ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

তবু ইতিহাসের সেরা সাফল্য বাংলাদেশের

প্রকাশিত: ০৬:১৯, ১১ মে ২০১৫

তবু ইতিহাসের সেরা সাফল্য বাংলাদেশের

মিথুন আশরাফ ॥ সেই ১৯৮৬ সাল থেকে ওয়ানডে খেলে বাংলাদেশ। এ ফরমেটে ২৯ বছর ধরে খেলছে। আর টেস্টে ২০০০ সাল থেকে ১৫ বছর ধরে খেলছে। ২০০৬ সাল থেকে টি২০তেও বাংলাদেশ বিচরণ করছে। ওয়ানডে সিরিজও জিতেছে, টেস্ট সিরিজও জিতেছে; টি২০ সিরিজও জিতেছে। কিন্তু এবার পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ হেরেও যে সাফল্য পেয়েছে বাংলাদেশ, তা ইতিহাসের সেরা সাফল্য হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে। এমন শক্তিশালী দলের বিপক্ষে যে কখনই বাংলাদেশ এমন দাপট দেখিয়ে খেলতে পারেনি। এ পর্যন্ত ৫৮টি দ্বিপক্ষীয় ওয়ানডে সিরিজ খেলেছে বাংলাদেশ। জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে যখন ২০০৫ সালে বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রথম ওয়ানডে সিরিজ জয় হলো, সে কী আনন্দ। প্রথম জয় সবসময়ই আনন্দ দেয়। এরপর আরও ১৬টি সিরিজ জেতা হয়েছে বাংলাদেশের। এর মধ্যে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, নিউজিল্যান্ডের মতো দলকেও হোয়াইটওয়াশ করেছে বাংলাদেশ। উৎসবও হয়েছে। কিন্তু কোন সিরিজই ১৭তম সিরিজ (পাকিস্তানের বিপক্ষে এবার) জয়ের আনন্দের মতো আনন্দ দিতে পারেনি। টি২০ সিরিজ খেলেছে বাংলাদেশ ১৭টি। চারটিতে জিতেছে। এর মধ্যে চতুর্থ সিরিজ জয়ের (পাকিস্তানের বিপক্ষে) আনন্দই মিলেছে অন্যরকম। ৪৪টি টেস্ট সিরিজ খেলেছে বাংলাদেশ। জিতেছে ৩টিতে। পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজ হেরেছে। তবে প্রথম টেস্টে যে ড্র করেছে বাংলাদেশ, সেটির আনন্দই সবাইকে এখনও ছুঁয়ে যাচ্ছে। তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে পাকিস্তানকে ‘বাংলাওয়াশ’ করেছে টাইগাররা। প্রথম ওয়ানডেতে ৭৯ রানে হারিয়েছে। এ ম্যাচ জয়ে ১৯৯৯ সালের পর ১৬ বছর পাকিস্তানের বিপক্ষে না জেতার আক্ষেপ ঘুচেছে। সেই অধরা জয়টি মিলে গেছে। দ্বিতীয় ওয়ানডেতে ৭ উইকেটে যখন জিতল বাংলাদেশ, প্রথমবারের মতো ওয়ানডে সিরিজই জিতে নিল। তৃতীয় ওয়ানডেতে ৮ উইকেটে জিতে পাকিস্তানকে তো হোয়াইটওয়াশই করল বাংলাদেশ। পাত্তাই পায়নি পাকিস্তান। হেসেখেলে পাকিস্তানকে হারিয়েছে বাংলাদেশ। এরপর যখন একমাত্র টি২০ ম্যাচটি হয়েছে, সেখানেও দাপট দেখিয়েই জয় তুলে নিয়েছে বাংলাদেশ। প্রথমবারের মতো পাকিস্তানকে টি২০তে হারিয়েছে। তাও ৭ উইকেটের বড় জয়ই তুলে নিয়েছে মাশরাফি বিন মর্তুজার দল। নির্ধারিত ওভারের খেলা শেষ হয়ে গেল। এবার পাঁচ দিনের টেস্ট ক্রিকেট খেলতে নামার পালা। খুলনায় হলো প্রথম টেস্ট। ম্যাচটিতে পাকিস্তানের জেতার সম্ভাবনাই ধরা হলো। একটা সময় পাকিস্তান জেতার সম্ভাবনাও তৈরি করল। কিন্তু আত্মবিশ্বাসী বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটাররা কী খেলাই না দেখালেন! তামিম-ইমরুল মিলে প্রথম উইকেটে দ্বিতীয় ইনিংসে ৩১২ রানের জুটির বিশ্বরেকর্ড গড়লেন। এ জুটিতেই পাকিস্তানের সব আশা হতাশায় পরিণত হলো। টেস্ট জেতার স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। চতুর্থ আর পঞ্চম দিন তো পাকিস্তানকে খুঁজেই পাওয়া গেল না। তামিম ইকবাল বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সর্বোচ্চ ২০৬ রানের ইনিংস খেললেন। ইমরুল কায়েস করলেন ক্যারিয়ার সেরা ১৫০ রান। এ দুইজনের সঙ্গে সাকিব আল হাসান অপরাজিত ৭৬ রান করলেন। তাতে ম্যাচটি ড্র হয়ে গেল। প্রথমবারের মতো টেস্টে পাকিস্তানের বিপক্ষে হারল না বাংলাদেশ। এত দুর্দান্ত খেলে ড্র মিলল, যে ড্রতে জয়ের আনন্দ পাওয়া গেল। সিরিজজুড়ে শুধু বাংলাদেশ ক্রিকেটারদের জয়গান গাওয়া হলো। পাকিস্তান ক্রিকেটারদের কোনভাবেই খুঁজে পাওয়া গেল না। বাংলাদেশ এর মধ্যে ইতিহাসের সেরা সাফল্যই কুড়িয়ে নিল। ওয়ানডে সিরিজে পাকিস্তানকে ‘বাংলাওয়াশ’ করে টি২০তেও জিতল। আবার প্রথম টেস্টও ড্র করে নিল। বারবার যে পাকিস্তান নাস্তানাবুদ করত বাংলাদেশকে, এবার উল্টো চিত্রই মিলে গেল। এবার দ্বিতীয় টেস্টে নামার পালা। মিরপুরে হবে সেই টেস্ট। এ টেস্টে এসে প্রথমবারের মতো পাকিস্তান জয়ের গন্ধ পেল। সিরিজজুড়ে হারতে থাকা একটি দল খালি হাতে দেশে ফিরবে? এমন যখন ভাবনা হলো, তখন পাকিস্তান যেন জেগে উঠল। ওয়ানডের পর টি২০তে জিতে প্রথম টেস্ট ড্র করার পর বাংলাদেশকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখা হয়েছে। সেই স্বপ্ন ছিল একটি টেস্ট জেতারও। দ্বিতীয় টেস্টেই সেই সুযোগ দেখা হয়েছে। কিন্তু এবার আর বাংলাদেশ কুলিয়ে উঠতে পারল না। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া একটি দল দেখাল চূড়ান্ত লড়াই। যে লড়াইয়ের সামনে এবার আর বাংলাদেশ পারল না। তাতে দ্বিতীয় টেস্টে হারও হলো অনেক বড় ব্যবধানেই। ৩২৮ রানে হারল বাংলাদেশ। বাংলাদেশের একজন ব্যাটসম্যানও এবার ওয়াহাব রিয়াজ, ইয়াসির শাহদের সামনে প্রাচীর হয়ে দাঁড়াতে পারল না। একটি শতকও মিলল না। প্রথম ইনিংসে সাকিবের কাছ থেকে সর্বোচ্চ স্কোরটি মিলল। অপরাজিত ৮৯ রান করলেন সাকিব। সেই তুলনায় প্রথম ইনিংসে ম্যাচ ও সিরিজ সেরা আজহার আলীর ২২৬, ইউনুস খানের ১৪৮ ও আসাদ শফিকের ১০৭ রানে ৫৫৭ রান করেই মূলত ম্যাচ বের করে নিয়েছিল পাকিস্তান। বাংলাদেশ প্রথম ইনিংসে ফলোঅনে পড়ল, ইনিংস হারের সম্ভাবনাও থাকল। কিন্তু পাকিস্তান আবার ব্যাট করায় ইনিংস হার হলো না। তবে খেলা শেষ হতে চার দিনও লাগল না। দ্বিতীয় টেস্টে বাংলাদেশের ‘যাচ্ছে-তাই’ অবস্থা হলো। এরপরও পাকিস্তানের বিপক্ষে যা খেলল বাংলাদেশ, যেভাবে দাপট দেখিয়ে একের পর এক ম্যাচ জিতে নিল, শেষটা যতই রঙহীন থাকুক; তবুও ইতিহাসের সেরা সাফল্যই মিলেছে। বাংলাদেশ অধিনায়ক মুশফিকুর রহীমই তা বুঝিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন, ‘শেষটা সবাই মনে রাখে। তবে আমরা যে এতদূর পর্যন্ত এসেছি, সেটাও কম অর্জন নয়। আসলে অন্য কোন সময় যদি কোন টেস্টে এভাবে হারতাম, তাহলে এত কথা হতো না। তখন হয়ত মনে করা হতো পাকিস্তানের সঙ্গে আমরা এভাবেই হারব। এবার আমরা ভাল খেলাতেই এত কথা। ভাল খেলার কৃতিত্ব পুরো দলকে এবং টিম ম্যানেজমেন্টকে দিতে হবে। বাংলাদেশ দল সাত মাস ধরেই ভাল ক্রিকেট খেলছে।’ ঠিক বলেছেন মুশফিক। সেই গত বছরের শেষে জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে সিরিজ থেকেই শুরু হয়েছে জয়যাত্রা। দেশের মাটিতে টানা ১২টি জয় পেয়েছে বাংলাদেশ! জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে ৫টি ওয়ানডে, তিনটি টেস্ট, পাকিস্তানের বিপক্ষে তিনটি ওয়ানডে, ১টি টি২০ জয় হয়েছে। এর সঙ্গে বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠার গৌরব তো আছেই। শুধু শনিবার শেষ হওয়া পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজের শেষ ম্যাচটিতে এসে হার হয়েছে বাংলাদেশের। এ ম্যাচটি ছাড়া সিরিজে তো বাংলাদেশই শুধু দাপট দেখিয়েছে, প্রথমবারের মতো সিরিজে পাকিস্তানের ওপর কর্তৃত্ব করেছে। এমন কর্তৃত্ব র‌্যাংকিংয়ের উপরে থাকা কোন শক্তিশালী দলের বিপক্ষে কখনই দেখাতে পারেনি বাংলাদেশ। তাই শেষটা যতই খারাপ হোক, তবুও ইতিহাসের সেরা সাফল্যই মিলে গেছে।
×