ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সিডনির মেলব্যাগ ॥ অজয় দাশগুপ্ত

রবীন্দ্রজয়ন্তী, বর্ধিত স্বদেশ, প্রগতির জয়

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ১১ মে ২০১৫

রবীন্দ্রজয়ন্তী, বর্ধিত  স্বদেশ, প্রগতির জয়

বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথের চর্চা বা ব্যাপ্তি পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে কম কিছু নয়। আবেগে ভালবাসায় দ্রোহে সম্মানে তিনি আমাদের একান্ত আপনজন। বাংলাদেশে এমন কোন গৃহকোণ নেই যেখানে রবীন্দ্রনাথ বেজে ওঠেন না। সকাল থেকে ঘুমোতে যাওয়া পর্যন্ত কতভাবে কত অনুষঙ্গে যে তাঁর কাছে হাত পাততে হয়। কী আশ্চর্য! তাঁর ঘোর বিরোধীরাও তাঁর গান না শুনে ঘুমাতে পারেন না। কাদের মোল্লার ফাঁসির পর কোন একটি লেখায় পড়েছিলাম, তিনিও নাকি রবীন্দ্রনাথের গান গাইতেন, এমন কি কারাগারেও গেয়েছিলেন। অথচ এঁরাই বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথ বিরোধিতার নামে সাম্প্রদায়িকতা ছড়াতেন। এখনও সে প্রবাহ সচল। রবীন্দ্রনাথ আমাদের দেশের জাতীয় সঙ্গীত রচয়িতা তাঁর গান, কবিতা, নাটক বা গদ্যে আমাদের জাতীয়তা জীবন প্রেম ভালবাসা ভিত্তি লাভের পরও ধর্মীয় গোঁড়ামির আড়ালে এক ধরনের বিপন্নতা চলে আসছে। অথচ তাঁর জীবন পর্যালোচনায় অভিযোগগুলো খারিজ হওয়া নিছক সময়ের ব্যাপার। ঠাকুরবাড়ীর চিরাচরিত প্রথা পুরুষরা কখনও জুতো মোজা ছাড়া বেরুতেন না। খালি পা দেখানোর রেওয়াজ ছিল রীতিমতো গর্হিত অপরাধ। বঙ্গভঙ্গের সময় রবীন্দ্রনাথ সে রীতি ভেঙ্গে বাঙালীর জন্য খালি পায়ে রাস্তায় নেমেছিলেন। দুর্ভাগ্য, ইতিহাসবিমুখ সাম্প্রদায়িকরা না জেনে তাঁকে বঙ্গভঙ্গের জন্য ক্রমাগত দোষারূপ করে চলেছেন। সেকালে কেউ বাংলায় বক্তৃতা দিত না ইংরেজ শাসন আর ইংরেজীর প্রভাবে বক্তৃতা মানেই গট গট করে সাহেবী কায়দায় কথা বলার চল। রবিঠাকুর এর বিরোধিতা করে বলেছিলেন, কেন বাংলায় ভাষণ দেয়া যাবে না? সাধারণ প্রজা ও সাধারণ মানুষের সভায় তাঁর সুললিত ভাষার বক্তৃতাকে ব্যঙ্গ করে তখনকার নাক উঁচু ধুতি চাদরের বাবু সমাজ বলত: “ওহে রবি বাবু, ইংরেজী না বোঝা আম-পাবলিক আপনার খেয়েছো নেয়েছো’ বুঝেছে তো”? অদম্য রবীন্দ্রনাথ তারপরও বাংলায় বক্তৃতা দিতেন। অসাম্প্রদায়িকতার ঝোঁক না থাকলে বা সবার জন্য মায়া না থাকলে তাঁর কবিতা গানে এমন সার্বজনীন ভালবাসা থাকত না। রাখি বন্ধনের একদিনে তিনি পদযাত্রা করে কলকাতার নাখোদা মসজিদে গিয়েছিলেন ইমামকে রাখি পরিয়ে দিতে। চারদিকে টান টান উত্তেজনা সবাই ভয়ে অস্থির। যদি তাঁকে অপমান করা হয় বা যদি ধর্মান্ধবা ক্ষেপে যায়? না, কিছুই হয়নি, মসজিদের ইমাম এসে হাত বাড়িয়ে রাখি পরে প্রমাণ করেছিলেন ধর্মে ধর্মে তফাৎ বা বিভেদ কেবল সাম্প্রদায়িকদের সমস্যা। ধার্মিকের বলা উচিত প্রকৃত ধর্মপালনকারীর তাতে কোন অসুবিধে হয় না। মহামানবের মিলন তীর্থের পরম পথিক এই কবিকে আপন করে নিলে যত লাভ তা আর অন্য কিছুতে দেখি না। বাংলাদেশে এখন শান্ত স্থির ও প্রকৃত রবীন্দ্রচর্চা প্রয়োজন। রাজনীতিনির্ভর দেশে উগ্রজাতীয়তাবাদ আর সাম্প্রদায়িকতা ঠেকাতেও আমরা তাঁর সাহায্য নিতে পারি। বদলে যাওয়া মিডিয়ার নামে নব্য রাজাকারদের দেখুন। রবীন্দ্রনাথকে অকথ্য গালি-গালাজ করলেই পুরস্কার দেয় তারা। মোনায়েম খাঁ বেঁচে না থাকলেও তার প্রেতাত্মারা মরে যায়নি। একদা বামের ছদ্মবেশে থাকা এরাই রবীন্দ্রনাথ ও বাঙালীর প্রধান দুশমন। আওয়ামী বিরোধিতার নামে এ দেশের আত্মা ও হৃদয় খুবলে নিতে চায় এরা। অথচ এরা জানে না রবীন্দ্রনাথ আমাদের কত বড় ভরসা। তিনিই আমাদের শিখিয়েছেন, ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য উচ্চ সেথা শির’। বসুধাকে বড় করার বড় খবরটিও পেলাম রবীন্দ্রজন্মদিনে। স্থল সীমান্ত চুক্তি হওয়ার পর আয়তন বাড়ল আমাদের। সে কবে থেকে চেষ্টা আর দূতিয়ালি। কিন্তু বরফ গলছিল না। মোদি ও শেখ হাসিনার সরকার সে বরফ গলিয়ে দেখিয়ে দিল, বন্ধুত্ব আর সম্পর্ক কত ধরনের ও সাহায্যপূর্ণ হতে পারে। বেগম জিয়া ও তাঁর পেট্রোলবোমার দল মুখে ভারত বিদ্বেষী হলেও কার্যত ছিল তাদের সেবাদাস। যে কারণে খালেদা জিয়ার আমলে দেশে বেড়াতে গেলে মনে হতো দিল্লী শাসিত কোন মুসলমান প্রধান রাজ্যে এসেছি। স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের গালগল্প আর সামরিক হুংকারে আজকাল কাজ হয় না। গণতন্ত্রে প্রয়োজন সমঝোতা আর বন্ধুত্ব। দেশের মানুষের সঙ্গে যাদের বন্ধুত্ব নেই তারা অন্যের নজর কাড়বেন কিভাবে? এখন তারা কি বলবেন? এটা তো চাক্ষুস আর দলিলবন্দী গুজব ধমক আর ষড়যন্ত্রে সামান্য কিছু লেজুড়বৃত্তির মানুষের মন জয় করা যায় বটে আখেরে চিড়ে ভেজে না। বেগম জিয়া ও বিএনপির রাজনীতির কফিনে আরও একটি পেরেক ঠুকলেন শেখ হাসিনা। আমাদের দেশের সমস্যাগুলো ক্রমেই তিনি সমাধান করে দিচ্ছেন। যেগুলো হওয়ার নয় সেগুলোর ব্যাপারে কঠিন হওয়ার বিকল্প নেই। তিনি ও তাঁর দলের কাছে রবীন্দ্রনাথ যেমন নিরাপদ তেমনি নিরাপদ বাংলাদেশ। ক’দিন আগে অতিক্রান্ত রবীন্দ্রজয়ন্তীতে আমরা আবারও দেখলাম বাংলাদেশ গা ঝাড়া দিয়ে উঠছে। এই দেশ ও দেশের মানুষ সঙ্গে থাকলে তিনি ও প্রগতিশীলরা বাংলাদেশকে একটি স্তরে পৌঁছে দেবেন, এটা নিশ্চিত। এখন জনগণের ইচ্ছে তাঁরা কি চায়? যে বাংলাদেশ প্রগতি ও সম্ভাবনার সেটা চাইলে পেট্রোলবোমার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর বিকল্প নেই।
×