ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী ভারতের পুরনো চাল আমদানি করছে ;###;দেশের চালকল মালিকরা এ কাজে নেমেছে

ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে ব্যবস্থা গ্রহণ ॥ আমদানি শুল্ক চালে

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ১১ মে ২০১৫

ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে ব্যবস্থা গ্রহণ ॥ আমদানি শুল্ক চালে

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ বিদেশ থেকে চাল আমদানি নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে সরকার চাল আমদানির ওপর ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে। ধান উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত কৃষকদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সুপারিশের প্রেক্ষিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) রবিবার এ শুল্ক আরোপ করে। এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জানিয়েছেন, ‘চালের দাম কমে গেছে। কৃষকরা বিপদে আছে। তাদের রক্ষা করতে চাল আমদানিতে ১০ ভাগ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। জরুরীভিত্তিতে রবিবার এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে এবং এদিন থেকেই এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘চলতি বোরো মৌসুমে আমাদের কৃষকরা যাতে তাদের উৎপাদিত ধানের ন্যায্য দাম পায় সেজন্যই চাল আমদানির উপর ১০ শতাংশ ডিউটি ইমপোজ করা হয়েছে।’ এর আগে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী জানিয়েছেন, বাংলাদেশ এখন চাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং চাল আমদানির কোন প্রয়োজন নেই। তাই কৃষকদের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে আমরা চাল আমদানির ওপর শুল্ক আরোপ করেছি। বিবিসি বাংলাদেশ সংলাপে তিনি বলেন, ‘গত তিন বছর সরকার এক ছটাকও চাল আমদানি করেনি, এটা আমি পরিষ্কার বলতে পারি। তবে খাদ্যদ্রব্য আমদানির ক্ষেত্রে কোন শুল্ক না থাকায় বেসরকারী পর্যায়ে অনেকে সেই সুযোগ নিয়ে চাল আমদানি করেছে।’ এতদিন চাল আমদানিতে কোন শুল্ক ছিল না। এ সুযোগে বিদেশ থেকে আমদানি আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও এত বেশি পরিমাণ চাল আমদানি হয়েছে যে চলতি বোরো মৌসুমে ধানের দাম আশঙ্কাজনকভাবে পড়ে গেছে। ন্যায্যমূল্য দূরের কথা চালের উৎপাদন খরচও তুলতে পারছে না কৃষক। ফলে ধানের বাম্পার ফলন করে কৃষক হতাশায় পড়েছে। কারণ সরকার ৩৩ টাকা দরে প্রতিকেজি চাল সংগ্রহ করছে। কিন্তু আমদানি করা চালের মূল্য এর চেয়ে কম। সেজন্য বোরো মৌসুমে কৃষক ক্ষতির মুখে পড়ে। ইতোমধ্যে সরকার চলতি মাস থেকে প্রতিমণ ধান ৮৮০ টাকায় কেনার ঘোষণা দিয়েছে। জানা যায়, চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত দেশে চাল আমদানি হয়েছে প্রায় সাড়ে আট লাখ টন। এর বাইরে আরও দশ লাখ টন চাল আমদানি করার জন্য ব্যবসায়ীরা ঋণপত্র খুলেছেন। আর চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে গত অর্থবছরের তুলনায় চাল আমদানি বেড়েছে প্রায় ২৪৫ শতাংশ। গত অর্থবছরের পুরো সময় দেশে ৩ লাখ ৭৪ হাজার টন চাল আমদানি করা হয়। অথচ চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ২০ এপ্রিল পর্যন্ত আমদানি করা হয়েছে ১২ লাখ ৯১ হাজার ৪১০ টন চাল। ২০১২-১৩ অর্থবছরে চাল আমদানি আরও কম ছিল। সে অর্থবছরে চাল আমদানি হয় মাত্র ২৮ হাজার ৯৩০ টন। বিগত বছরগুলোয় সরকারের পাশাপাশি চাল আমদানি করে বেসরকারী খাত। চলতি অর্থবছর সরকারীভাবে কোন চাল আমদানি হয়নি, সবই আমদানি হয়েছে বেসরকারীভাবে। বরং সরকার চাল আমদানি না করে শ্রীলঙ্কায় ২৫ হাজার টন চাল রফতানি করেছে। এ প্রসঙ্গে কৃষিমন্ত্রী আরও বলেছেন, ভারতের গুদামে যে চাল থাকে সেটি দুই বছর অতিবাহিত হয়ে গেলে গুদাম খালি করার জন্য ‘পানির দামে’ চাল ছেড়ে দেয়া হয়। বাংলাদেশের অনেক ‘অসাধু ব্যবসায়ী’ সেই সুযোগ নিয়ে চাল আমদানি করে। তাই বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে চাল আমদানির উপর ১০ শতাংশ শুল্ক বসানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ এখন চাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং চাল আমদানির কোন প্রয়োজন নেই।’ গত তিন বছর সরকারিভাবে কোন চাল আমদানি না হলেও খাদ্যদ্রব্য আমদানির ক্ষেত্রে কোন শুল্ক না থাকায় বেসরকারী পর্যায়ে অনেকে সেই সুযোগ নিয়ে চাল আমদানি করছে। এতে হঠাৎ করে বাজারে চালের দাম কমে যায়। ফলে নতুন ওঠা বোরো ধানের ওপর তার প্রভাব পড়ে। দেশের কোন কোন এলাকায় নতুন ওঠা বোরো ধানের দাম ৪৫০ টাকায় নেমে আসে। কৃষক সংগঠনগুলো এই চাল আমদানির বিরোধিতা করে আসছিল। তারা বলে আসছিল, ভারত থেকে কম দামে চাল আমদানি করায় কৃষকের ফসলের উৎপাদন ব্যয় উঠে আসা কঠিন হয়ে পড়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাংলাদেশের বাজার থেকে ধান ক্রয় করে চাল তৈরি করতে যে খরচ হয় তার চেয়ে কম দামে ভারত থেকে আমদানি করা যাচ্ছে। চাল আমদানিতে শুল্ক আরোপকে সাধুবাদ জানিয়ে ব্র্যাকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ মাহবুব হোসেন বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম ৩০ শতাংশ কমে গেছে। এ ছাড়া অনুকূল আবহাওয়ার কারণে ধানের উৎপাদনও এ বছর বেশি। ফলে চালের আন্তর্জাতিক দর গত ছয় মাসে প্রতি টনে ১৫০ থেকে ২৫০ ডলার পর্যন্ত কমেছে। এ পরিস্থিতিতে থাইল্যান্ড এবং ইন্দোনেশিয়া তাদের কৃষকদের ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে আমদানির ওপর শুল্ক ও সরকারী সংগ্রহ বাড়িয়েছে। বাংলাদেশ সরকারকেও কৃষক বাঁচাতে হলে এই নীতি অনুসরণ করতে হবে। চাল ব্যবসায়ীরা জানান, শূন্যশুল্কে চাল আমদানির পাশাপাশি ভারতীয় ব্যবসায়ীরা তাদের দেশ থেকে চাল রফতানির ওপর প্রণোদনাও পাচ্ছেন। ফলে বাংলাদেশের চালের চেয়ে ভারতীয় চালের দর কম পড়ছে। ভারতীয় চালের প্রতিকেজির আমদানিমূল্য ২৫ থেকে ৩০ টাকা পড়ছে। আর সরকার নির্ধারিত দরে ধান কিনে চালকলে ভাঙলে প্রতিকেজি চালের দর পড়ছে ৩০ থেকে ৩২ টাকা। ফলে ব্যবসায়ীরা চাল আমদানির দিকেই মনোযোগ বেশি দিচ্ছেন। এ বিষয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) ফেলো ড. আসাদুজ্জামান বলেন, চলতি বোরো মৌসুমের আগে চাল আমদানি যেমন বেড়েছে, তেমনি কৃষককে দুর্যোগে ক্ষতির মুখোমুখি হতে হয়েছে। আমদানি বাড়িয়ে বাজারে চালের চাহিদায় কিছুটা ভারসাম্য আনার চেষ্টা চললেও এতে ক্ষতির শিকার হচ্ছেন কৃষকরা। আমদানি বাড়ায় কৃষক সবচেয়ে বড় আয়ের মৌসুমে ধানের দাম থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। আর এ মৌসুমে ধানের দাম না পেলে কৃষক আগামী মৌসুমে ধান আবাদে নিরুৎসাহিত হতে পারেন। সেক্ষেত্রে আগামী আমন মৌসুমে চাল উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হবে। তিনি বলেন, সরকার মৌসুমের শেষ সময়ে এসে চাল আমদানিতে করারোপের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা বেশি দেরিতে নেয়া হয়েছে। এটি আরও আগে নেয়া উচিত ছিল।
×