ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বদলায়নি পুলিশ ॥ সব দোষ সরকারের!

প্রকাশিত: ০৬:০১, ১২ মে ২০১৫

বদলায়নি পুলিশ ॥ সব দোষ সরকারের!

১০ মে ছিল মা-দিবস। সামাজিক গণমাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুক ভরে গিয়েছিল মায়ের ছবিতে এবং সেইসঙ্গে ছোট ছোট কথামালা। মাকে নিয়ে বিশেষ দিবস পালন করা সঠিক কিনা তা নিয়ে কোন বিতর্কে না গিয়ে বলতে পারি যে, মাকে কেন্দ্র করে মানুষের চিরন্তন এই অভিব্যক্তি মূল্যহীন হতে পারে না। কিন্তু দিনের অর্ধেক যেতে না যেতেই ফেসবুকে মায়ের ছবির জায়গায় যে ছবিটি জায়গা করে নিতে শুরু করল তা হলো, ঢাকায় ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিবাদসভায় পুলিশের হামলা এবং বিশেষ করে একটি মেয়েকে পুলিশের তাড়া করে পেটানোর ভিডিও দৃশ্য। ভেবেছিলাম ব্রিটেনের নির্বাচনে তিন বাঙালী নারীর যে অভূতপূর্ব বিজয় অর্জিত হয়েছে, তা নিয়ে একটি লেখা লিখব। কিন্তু নারীর কৃতিত্বের মহিমাকীর্তন করার আগে নারীর ওপর সহিংসতার প্রতিবাদ করা উচিত সবার আগে। পহেলা বৈশাখে নারী আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ডিএমপি কার্যালয় ঘেরাও করার চেষ্টা করেছিল ছাত্র ইউনিয়ন। পুলিশ কার্যালয় ঘেরাও করে দাবি আদায় হবে কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ‘মব কন্ট্রোলিং’-এর অভিজ্ঞতা ঐতিহাসিক। সেক্ষেত্রে ছাত্র ইউনিয়নের এই প্রতিবাদী কর্মসূচীকে সামাল দেয়ার মতো সামর্থ্য পুুলিশের ছিল না, সে কথা বিশ্বাস করতে চাই না। ধরে নিচ্ছি মিছিল থেকে উস্কানিও দেয়া হয়েছিল (যে ছবিটি দেখিয়ে সরকার-সমর্থকদের কেউ কেউ প্রমাণ করতে চাইছেন যে, আক্রান্ত মেয়েটিই আগে পুুলিশের এপিসিতে ইট ছুড়েছিল, তবে তা হাস্যকর), কিন্তু সে উস্কানির জবাবে পুলিশ যে আচরণ করেছে তার নিন্দা জানানোর ভাষা নেই। কারণ কোন প্রতিবাদীকেই শারীরিকভাবে আঘাত করার অধিকার পুলিশের নেই। কিন্তু বাংলাদেশে পুলিশ এই সত্য মানে না আমরা সেটা জানি। তাই বলে পুলিশের জন্য সরকারের সমস্ত ন্যায্য ও কষ্টকর অর্জন বিসর্জনে যাবে সেটা কখনই সঙ্গত হতে পারে না। আমরা বিএনপি-জামায়াতের আমলে পুলিশের লাঠির আঘাতে আওয়ামী লীগ নেত্রী মতিয়া চৌধুরীকে রাস্তায় শুয়ে পড়তে দেখে তার প্রতিবাদ করেছি। কোহিনূর মিয়া নামের সেই কুখ্যাত পুলিশ অফিসার এখন কোথায় আছেন জানি না। তবে যেখানেই থাকুন তিনি গণতান্ত্রিক ইতিহাসে কুখ্যাত পুলিশ হিসেবেই পরিচিত থাকবেন। যে দিন মা-দিবস নিয়ে সবাই আবেগাপ্লুত, ঠিক সেদিনই একজন নারীকে এভাবে পুলিশের হাতে আক্রান্ত হতে হলো এবং কেবলমাত্র এই একদিনেই বর্তমান সরকারের অনেক সমর্থকের ভেতর নতুন প্রশ্ন তৈরির সুযোগ করে দেয়া হলো; শত্রুর কথা না হয় বাদই দিলাম। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে এই ছবি ইতোমধ্যেই ভাইরাল হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। কোটি কোটি মানুষ এই ছবি শেয়ার করছে নিজেদের মধ্যে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও যে ঝড় তুলতে যাচ্ছে এই ছবি ও ভিডিওচিত্র তাতে কোনই সন্দেহ নেই। বর্তমান সরকার কতটা অগণতান্ত্রিক তা নিয়ে ইতোমধ্যেই বিশ্লেষণ শুরু হয়েছে এবং আমি নিশ্চিত, একটি নিরস্ত্র মেয়েকে ধাওয়া করে নিয়ে গিয়ে কোণঠাসা অবস্থায় চুলে ধরে তাকে মারধর করার দৃশ্য আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হবে ভবিষ্যতে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই বিতর্ক তো এড়ানো যেত এবং এখন তো মনে হচ্ছে যে, এটা হয়ত ইচ্ছাকৃতও। কারণ, পুলিশকে কি সরকার বা সরকারী দলের কেউ নির্দেশ দিয়েছেন কি না এরকম নোংরা আক্রমণ করার জন্য এই প্রশ্ন ইতোমধ্যেই উঠছে। সে প্রশ্ন অসঙ্গতও নয় অনেকেই ভাববেন যে, পুুলিশের এই সাহস হয় কি করে? হয়ত কালই পুুলিশের পক্ষ থেকে এই ঘটনাকে আরও উস্কে দেয়ার জন্য আত্মপক্ষ সমর্থনে বক্তব্য দেয়া হবে যে, মেয়েটি তাদের প্রথমে আক্রমণ করে, যেমনটি অনেক অতি-সরকার সমর্থক প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন। তাতে আমি মনে করি, ক্রোধের আগুনে ঘিই ঢালা হবে। অনেকে যেমন যে কোন ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গেই তার জন্য শেখ হাসিনাকে দায়ী করে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো তোলপাড় করে ফেলেন, তেমনই এ ঘটনাতেও সরাসরি দায় দেয়া হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। দেশের প্রধানমন্ত্রীর নিশ্চয়ই একটি সাধারণ পুলিশ সদস্যের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ থাকার কথা নয়। কিন্তু মানুষ বিষয়টি যৌক্তিক করার চেষ্টা করছেন। কারণ ঢাকা শহরের বেশিরভাগ পুলিশ সদস্য নাকি গোপালগঞ্জ থেকে আসা এবং তারা প্রধানমন্ত্রীর কথায় ওঠেন-বসেন। যুক্তি হিসেবে খুবই নড়বড়ে, কিন্তু শেষাবধি দায় প্রধানমন্ত্রীর ওপরই বর্তাবে, তা বলাই বাহুল্য। কারণ, আমরা বাংলাদেশের কথা বলছি, অন্য কোন দেশ নয়। বাংলাদেশের প্রবণতা হলো, যে কোন ঘটনা-দুর্ঘটনা শেষ পর্যন্ত টেনে নেয়া হবে সরকারের অদক্ষতা এবং তারও পরে নির্বাচন, গণতন্ত্র ইত্যাকার বড় বড় বিষয় পর্যন্ত। আর এই বিশ্লেষণ সবচেয়ে বেশি হয় আওয়ামী লীগ তথা শেখ হাসিনার সরকারকে কেন্দ্র করে। খালের ধারে গরু মরে পড়ে আছে কেন? দেশে গণতন্ত্র নেই। গণতন্ত্রের পক্ষে এরকম গরু-মরা বিশ্লেষণ দেয়ার মতো রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর অভাব নেই দেশে। ফলে পুলিশের আক্রমণের শিকার ছাত্র ইউনিয়নের এই কর্মীকে আক্রমণ করার দৃশ্য তো তাদের জন্য অনেক বড় অস্ত্র। এই অস্ত্রকে কিভাবে, কত প্রকারে ব্যবহার করা হবে, তার ছক ইতোমধ্যেই কষা হচ্ছে। কিন্তু এই ঘটনাকে পুলিশের অতি উৎসাহী ও ক্ষমতা প্রদর্শনে মারমুখী হয়ে ওঠার উদাহরণ ছাড়া আর কোনভাবে দেখা যায় কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে। এই ঘটনাকে আমরা কয়েকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি। এক. পুলিশের সংশ্লিষ্ট ওই সদস্য অতি উৎসাহী হয়ে মেয়েটিকে চুলে ধরে মারছে। তার মধ্যে এই সময় পুলিশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একজন পুরুষ হওয়ার আনন্দ কাজ করেছে। তার ক্ষমতা প্রদর্শনই তখন মূল নেশা ছিল, পুলিশ বা নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে তার কোন দায় তখন কাজ করেনি। দুই. রাজনৈতিকভাবে প্রতিপক্ষকে আঘাত করে সরকারের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছে পুলিশ। মনে করেছে, এর ফলে সরকার হয়ত তাকে পুরস্কৃত করবে, যা সাধারণত হয়ে থাকে। বিপক্ষ দলের কাউকে আঘাত করতে পারলে সরকারী দলের কাছ থেকে পুলিশের পুরস্কৃত হওয়াটা রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে আমাদের দেশে। তিন. পুলিশ এভাবেই দায়িত্ব পালন করে থাকে কেবল। যতটা কঠোর হওয়া যায় তার চেয়েও বেশি কঠোর না হলে আর পুলিশ কিসে, এই মানসিকতাও কাজ করে থাকতে পারে। এবং চার. ঘটনাটি আসলে আকস্মিক। মব কন্ট্রোলের জন্য নৈমিত্তিক পুলিশি প্রচেষ্টা হিসেবে আমরা দেখতে পারি, যেখানে মেয়েটির জায়গায় একটি ছেলে হলেও পুলিশ একই কাজ করত আর পুলিশের হাতের লাঠি তো আসলে জনগণকে পেটানোর জন্যই (আমরা যেন ভুলে না যাই যে, আমরা বাংলাদেশের পুলিশের কথা বলছি, যা আর দশটি তথাকথিত তৃতীয় বিশ্বের পুলিশের চেয়ে ভিন্ন কিছু নয়)। এখন ওপরের এই চারটি বিশ্লেষণ থেকে কে কোন্টি গ্রহণ করবেন বা এর কোনটিই গ্রহণ না করে এই ঘটনাকে সরকারের ‘স্বৈরাচারী আচরণ’ হিসেবে দেখবেন, সেটা যার যার ব্যক্তিগত অবস্থান এবং চিন্তা-চেতনার ব্যাপার। কিন্তু কোন অবস্থাতেই এই ঘটনাকে প্রশংসা করার উপায় নেই। একজন বিবেকবান মানুষের পক্ষে সেটা সম্ভব নয়। আমরা বাংলাদেশকে ঔপনিবেশিক শাসন আমলের পুলিশী-স্টেট ব্যবস্থা থেকে বের করে আনতে চাই এবং তার জন্য আমাদের ভরসা আওয়ামী লীগ তথা শেখ হাসিনার ওপরই। কারণ বাকিদের সে ক্ষমতা থাকলেও সদিচ্ছা নেই। তার প্রমাণ এর আগে বহুবার পাওয়া গেছে। কিন্তু এরকম দু’একটি ঘটনা ঘটার পর স্বাভাবিকভাবেই আওয়ামী লীগের ওপরও মানুষের আস্থা কমতে শুরু করবে, যা আখেরে কারও জন্যই মঙ্গলজনক হবে না। তাই আজকের এই ঘটনাকে কোন প্রকার আড়াল দেয়ার চেষ্টা না করে অতিসত্বর একটি তদন্ত সাপেক্ষে দোষী পুলিশ কর্মকর্তার বিচার নিশ্চিত করতে হবে। পহেলা বৈশাখে নারীর ওপর হামলার ঘটনার রেশ মিলিয়ে যেতে না যেতেই তার প্রতিবাদকারী নারীর ওপর হামলাকে কোন সুস্থ মানুষই সমর্থন করবে না, তা যতই তাতে যৌক্তিকতা দেয়ার চেষ্টা করা হোক না কেন। লোহা গরম থাকতে থাকতেই যেমন কামার তাতে হাতুড়ি মেরে কাক্সিক্ষত আকার দেয়ার কাজটি করেন, তেমনই ঘটনার বিশ্লেষণ-প্রতিবিশ্লেষণ শুরু হওয়ার আগেই এর সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষীদের বিচার করাটাই হবে শেখ হাসিনার সরকারের সঠিক পদক্ষেপ। এর বাইরে কোন কিছুই গ্রহণযোগ্য হবে না কোনভাবেই। আমরা আশা করব, সরকার সঠিক কাজটি সঠিক সময়ে করবে, সময়ক্ষেপণ এক্ষেত্রে মোটেও কাম্য নয়, যেটা আগেই বলেছি। যেটা অন্যায় ও অন্যায্য তা অন্যায় এবং অন্যায্যই। মতিয়া চৌধুরীকে কোহিনূর মিয়ার লাঠিপেটা যদি অন্যায় ও অন্যায্য হয়ে থাকে, তাহলে ছাত্র ইউনিয়নের এই মেয়েটির ওপরও পুলিশের এই হামলা অন্যায় ও অন্যায্য। দু’টোকে আলাদা করে দেখার কোন উপায় নেই, কারণও নেই। আশা করি, সরকারও আমাদের সঙ্গে এ ব্যাপারে একমত হবে। ১০ মে, ২০১৫ সধংঁফধ.নযধঃঃর@মসধরষ.পড়স
×