকারী। দলনেতাই প্রত্যেক সদস্যকে মিশনের পরিকল্পনা সম্পর্কে জানিয়ে দেয়Ñ কাকে, কীভাবে খুন করতে হবে। পরিকল্পনাকারী নিজেই সিøপার সেলের সদস্যদের অস্ত্র সরবরাহ করে। তারা বেশিরভাগ সময় ধারালো চাপাতিসহ ছোরা জাতীয় অস্ত্র ব্যবহার করে। কুপিয়ে ও গলাকেটে হত্যার পাশাপাশি বিশেষ ধরনের ইনজেকশনও ব্যবহার করে তারা। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, সিøপার সেলের কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ ও নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে হত্যার নির্দেশের ক্ষেত্রে জেএমবি সদস্যরা গোপন আইপি (ইন্টারনেট প্রটোকল) ঠিকানা ব্যবহার করছে। সম্প্রতি ঢাকার মিরপুরের মনিপুর স্কুল ও কলেজের দুই শিক্ষককে হত্যার জন্য সিøপার সেলের সদস্যদের গোপন আইপি ঠিকানাসহ একটি ওয়েবসাইট থেকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। ঐ ওয়েবসাইটে ঢোকার জন্য সিøপার সেলের সদস্যরা প্রত্যেকে ভিন্ন ভিন্ন পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে। ঐ দুই শিক্ষককে হত্যা করতে গিয়ে এই সিøপার সেলের সদস্য রুবেল গোয়েন্দা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়। গ্রেফতার হওয়ার পর জিজ্ঞাসাবাদে এই ধরনের তথ্য জানায় তারা। ব্লগার খুনের তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, রাজধানীর তেজগাঁওয়ে মুক্তমনা লেখক ও ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবু খুনের সময়ে হাতেনাতে জিকরুল্লাহ ও আরিফ নামের দুই জন হাতে নাতে ধরা পড়ার পর তাদের সহযোগী আবু তাহের এবং পরিকল্পনাকারী মাসুম বলে জানানোর পরও তাদের গ্রেফতার করতে পারেনি তদন্তকারী আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। একইভাবে অভিজিত রায় হত্যাকান্ডের ঘটনাটির ধরন ও কৌশল একই ধরনের এবং খুনীরা চিহ্নিত বা গ্রেফতার না হওয়ায় খুনের সঙ্গে সিøপার সেলের সদস্যরাই জড়িত বলে মনে করেন তদন্তকারী গোয়েন্দারা।
×