ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

আওয়ামী লীগের একশ্রেণীর শুভাকাক্সক্ষীর রজ্জুতে সর্পভ্রম

প্রকাশিত: ০৩:৪০, ১৩ মে ২০১৫

আওয়ামী লীগের একশ্রেণীর শুভাকাক্সক্ষীর রজ্জুতে সর্পভ্রম

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক একটি মন্তব্য নিয়ে আওয়ামী লীগের একটি শুভাকাক্সক্ষী মহলে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। আমি এই শুভাকাক্সক্ষীদের কাছ থেকে এ যাবত বেশ কয়েকটি টেলিফোন কল এবং টেক্সট মেসেজ পেয়েছি। কিছুদিন আগে শেখ হাসিনা বলেছেন, ড. ইউনূসের চক্রান্তেই বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের পদ্মা সেতু প্রকল্পে টাকা দেয়নি। হিলারি ক্লিনটনের মাধ্যমে ড. ইউনূস বিশ্বব্যাংককে প্রভাবিত করেছিলেন। এটা একটা সাহসী উক্তি। কিন্তু আওয়ামী লীগের দুর্বলমনা একশ্রেণীর সমর্থক ও শুভাকাক্সক্ষী ভয় পেয়েছেন। তাদের অভিমত, আমেরিকার আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট দলের প্রার্থী হিসেবে হিলারি ক্লিনটনের জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বারো আনা। এই অবস্থায় তার সম্পর্কে শেখ হাসিনার অভিযোগটি সঠিক হলেও এখন বলা উচিত হয়েছে কি? আগামী নির্বাচনে জয়ী হয়ে বিশ্বের একক পরাশক্তির নেতা হিসেবে হোয়াইট হাউসে ঢোকার যার সম্ভাবনা রয়েছে, বাংলাদেশের মতো এক ছোট ও দুর্বল দেশের পক্ষে তাকে ক্ষেপানো উচিত হলো কি? আওয়ামী লীগের একশ্রেণীর শুভাকাক্সক্ষী জানতে চেয়েছেন এ সম্পর্কে আমার অভিমত কি এবং বিষয়টি নিয়ে লেখালেখি করিনি কেন? আমি তাদের বলেছি এটা লেখালেখির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে আমার মনে হয়নি। শেখ হাসিনা একটি ছোট দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন, কিন্তু বহু সময়ে দেশের সম্মান ও মর্যাদার প্রশ্নে নতজানু হয়ে কথা বলেননি। এই সাহস ও জাতীয় মর্যাদাবোধের জন্যই একটি ছোট ও দুর্বল দেশের প্রধানমন্ত্রীর এতো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। আমেরিকা বিশ্বের একক সুপার পাওয়ার হতে পারে। কিন্তু তার নেতাদের অন্যায় ও অসংযত এবং বলদর্পী কথা ও কাজের সমালোচনা করা যাবে না এটা ঠিক নয়। আমেরিকার ধমকের কাছে নতি স্বীকার না করে ক্যাস্ট্রো থেকে আসাদ বহু নেতা এখনও টিকে আছেন। ধমকের কাছে নতি স্বীকার করেও সাদ্দাম, গাদ্দাফিকে নিষ্ঠুর পরিণতি বরণ করতে হয়েছে। আমেরিকার সঙ্গে ডিলিংয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অতীতের সরকারগুলোর সঙ্গে বর্তমান হাসিনা সরকারের পার্থক্য এই যে, অতীতের সরকারগুলোর মতো মার্কিন আধিপত্যের কাছে সরাসরি মাথা নিচু না করে বর্তমান হাসিনা সরকার একটি আত্মমর্যাদাশীল নীতি অনুসরণ করছেন। এই নীতিটি হলো আমেরিকার সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রেখে দেশের স্বার্থ ও মর্যাদা ক্ষুণœœ হতে না দেয়া। এই নীতির সাফল্য দেখার পরও আমাদের অনেকের ভয় পাওয়ার কারণটা কি? আমেরিকার অর্থনীতি এবং সামরিক শক্তি দুটোই এখন যুদ্ধক্লান্ত। তাই ওবামা প্রশাসন আগের হুমকি-ধমকির পথ ত্যাগ করে এতকালের শত্রুপক্ষের সঙ্গেও আপস ও সহাবস্থানের পথ ধরেছেন। ক্যাস্ট্রোর কিউবা ও খোমেনির ইরানের সঙ্গে আমেরিকা সন্ধি করে চলতে চাইছে। বাংলাদেশের ব্যাপারেও দেখা যাচ্ছে, আগেকার চোখ রাঙানির ভাব এখন অনেকটা কম। ঢাকায় নিযুক্ত আগেকার মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজেনা নয়, ভাইসরয়ের ভাবসাব নিয়ে বাংলাদেশে ঘুরে বেড়াতেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারেও তার অধিকারের সীমা অতিক্রম করে কথাবার্তা বলেছেন। ঢাকা থেকে বিদায় নেয়ার আগে প্রায় এক বছরের মতো তিনি প্রধানমন্ত্রী হাসিনার সাক্ষাতপ্রার্থী হয়েও সাক্ষাত পাননি। তখনও অনেকে ভয় পেয়েছিলেন, বলেছেন, মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে এই ধরনের ব্যবহার বাংলাদেশ ও শেখ হাসিনার জন্যও কল্যাণকর নয়। কিন্তু সময়ই প্রমাণ করেছে, শেখ হাসিনা কূটনৈতিক সাহস ও প্রজ্ঞার সঙ্গে মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে বুঝিয়ে দিয়েছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে প্রভুসুলভ আচরণ করার দিন শেষ হয়ে গেছে। ড্যান মজেনা ভালভাবে এই মেসেজটি পেয়েছেন এবং ঢাকা ত্যাগের আগে গদগদ ভাষায় শেখ হাসিনার প্রশংসা করে গেছেন। হিলারি ক্লিনটনও প্রথম ওবামা প্রশাসনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে তাদের বন্ধু ড. ইউনূসের চাপে গ্রামীণ ব্যাংকের মতো বাংলাদেশের একটি অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হাসিনা সরকারের ওপর অশোভন ও অধিকার বহির্ভূত চাপ প্রয়োগ করেছেন। হাসিনা সেই চাপের কাছে নতজানু হননি। তখনও আওয়ামী লীগ সরকারের অনেক শুভাকাক্সক্ষী ভয় পেয়েছেন। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনকে ক্ষেপানো হয়েছে। হায় হায় সব গেল! এখন ঢাকার ইউনূস সেন্টার থেকে যতোই বিজ্ঞপ্তি প্রচার করে বলা হোক, পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের অর্থ সাহায্য প্রত্যাহারের পেছনে ড. ইউনূসের প্ররোচনায় হিলারি ব্যাংকটির ওপর কোন চাপ প্রয়োগ করেননি; তা যে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা এটা এখন ওপেন সিক্রেট। হিলারি ক্লিনটনও সম্ভবত পরে উপলব্ধি করেছেন, ড. ইউনূসের মতো একজন ব্যক্তিবিশেষের পক্ষাবলম্বন করে যুক্তরাষ্ট্রের মতো সুপার পাওয়ারের পক্ষে একটি ভিন্ন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ এবং তার অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলানো ঠিক হয়নি। এই উপলব্ধি থেকেই হয়ত পরবর্তীকালে আন্তর্জাতিক জলবায়ু সংক্রান্ত এক সম্মেলনে শেখ হাসিনার প্রতি তিনি সম্মান দেখিয়েছেন এবং এই সমস্যার ব্যাপারে হাসিনার ভূমিকার প্রশংসা করেছেন। ভবিষ্যতে হিলারি ক্লিনটন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তার ভূমিকার কথা স্মরণ রাখবেন এবং ড. ইউনূসের সঙ্গে তাদের সখ্য ও সম্পর্ক বজায় থাকলেও বাংলাদেশের সঙ্গে সহযোগিতার প্রশ্নে সতর্ক হবেন এটা আশা করা যায়। শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু প্রকল্পের ব্যাপারে হিলারি ক্লিনটনের অতীতের ভূমিকার উল্লেখ করে তাকে আরও সতর্ক করে দিয়েছেন। অনেক মার্কিন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরই ধারণা, আগামী নির্বাচনের পর হিলারি ক্লিনটন যদি সত্যি হোয়াইট হাউসে ঢোকেন, তিনি বর্তমান ওবামা প্রশাসনের বাংলাদেশ সংক্রান্ত স্থিতাবস্থা রক্ষায় নীতির পরিবর্তন সাধন আমেরিকার স্বার্থেই মোটেও চাইবেন না। আওয়ামী লীগের একশ্রেণীর শুভাকাক্সক্ষী আছেন যারা দুর্বল হৃদয় অথবা সকল কাজে আপসপন্থী কিনা জানি না; তবে আওয়ামী লীগের সকল সাহসী কাজেই তারা রজ্জুতে সর্পভ্রম করেন। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া যখন অবৈধভাবে ক্যান্টনমেন্টের বাড়িতে বসবাস করে ক্যান্টনমেন্টকে দলীয় রাজনীতির আখড়া করে তোলার চেষ্টা করছিলেন এবং দীর্ঘকাল পর আদালতের নির্দেশে তাকে সেই বাড়ি থেকে উচ্ছেদের ব্যবস্থা নেয়া হয়, তখন অনেককেই গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলতে শুনেছি, শেখ হাসিনা কাজটা ভাল করেননি। তিনি সাপের লেজে পা দিয়েছেন। এই সাপ তাকে দংশন করবেই। সময়ই প্রমাণ করেছে, ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে খালেদা জিয়াকে অপসারণের ব্যাপারে আদালতের নির্দেশ কার্যকর করে হাসিনা সরকার কতোটা ভাল কাজ করেছেন। সামরিক বাহিনীকে রাজনীতিতে জড়ানোর এবং ক্যান্টনমেন্টকে দলীয় রাজনীতির আখড়া করে রাখার যে অপচেষ্টা বিএনপি দীর্ঘকাল ধরে চালিয়েছে, তা ব্যর্থ হয় এবং অশুভ শক্তির প্রভাব থেকে দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতি অনেকটা মুক্ত হয়। ড. ইউনূস যখন গ্রামীণ ব্যাংককে ব্যক্তিগত সম্পত্তির মতো ব্যবহার করে নিজেকে অসীম শক্তিধর করে তোলেন এবং তার আন্তর্জাতিক কানেকশনের সুযোগ নিয়ে নিজেকে দেশের আইন-কানুন-আদালতের উর্ধে অবস্থানকারী ব্যক্তি হিসেবে ভাবতে থাকেন তখন গ্রামীণ ব্যাংকের অব্যবস্থাপনার জন্য হাসিনা সরকার ব্যবস্থা গ্রহণে বাধ্য হন। তখনও আওয়ামী লীগের একশ্রেণীর শুভাকাক্সক্ষী রীতিমতো প্রমাদ গুণতে শুরু করেছিলেন। হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছিলেন ড. ইউনূস। কিন্তু দেশের একশ্রেণীর জ্ঞানীগুণী মানুষও শঙ্কা প্রকাশ করে বলতে শুরু করেছিলেন, ড. ইউনূসের মতো নোবেল জয়ী অসীম প্রভাবশালী ব্যক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমে শেখ হাসিনা মহা ভুল করেছেন। শেখ হাসিনা কোনো যুদ্ধে নামেননি। কিন্তু গ্রামীণ ব্যাংকে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে তার সরকারের গৃহীত ব্যবস্থায় অনড় রয়েছেন। কোনো হুমকির মুখেই পেছনে সরে আসেননি। নতজানু হননি। যারা তার দৃঢ়তায় আগে ভয় পেয়েছিলেন, এখন তারাই বলছেন, শেখ হাসিনা বাপের বেটি। তার সাহস ও দেশপ্রেমের জয় হয়েছে। প্রমাণিত হয়েছে ড. ইউনূস একজন পেপার-টাইগার। প্রমাণিত হয়েছে শেখ হাসিনা লৌহ মানবী নন, কিন্তু শক্ত মানবী। সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়াকে যেমন লী কুয়ান ও মাহাথির মোহাম্মদ লৌহমানবের ভূমিকা নিয়ে গড়ে তুলেছেন, শেখ হাসিনা সেই ভূমিকা নেননি। কিন্তু শক্ত মানবীর ভূমিকা নিয়েছেন। দুর্বল গণতন্ত্র কখনো কোনো দেশকে শক্তিশালী করতে পারে না। পারে সবল গণতন্ত্র এবং তার সবল নেতৃত্ব। হাসিনা বাংলাদেশে সেই সবল গণতন্ত্র ও নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। তার চেষ্টা সফল হলে শুধু অর্থনৈতিক উন্নতির ক্ষেত্রে নয়, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় একটি শক্তিশালী দেশ হিসেবে মাথা তুলবে। সমুদ্র বিজয় থেকে সাম্প্রতিক সীমান্ত বিজয় সর্বক্ষেত্রেই হাসিনা সরকারের সাহসী ও বাস্তব নীতির সাফল্য প্রমাণিত হয়েছে। তাই আওয়ামী লীগের শুভাকাক্সক্ষীদের বলি, আপনারাও সাহসী হন। রজ্জুতে সব সময় সর্পভ্রম করবেন না। হাসিনার সাহসী ভূমিকায় আস্থা রাখুন। লন্ডন, ১২ মে মঙ্গলবার ২০১৫
×