ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিনিয়োগ বৃদ্ধির পদক্ষেপ থাকছে বাজেটে

প্রকাশিত: ০৬:২১, ১০ মে ২০১৫

বিনিয়োগ বৃদ্ধির পদক্ষেপ  থাকছে বাজেটে

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ বিনিয়োগ বাড়াতে ঋণের বিপরীতে ব্যাংক সুদ কমানো হচ্ছে। আগামী ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেটে সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটের মধ্যে নিয়ে আসার প্রচেষ্টা থাকবে। এজন্য কমিয়ে আনা হবে সঞ্চয়পত্রের সুদহার। বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়লেও এর সুফল পাচ্ছে না শিল্পোদ্যোক্তারা। এর কারণ সঞ্চালন লাইনে সমস্যা রয়েছে। এই সমস্যা সমাধানে আগামী বাজেটে বিশেষ কৌশল গ্রহণ করা হবে। গত কয়েক বছর ধরে প্রবৃদ্ধির হার ৬ অঙ্কে ঘুরপাক খাচ্ছে। বিনিয়োগ না বাড়ার কারণে এটা হচ্ছে। তবে প্রবৃদ্ধির এই হার আগামী বাজেটে বাড়বে। এজন্য প্রশাসনিক সংস্কারসহ অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ উৎসাহিত করা হবে। অর্থনৈতিক জোন প্রতিষ্ঠা, বৈদেশিক সাহায্য ও ঋণের সর্বোচ্চ ব্যবহারের দক্ষতা বাড়ানো এবং রাজস্ব আয় বৃদ্ধিতে নতুন করদাতা খুঁজে বের করাসহ আরও বিভিন্নমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। গত শুক্রবার রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে এনটিভি ও এফবিসিসিআইয়ের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত ‘কেমন বাজেট চাই-২০১৫-১৬’ শীর্ষক মতবিনিময় অনুষ্ঠানে বক্তারা এসব কথা বলেন। এই অনুষ্ঠানে প্যানেল আলোচক হিসেবে অংশ নেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, পানি সম্পদমন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ইনাম আহমদ চৌধুরী, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী, সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ সিপিডির সম্মানিত ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। এছাড়া ওই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন দেশের শীর্ষ স্থানীয় অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী-চেম্বার নেতৃবৃন্দ, ব্যাংকারসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। অনুষ্ঠানটি রাত সোয়া আটটায় সরাসরি সম্প্রচার করে এনটিভি। অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করেন এফবিসিসিআই সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন আহমদ। নিউইয়র্ক ও চট্টগ্রামে আলাদা স্টুডিওতে মূল অনুষ্ঠানের সঙ্গে সংযোগ ঘটিয়ে সরাসরি আলোচনার ব্যবস্থা করা। ঢাকার বাইরে এই দুই স্টুডিওতে অংশ নেন স্থানীয় ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা। এই অনুষ্ঠানের উন্মুক্ত আলোচনা ও প্রশ্নোত্তন পর্বে অংশ নিয়ে অধিকাংশ ব্যবসায়ী বলেন, উচ্চমাত্রার সুদের হারের কারণে দেশে বিনিয়োগ হচ্ছে না। এছাড়া জমির স্বল্পতা, গ্যাস, বিদ্যুত সমস্যা এবং অবকাঠামোর উন্নয়ন না হওয়ার কারণে কাক্সিক্ষত বিনিয়োগ দেশে হচ্ছে না। এ কারণে বাড়ছে না বিনিয়োগ এবং প্রবৃদ্ধির হার ৬ অঙ্কের ঘরে ঘুরপাক খাচ্ছে। তাই আগামী বাজেটে সুদহার কমানোর কোন পদক্ষেপ থাকছে কি না ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয়। এছাড়া সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমানোরও পরামর্শ দেয়া হয়। ব্যবসায়ীদের এসব প্রশ্ন ও পরামর্শের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, সুদের হার কমানোর পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। তবে সুদের হার তো সরকার নির্ধারণ করে না। এটা আপনারাই করেন। আপনারা, ব্যবসায়ীরা একদিকে ঋণ নেন, আবার যখন ঋণ দেন তখন আপনারাই সুদের হার বেশি করে নির্ধারণ করেন। তিনি বলেন, তারপরও বিষয়টি সরকার গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। এ কারণে জাতীয় সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। আজ রবিবার এ বিষয়ে সরকারী আদেশ জারি হতে পারে। অনুষ্ঠানে আলোচকদের অনেকেই ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদহার বিনিয়োগের বাধা হিসেবে উল্লেখ করেন। তারা মনে করেন, সঞ্চয়পত্রের বর্তমান সুদহার বাজারের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমলে ব্যাংকে আমানতের সুদহার কমবে। ফলে ঋণের সুদহারও কমে আসবে। এছাড়া সঞ্চয়পত্রের সুদহার সরকারের ব্যয়ের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করছে। এর জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, সঞ্চয়পত্রের সুদহার ইতোমধ্যে পর্যালোচনা করা হয়েছে। এটা সমন্বয় করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তবে সুদহার কতটুকু কমছে তা তিনি উল্লেখ করেননি। যদিও বিভিন্ন ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদহার এখন ১২ দশমিক ৫৯ শতাংশ থেকে ১৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ, যা ব্যাংকের আমানতের সুদহারের চেয়ে অনেক বেশি। আলোচকরা আগামী অর্থবছরের বাজেটে বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য পদক্ষেপ নেয়ার সুপারিশ করেন। বিনিয়োগের জন্য জমি, বিদ্যুত ও গ্যাসের পর্যাপ্ত সরবরাহের প্রয়োজনীতা তুলে ধরেন তারা। অনেকেই জ্বালানি তেলের দাম কমানোর প্রস্তাব দেন। কেউ কেউ বাজেটে দেশীয় শিল্পের সংরক্ষণের কথা বলেন। এছাড়া সামাজিক নিরাপত্তায় বরাদ্দ বাড়ানো, কৃষিতে আরও মনোযোগ দেয়া, শিক্ষার গুণগত মান বাড়ানো, তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিশেষ মনোযোগ দেয়াসহ নানা প্রস্তাব আসে। অর্থমন্ত্রী বলেন, দেশে আর নতুন কোন রাস্তার প্রয়োজন নেই, বিদ্যমান রাস্তার উন্নয়নই এখন আমাদের লক্ষ্য। আগামী বাজেটে সেদিকেই নজর দেয়া হবে। আমি সবার কাছে বিনীত অনুরোধ করব, আপনারাও আর রাস্তা তৈরির প্রয়োজনীয়তা সৃষ্টি করবেন না। তিনি আরও বলেন, আমরা বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়িয়েছি, কিন্তু সঞ্চালন ব্যবস্থা সেরকম করে উন্নত হয়নি। এদিকে এই বছর নজর দেয়া হবে। আমাদের দেশের কিছু টোল রাস্তার প্রয়োজন রয়েছে, তা না হলে আমাদের পরিবহন খাতটির উন্নয়ন করা কঠিন হবে। আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, অর্থনীতিতে সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি হবে এ বছরেই। অনেকদিন ধরে ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধিতে বসে আছি। এটা থেকে বেরুনোর সময় এসেছে। আশা করছি আগামী বছর পারব। ছয় বছর আগে ৯২ হাজার কোটি টাকার বাজেট থেকে এবার ৩ লাখ কোটি টাকার বাজেট দেয়া হচ্ছে। অনুষ্ঠানের আলোচক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের বক্তব্যের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, তিনি (ড. দেবপ্রিয়) বাজেটকে উচ্চাভিলাসী বলে অভিহিত করেন। এ শব্দটি আমি পছন্দ করি। এটা শুনতেও আমি অভ্যস্ত। আমি প্রতিবছরই উচ্চাভিলাসী বাজেট দেই। এখন বাজেট হচ্ছে তিন লাখ কোটি টাকা। আগামীতে বাজেটের আকার আরও বড় হবে। আইসিটি খাতে দীর্ঘমেয়াদী ট্যাক্স হলিডের প্রয়োজন নেই উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রী বলেন, এখন যা আছে সেই ব্যবস্থার হয়ত একটু উন্নয়ন করা যায়। পেট্রোলিয়াম ব্যবস্থাপনার বিষয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে অর্থমন্ত্রী বলেন, এতে একবার আমরা ভর্তুকি দিচ্ছি, আবার অন্য খাত থেকে তা আদায় করছি, এটা পুরো সিস্টেমে জঞ্জাল সৃষ্টি করছে। অনুষ্ঠানে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বাজেট সংস্কারমুখী বা বিনিয়োগমুখী না হলে ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধির বৃত্ত থেকে বের হওয়া কঠিন হবে। তিনি আরও বলেন, পুনর্মূল্যায়নে পদ্মা সেতু প্রকল্পের ব্যয় বেড়েছে ৮ হাজার কোটি টাকা। বড় প্রকল্পগুলো সময় মতো বাস্তবায়ন না হলে ব্যয় বাড়ে। তিনি বলেন, এরপর এবারের বাজেট প্রণয়নে সরকার ৬টি জায়গায় সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে। মূল্যস্ফীতির চাপ নেই, সুদের হার নিম্নগামী, বিনিময় হার, বাজেট ঘাটতি নিয়ন্ত্রণ, রিজার্ভ বৃদ্ধি, বৈদেশিক ব্যালেন্স অব পেমেন্ট, জ্বালানি ও সারের দাম কম এবং বাজেটে ভর্তুকির চাপ নেই। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এবি মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বেসরকারী খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য ব্যাংকের আমানতের প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হবে। ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, বিদ্যুতের উৎপাদন বেড়েছে, কিন্তু বিতরণের মান বাড়েনি। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী বলেন, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বাজেট বাস্তবায়নের প্রধান অন্তরায়। যদিও এটা নিয়ন্ত্রণে অর্থমন্ত্রীর কোন হাত নেই। আলোচনায় অংশ নিয়ে নিটল গ্রুপের চেয়ারম্যান আবদুল মতলুব আহমেদ বলেন, ব্যাংক সুদের হার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনা প্রয়োজন। ইনাম আহমদ চৌধুরী বলেন, প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণের ধারাবাহিকতায় আমাদের প্রশাসনকে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে।
×