ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আলোচনায় বসছে আইডিআরএ

আর্থিক সঙ্কটে নতুন বীমা কোম্পানি

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ১১ মে ২০১৫

আর্থিক সঙ্কটে নতুন  বীমা কোম্পানি

রহিম শেখ ॥ অভিজ্ঞতা অর্জন করার আগেই বড় ধরনের আর্থিক সঙ্কটে পড়েছে নতুন বীমা কোম্পানিগুলো। তীব্র প্রতিযোগিতা, আয় কম এবং ব্যয় বেশি, যোগ্য ও দক্ষ লোকের অভাবে বেশিরভাগ নতুন বীমা কোম্পানি দুরবস্থায় পড়েছে। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে লাভজনক হওয়া তো দূরের কথা, টিকে থাকাই তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে। এদিকে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) বলছে, যেসব কোম্পানি অস্বাভাবিক ব্যয় করেছে তাদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেয়া হবে। চলতি মাসেই নতুন বীমা কোম্পানিগুলোর পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে আলোচনায় বসেছে আইডিআরএ। জানা গেছে, নতুন ব্যবসা শুরু করা ১৩টি জীবন বীমা কোম্পানির মধ্যে একটি কোম্পানি আইনীসীমার মধ্যে ব্যয় করেছে। ১১টি প্রতিষ্ঠান আইনীসীমা লঙ্ঘন করে ২৮ কোটি ৬০ লাখ টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করেছে। আইন অনুযায়ী অতিরিক্ত ব্যয় করা টাকার ৯০ শতাংশই গ্রাহকরা প্রাপ্য। বাকি একটি কোম্পানির তথ্য পাওয়া যায়নি। কোম্পানিগুলোর ২০১৪ সাল শেষে তৈরি করা আর্থিক প্রতিবেদন থেকে এ অস্বাভাবিক ব্যয়ের চিত্র পাওয়া গেছে। সম্প্রতি বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) কাছে এ প্রতিবেদন জমা দিয়েছে কোম্পানিগুলো। এ প্রসঙ্গে আইডিআরএ’র চেয়ারম্যান এম শেফাক আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, নতুন ব্যবসা শুরু করা কোম্পানিগুলো যে আয় করেছে কিছুতেই তার অতিরিক্ত ব্যয় করতে পারে না। যেসব কোম্পানি অস্বাভাবিক ব্যয় করেছে তাদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেয়া হবে। জানা গেছে, আর্থিকভাবে লাভজনক হতে হলে বছরে অন্তত ১০ কোটি টাকার প্রিমিয়াম আয় করতে হয় বীমা কোম্পানিগুলোর। কিন্তু নতুন বীমা কোম্পানিগুলো গত বছর গড়ে ৩ থেকে ৬ কোটি টাকা আয় করেছে। আয়ের তুলনায় তাদের ব্যয় হয়েছে বেশি। সূত্র বলছে, নতুন বীমা কোম্পানিগুলোর কোন কোনটি ২০০ শতাংশ ব্যবস্থাপনা ব্যয় দেখিয়েছে। এ কারণে ঝুঁকিও বেড়ে গেছে বহুলাংশে। বীমা বিশেষজ্ঞদের মতে, আর্থিক বিচার বিশ্লেষণ না করে একসঙ্গে এত বেশি নতুন কোম্পানির অনুমোদন দেয়ায় ঝুঁকি আরও বেড়েছে এ খাতে। বীমার বড় পদগুলোতে যোগ্য ও দক্ষ লোকের অভাব রয়েছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। এই সঙ্কটে বীমা খাতই সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। এদিকে নিয়ম না মেনে ব্যবসা করার অভিযোগ উঠেছে নতুন কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে। বীমা সংগ্রহের জন্য কমিশন দেয়াসহ আনুষঙ্গিক খাতে বেশি খরচ করছে তারা। এ জন্য সম্প্রতি তাদের প্রত্যেককে ‘সতর্ক’ করে আলাদা চিঠি দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ। আইডিআরএ’র সদস্য কুদ্দুস খান জনকণ্ঠকে বলেন, নতুন বীমা কোম্পানিগুলোর কোন কোনটি ২০০ শতাংশ ব্যবস্থাপনা ব্যয় দেখিয়েছে, যা কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না। ব্যবস্থাপনা ব্যয় নিয়ন্ত্রণে আনতেই চলতি মাসের মাঝামাঝিতে বীমা খাতের নতুন কোম্পানিগুলোর পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে আলোচনায় বসব আমরা। বেসরকারী কর্ণফুলী ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম হাফিজ উল্ল্যাহ বলেন, নতুন কোম্পানিগুলোর অবস্থা খুবই করুণ। আর্থিক ভিত নড়বড়ে। এগুলোর টিকে থাকা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। জানা গেছে, আলফা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স নিবন্ধন সনদ পাওয়ার পর ব্যবসার অনুমোদন পায় গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে। ব্যবসা শুরু করে এরও চার মাস পর (জুনে)। ব্যবসার শুরুতে ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নিয়োগ দেয়া হলেও মাত্র তিন মাসের মাথায় চাকরি ছেড়ে দেন তিনি। এরপর থেকেই কোম্পানিতে এমডি পদ শূন্য রয়েছে। এ অবস্থা চলছে গত চার মাস ধরে। কোম্পানিটির মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এমডি না থাকায় ব্যবসায়িক বিষয়ে কোম্পানি সঠিক নেতৃত্ব পাচ্ছে না। ফলে প্রিমিয়াম আয়ও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এরই মধ্যে কোম্পানিটি ১০০ টাকা প্রিমিয়াম আয় করতে ১৫০ টাকারও বেশি ব্যয় করেছে, যার মধ্যে কোম্পানির ফিন্যান্সিয়াল এ্যাসোসিয়েট থেকে ডিভিশনাল কো-অর্ডিনেটর পর্যন্ত সবার কমিশন হিসেবে ৭০ টাকা ১০ পয়সা হারে ব্যয় হচ্ছে। অথচ বীমা নিয়ন্ত্রক সংস্থার নির্ধারিত কমিশন শিডিউল অনুযায়ী এ কমিশন হওয়ার কথা সর্বোচ্চ ৪৯ টাকা। এ ১০০ টাকা প্রিমিয়াম আয় করতে কোম্পানির উন্নয়ন বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট পদের কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা বাবদ গড়ে ব্যয় হচ্ছে ২০ টাকা। সংগঠন প্রধানদের বেতন-ভাতা বাবদ ব্যয় হচ্ছে ১৫ থেকে ২০ টাকা। অর্থাৎ এসব পদের কর্মকর্তার কমিশন-বেতন-ভাতা বাবদ কোম্পানিটি প্রিমিয়াম আয়ের ১০০ থেকে ১১০ শতাংশ পর্যন্ত অর্থ ব্যয় করছে। এছাড়া মাঠ সংশ্লিষ্ট অফিস ভাড়া, ডেক্স কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা, পরিবহন ব্যয়, উন্নয়ন সভা, কর্মকর্তাদের ট্যুর বাবদ ব্যয় করছে আরও ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ অর্থ। আরেক নতুন জীবন বীমা কোম্পানি প্রটেকটিভ লাইফ ২০১৩ সালে প্রথম হিসাব বছরে প্রিমিয়াম আয় দেখিয়েছে ২ কোটি ২৬ লাখ টাকা। অথচ নবায়ন প্রিমিয়াম আয় হয়েছে মাত্র ৫ লাখ টাকা। বাকি ২ কোটি ২১ লাখ টাকার প্রিমিয়াম না আসায় এর অধিকাংশই ভুয়া বলে মনে করছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিতেই এ ভুয়া পলিসি দেখানো হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ প্রিমিয়াম আয় করতে গিয়ে কোম্পানিটি কমিশন বাবদ ব্যয় করেছে ৮৩ লাখ টাকা। অন্যদিকে গাড়ি ক্রয়ে ব্যয় করেছে ২ কোটি ৬০ লাখ টাকা। এর মধ্যে কোম্পানির চেয়ারম্যানের জন্য ৭০ লাখ টাকায় কেনা হয়েছে বিএমডাব্লিউ গাড়ি, এমডির জন্য ৪০ লাখ টাকা ব্যয়ে নিশান পেট্রল, ডিএমডি ও এএমডিদের জন্য ২৯ লাখ টাকা দামের গাড়ি। কোম্পানিটির গাড়ি রয়েছে ১২টি। অফিস ভাড়া বাবদ কোম্পানিটি মাসে দিচ্ছে ৬ লাখ টাকা। এছাড়া অফিস ডেকোরেশনে ব্যয় করেছে ২৯ লাখ টাকা। বিজ্ঞাপন বাবদ ব্যয় করেছে ৪৮ লাখ টাকা। এসব খরচ মেটাতে একটি অর্থলগ্নিকারী কোম্পানি থেকে এরই মধ্যে সাড়ে ৪ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে প্রটেকটিভ লাইফ। এদিকে ট্রাস্ট লাইফের কোন ব্যবসাই নেই। অথচ প্রতি মাসে অফিস ভাড়া দিচ্ছে ৪ লাখ টাকা। কোম্পানির গাড়ি কেনা হয়েছে নয়টি। এর মধ্যে চেয়ারম্যানের জন্য গাড়ি কেনা হয়েছে ৪০ লাখ টাকায়। এমডি ও ডিএমডিদের জন্য প্রতিটি গাড়ি কেনা হয়েছে ২৩ লাখ টাকায়। ব্যবসা করতে না পারলেও বেতন-ভাতা, অফিস ভাড়া দিয়েই প্রারম্ভিক মূলধন ৪ কোটি টাকা শেষ করে ফেলেছে কোম্পানিটি। বেস্ট লাইফ ২০১৩ সালে প্রিমিয়াম আয় করেছে ৩ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। যার মধ্যে নবায়ন প্রিমিয়াম আয় মাত্র ১০ লাখ টাকা। কোম্পানিটি গাড়ি কিনেছে ২৫টি। এছাড়া প্রতি মাসে অফিস ভাড়া বাবদ ব্যয় করছে সাড়ে ৭ লাখ টাকা। তথ্য মতে, সব থেকে খারাপ অবস্থানে রয়েছে স্বদেশ লাইফ। প্রতিষ্ঠানটি ২০১৪ সালে আয় করেছে ৯২ লাখ টাকা। এর বিপরীতে ব্যবস্থাপনা ব্যয় করেছে ২ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ এক শ’ টাকা আয় করতে প্রতিষ্ঠানটি ব্যয় করছে ৩১৩ টাকা। অতিরিক্ত খরচের দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে আলফা লাইফ। প্রতিষ্ঠানটি আয় করেছে ১ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। এ আয়ের জন্য ব্যয় করেছে ৫ কোটি ২৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ ১শ’ টাকা আয়ের জন্য প্রতিষ্ঠানটির ব্যয় ২৭৯ টাকার উপরে। ১শ’ টাকা আয়ের জন্য ২শ’ টাকার উপরে খরচ করেছে এমন কোম্পানির তালিকায় রয়েছে চার্টার্ড লাইফও। প্রতিষ্ঠানটি ২ কোটি ৭৬ লাখ টাকা আয়ের বিপরীতে ব্যয় করেছে ৬ কোটি ৫৯ লাখ টাকা।
×