ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এ পর্যন্ত পাঁচ ব্লগার খুন, ধরন একই

প্রকাশিত: ০৫:২৬, ১৩ মে ২০১৫

এ পর্যন্ত পাঁচ ব্লগার খুন, ধরন একই

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সিলেটে এক ব্লগার খুনের মধ্য দিয়ে এ পর্যন্ত পাঁচ ব্লগার খুনের ঘটনা ঘটল। পাঁচজনের মধ্যে লেখক অভিজিত রায় ও সিলেটের বিজয় হত্যার দায় সরাসরি স্বীকার করেছে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম। অন্য তিনজন শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চের ইঞ্জিনিয়ার আহমেদ রাজীব হায়দার শোভন, ওয়াশিকুর রহমান বাবু ও বুয়েট ছাত্রলীগ নেতা আরিফ রায়হান দীপ হত্যাকারীরা গ্রেফতার হওয়ার পর আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য বলে হত্যার দায় স্বীকার করে। ঢাকার বাইরে কোন জেলায় ব্লগার খুনের ঘটনায় নতুন করে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। জেলাগুলোতেও আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের তৎপরতা থাকার বিষয়টি প্রকাশ পেয়েছে। এ ধরনের উগ্র মৌলবাদী সংগঠন ও জঙ্গীদের দমন করতে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বিশেষ স্কোয়াড গঠনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। দ্রুত স্কোয়াড গঠনের কাজ চলছে। ব্লগারদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেও সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে কড়া নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। মঙ্গলবার সকাল সাড়ে আটটার দিকে সিলেট নগরীর সুবিদবাজার এলাকায় চার মুখোশধারী ব্লগার বিজয়কে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাতে হত্যা করে। এর আগে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি অমর একুশে বইমেলা থেকে বাসায় ফেরার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিত রায়কে (৪০) একই কায়দায় দুইজন কুপিয়ে হত্যা করে। হত্যাকারীদের ছুরিকাঘাতে আহত হন তাঁর স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা (৩০)। বন্যার বাম হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি খুনীদের চাপাতির কোপে কেটে পড়ে যায়। বর্তমানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসাধীন। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হওয়ায় সেদেশটির কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থার (এফবিআই) একটি দল ঘটনা তদন্তে বাংলাদেশে এসে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশকে তদন্তে সহায়তা করে। ঘটনাস্থল থেকে সংগৃহীত আলামতের ডিএনএ পরীক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের একটি পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়। তদন্তের ধারাবাহিকতায় গ্রেফতার হয় অভিজিত হত্যার পর ফেসবুকে হত্যার দায় স্বীকার করে আনসার বাংলা-৭ নামে স্ট্যাটাস দেয়া ছাত্র শিবিরের সাবেক কর্মী বর্তমানে জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য শফিউর রহমান ফারাবী। তাকে কয়েক দফায় রিমান্ডে নেয়া হয়। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ফারাবীর কাছ থেকে এবং তদন্তের ধারাবাহিকতায় বেরিয়ে আসে ব্লগার হত্যার দীর্ঘ তালিকা। সেই তালিকায় প্রায় শ’খানেক ব্লগারের নাম রয়েছে। তালিকায় সদ্য খুন হওয়া ব্লগার বিজয়ের নামও ছিল। এর আগে গত ৩০ মার্চ রাজধানীর রমনা মডেল থানাধীন হাতিরঝিল বেগুনবাড়ীতে দিনের বেলায় ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। হত্যার পর পালানোর সময় জনতা দুইজনকে আটক করে। আটককৃতরা মাদ্রাসা ছাত্র। তাদের একজন চট্টগ্রাম হাটহাজারী মাদ্রাসার ছাত্র। অপরজন ঢাকার যাত্রাবাড়ীর একটি মাদ্রাসার ছাত্র। গ্রেফতারকৃতরা আদালতে দেয়া জবানবন্দীতে জানায়, তারা ইমানি দায়িত্ব পালন করতে বাবুকে হত্যা করেছে। বাবুকে হত্যার জন্য তারা অনুতপ্ত নয়। তারা আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য বলে নিশ্চিত হয় গোয়েন্দারা। এর আগে ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বইমেলা থেকে বের হওয়ার পথে টিএসসিতে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে লেখক হুমায়ুন আজাদকে আহত করা হয়। পরবর্তীতে তিনি বিদেশে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি গণজাগরণ মঞ্চের ব্লগার ইঞ্জিনিয়ার আহমেদ রাজীব হায়দার শোভনকে কুপিয়ে ও জবাই করে রাজধানীর পল্লবীর পলাশ বাড়ির নিজ বাসার সামনে হত্যা করা হয়। সোমবার মামলাটি ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত থেকে ঢাকার তিন নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়। মামলার প্রধান আসামি রেদোয়ানুল আজাদ রানা পলাতক। অন্য আসামিরা হচ্ছেন, নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল এ্যান্ড ইলেকট্রনিক এবং ইলেকট্রিক্যাল এ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশনস বিভাগের বহিষ্কৃত ছাত্র সাদমান ইয়াছির মাহমুদ, ফয়সাল বিন নাঈম দীপ, এহসান রেজা রুম্মান, মাকসুদুল হাসান অনিক, নাঈম ইরাদ ও নাফিজ ইমতিয়াজ এবং আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান মুফতি মোঃ জসীমুদ্দিন রাহমানী। এ মামলায় একমাত্র মুফতি জসীমুদ্দিন রাহমানী ব্যতীত অন্য আসামিরা আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়। তারা ইমানি দায়িত্ব পালন করতেই রাজীবকে হত্যা করেছে বলে বিচারকের কাছে জবানবন্দী দেয়। তারা আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য। রাজীব হত্যার জন্য তারা অনুতপ্ত নয় বলেও জবানবন্দীতে জানায়। রাজীবের জানাজা আদায়কারী ইমামকে হত্যার হুমকি দিয়ে আলোচনায় আসে অভিজিত হত্যা মামলায় গ্রেফতারকৃত শফিউর রহমান ফারাবী। পরে ফারাবী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিবিরের মেস থেকে গ্রেফতার হয়। জামিনে বের হওয়ার পর থেকেই ফারাবী অভিজিত রায়সহ প্রগতিশীল লেখকদের নানাভাবে ফেসবুকে হুমকি দিয়ে আসছিল। এছাড়া ২০১৩ সালের গত ৯ এপ্রিল দিনদুপুরে বুয়েটের ছাত্রলীগ নেতা ও যন্ত্রকৌশল বিভাগের তৃতীয় বর্ষের আবাসিক ছাত্র ব্লগার আরিফ রায়হান দ্বীপকে নিজ কক্ষ ডেকে নিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। পরবর্তীতে হত্যাকারী বুয়েট ছাত্র মেজবাহ উদ্দিন গ্রেফতার হয়। গ্রেফতারের পর মেজবাহ আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়। জবানবন্দীতে তিনি জানান, দ্বীপকে হত্যার মাধ্যমে তিনি ইমানি দায়িত্ব পালন করেছেন। মূলত ইমানি দায়িত্ব পালন করতেই তিনি দ্বীপকে হত্যা করেছেন। দ্বীপকে হত্যার জন্য তিনি অনুতপ্ত নন। আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের আধ্যাত্মিক নেতা মুফতি জসীমুদ্দিন রাহমানীর বয়ানে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি দ্বীপকে হত্যা করেছেন। এছাড়াও ২০১৩ সালের ২১ ডিসেম্বর সন্ধ্যা সোয়া ছয়টার দিকে রাজধানীর ওয়ারী থানাধীন রামকৃষ্ণ (আর কে) মিশন রোডের বাড়িতে জবাই করে ইমাম মাহদীর প্রধান সেনাপতি ও বিশ্ব ত্রাণকর্তা দাবিদার লুৎফোর রহমান ফারুক (৫৫), তার ছেলে বেসরকারী সিটি ব্যাংকের সদরঘাট শাখার জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা সানোয়ারুল ইসলাম মনির (৩০), গৃহকর্মী হিসেবে ওই বাড়িতে থাকা লুৎফোর রহমানের সেবক বা খাদেম মঞ্জুর আলম (২৮), মুজিবুল সরকার (৩২), শাহীন (২৪) ও রাসেলকে (৩৭) জবাই করে হত্যা করা হয়। ২০১৪ সালের ২৭ আগস্ট রাজধানীর তেজগাঁও থানাধীন পূর্ব রাজাবাজারের নিজ বাড়িতে বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেল আইয়ের শান্তির পথে ও কাফেলা নামক ইসলামী অনুষ্ঠানের উপস্থাপক মাওলানা নুুরুল ইসলাম ফারুকীকে জবাই করে হত্যা করা হয়। হত্যাকারীরা আজও শনাক্ত হয়নি। তদন্তকারী সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, প্রতিটি হত্যাকা-ের ধরন একই। উগ্র মৌলবাদীরাই হত্যাকা-ের ঘটনাগুলো ঘটিয়েছে। ঘটে যাওয়া হত্যাকা-ের মধ্যে ব্লগার রাজীব, অভিজিত, বাবু, দ্বীপ ও বিজয় হত্যাকারীরা আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তবে গোপীবাগের সিক্সমার্ডার ও মাওলানা ফারুকী হত্যাকা-ের দায় এখন পর্যন্ত কেউ স্বীকার করেনি। ধারণা করা হচ্ছে, এ দুইটি হত্যাকা-ের ঘটনাও আনসারুল্লাহ বাংলা টিম ঘটাতে পারে। আনসারুল্লাহ বাংলা-সেভেনের পর বিজয় হত্যায় আনসারুল্লাহ বাংলা-৮ এর দায় স্বীকার নতুন রহস্যের জন্ম দিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের ১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬ ছাড়াও আরও বিভিন্ন গাণিতিক সংখ্যা হিসেবে বিভিন্ন জেলায় তাদের তৎপরতা থাকতে পারে। উগ্র মৌলবাদী ও জঙ্গী দমনে সরকার বিশেষ স্কোয়াড গঠন করছে। এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাবনা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে রয়েছে। দ্রুত স্কোয়াড গঠনের প্রক্রিয়া চলছে।
×