ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শঙ্খলতা পদ্ম সিঙ্গারা সুতোয় বোনা নতুন হাতের কারুকাজ

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ১২ মে ২০১৫

শঙ্খলতা পদ্ম সিঙ্গারা সুতোয় বোনা নতুন হাতের কারুকাজ

মোঃ খলিলুর রহমান ॥ নিপুন হাতের কারুকাজে শীতল পাখা বুনেন সুচিত্রা সূত্রধর। রঙিন ও সাদা-কালো সুতা দিয়ে নানান নামের বাহারী ধরনের হাতপাখা তৈরি করে সুনাম কুড়িয়েছেন তিনি। বেশ খ্যাতি তার। এখন তিনি শুধু পাখাই বুনছেন না, পাশাপাশি পাখা বুননের প্রশিক্ষণও দিচ্ছেন। ১৫-১৬ বছর বয়স থেকেই সুচিত্রা সূত্রধর সুতোয় বোনা পাখা তৈরি করে বিভিন্ন মেলায় ও অনুষ্ঠানে বিক্রি করছেন। এমনকি তার বোনা পাখা সরকারী অনুষ্ঠানে ব্যবহার করা হয়। আর বড় আকৃতির পাখা শোভা পায় বিভিন্ন সৌখিন পরিবারে। সুচিত্রার হাতে বোনা পাখা এখন ছড়িয়ে পড়েছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। পাখা গ্রীষ্মকালে অতিপরিচিত একটি নাম। গরমের হাত থেকে রক্ষা পেতে মানুষকে ব্যবহার করতে হয়। পাখার সাহায্যে বাতাস উপভোগ করা যায়। হাতপাখা বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে তৈরি করা হয়। ইদানিং বাঁশ, কাপড়, তালপাতা ও প্লাস্টিক দিয়ে পাখা তৈরি করা হচ্ছে। সুতো দিয়েও পাখা তৈরি করা যায়। তবে কাজটি খুবই নিঁখুত এবং কঠিন। সুই সুতা ব্যবহার করে এক ধরনের পাখা তৈরি করা হয়। এতে হাতের নানা কারুকাজ ভরপুর থাকে, থাকে সুতোর নক্সাও। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও উপজেলার উদ্ধবগঞ্জ ইউনিয়নের জিয়ানগরের মৃত নরেন্দ্র সূত্রধরের সহধর্মীনী সুচিত্রা সূত্রধর (৬০) পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে সুই সুতো দিয়ে নিপুন হাতে তৈরি করছেন এক ধরনের পাখা। পাখায় ব্যবহার করছেন নানাধরনের সুতো। তিনি সাধারণত লাল, হলুদ, বেগুনি, সবুজ, নীল, সাদাসহ নানা রঙের সুতো ব্যবহার করে আস্তে আস্তে তৈরি করছেন পাখা। যা হাত দিয়ে ঘুরালে বাতাস পাওয়া যায়। পাখা বুনা শেষ হলে বাঁশের ডাঁট, চুঙ্গী, ছাঁক লাগিয়ে পাখাকে ব্যবহারে উপযোগী করা হয়। তার বুনা পাখায় রয়েছে হরেক রকমের নাম। শঙ্খলতা, পদ্ম, চারফুল, মাছ, চাইতা ফুল, সিঙ্গারা, বহুফুল, করলাসহ নানা বাহারি নাম। এর মধ্যে পদ্ম, সিঙ্গারা ও শঙ্খলতা পাখাটি বেশি চলে। সুতোয় বুনা পাখা ছোট ও বড় আকৃতির হয়। ছোট আকৃতির একটি পাখা ৫০Ñ৩০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা হয়। বড় আকৃতির একটি পাখা ১৫০০Ñ৩০০০ টাকায় বিক্রি করা হয়। বড় আকৃতির পাখা সাধারণত ঘর সাজানোর কাজে ব্যবহার করা হয়। এ পাখা শোভা পায় সৌখিন পরিবারে। এছাড়াও বিভিন্ন মন্দিরে ও দুর্গাপুজোয় বড় আকৃতির পাখা ব্যবসা হয়ে থাকে। সুচিত্রা সূত্রধর জানায়, তার মা কাদু মতির কাছে এ পাখা বুনার কাজ শিখেছেন। তখন একটি পাখা চার আনা-পাঁচ আনায় বিক্রি হতো। তিনি জানান, একদিনে ২-৩টি পাখার বেশি বুনা যায় না। তাই তিনি এখন পাখা বুনার প্রশিক্ষণ দেন। কিছুদিন আগে ১০ প্রশিক্ষণার্থীকে তিন মাস পাখা বুনার প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। এতে তার ভাল উপার্জন হয়েছে। তার হাতে বুনা পাখা বিভিন্ন সরকারী অনুষ্ঠানে এবং জাদুঘরে গিয়েও বিক্রি করেছেন। সরকারী তরফ থেকেও তার পাখার কদর রয়েছে। কোন জায়গায় ঐতিহ্য হিসেবেও এ পাখা প্রদর্শন করা হয়। সুচিত্রা সূত্রধরের স্বামী নরেন্দ্র সূত্রধর মারা যাওয়ার পর থেকে সোনারগাঁয়ের কারুশিল্প ফাউন্ডেশনে একটি কারুকাজের দোকান দিয়েছেন। প্রতিমাসে কারুশিল্প ফাউন্ডেশনকে ভাড়া দিতে হয় ১২০০ টাকা। প্রতিদিন ভালই বেচা-বিক্রি হয়। তার বুনানো পাখা সব ঋতুতেই বিক্রি হয়। তিনি আরও জানান, তার মেয়ে, ছেলের বউ, নাতি, পুতিরা লেখাপড়া ও কাজের ফাঁকে ফাঁকে এ হাত পাখা বুনে তাকে সাহায্য করে। তারা ১৪Ñ১৫ জন মিলে এ পাখাগুলো তৈরি করছেন। পাখা তৈরি হলে বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকাররাও তার কাছ থেকে পাখা কিনে নিয়ে বেশি দামে বিক্রি করছে। পুরো পরিবারই এখন পাখা বুনার পরিবার হিসেবে সবার কাছে পরিচিত। তিনি আরও জানান, যত রঙিন সুতো ব্যবহার করা যায়, ততই আরও সৌন্দর্য ফুটে ওঠে। এতে ক্রেতার আকর্ষণও বেড়ে যায়। সুচিত্রা সূত্রধরের ৪ ছেলে, ৩ মেয়ে। সবাই বিয়ে করেছে। এক ছেলে বিদেশে থাকে। বড় ছেলে আশুতোষ সূত্রধর মার সঙ্গেই দোকানে নক্শি করা কাঠের হাতি, ঘোড়া, বাঘসহ বিভিন্ন আইটেমের কারুকাজ বিক্রি করে। তার ছেলে কাঠ দিয়ে এ ধরনের কারুকাজ তৈরিও করতে পারে। অন্য ছেলেরা বিভিন্ন পেশায় জড়িত। সুচিত্রা সূত্রধর সারাজীবন পাখা বুনার পেশায় ডুবে থাকতে চান।
×