ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মোস্তাফা জব্বার

ভুলে যাওয়া মুজিব বাহিনী

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ১০ মে ২০১৫

ভুলে  যাওয়া  মুজিব  বাহিনী

॥ দুই ॥ আগের লেখায় মুজিব বাহিনীর গঠন সম্পর্কে আলোচনা করেছি। তবে মুজিব বাহিনী গঠন করার যেসব কারণগুলো উল্লেখ করেছি তার বাইরে আরও কিছু বিষয় ছিল যার জন্য মুজিব বাহিনী গঠন করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। মুজিব বাহিনীর প্রশিক্ষক ও কমান্ডার মেজর জেনারেল (অব) এসএস ওবান তার বইতে একটি অধ্যায় রচনা করেছেন যার শিরোনাম হচ্ছে মুক্তিবাহিনী ও মুজিব বাহিনী। তিনি মুজিব বাহিনী গড়ে তোলার উদ্যোক্তাদের মুজিব বাহিনী গঠন করার বিষয়ে যুক্তিগুলো তার বইতে এভাবে তুলে ধরেন, “যুব নেতারা বাংলাদেশের ভেতরে তাদের বিস্তৃত সংগঠনের বদৌলতে জানতে পেরেছিলেন যে, কিছু মুক্তিবাহিনী ইউনিট কিছু বদঅভ্যাস রপ্ত করেছে, যাদের মধ্যে কতকে সাধারণ জনগণের ওপর লুটতরাজ করেছে এবং তাদের ওপর ভয়াবহ অত্যাচার চালিয়েছে, অন্যরা ব্যক্তিগত শত্রুদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহণ করেছে। ...যদিও একটি ফোর্স হিসেবে মুক্তিবাহিনী চমৎকার কাজ করেছিল, তবু মুক্তিবাহিনীর মধ্যে কেউ কেউ ছিল নিন্দনীয় এবং তারা গোটা ফোর্সের দুর্নাম সৃষ্টি করেছিল।...তাদের আরেকটি যুক্তি ছিল যে, বাংলাদেশে মুজিব বাহিনী নামটার গ্রহণযোগ্যতা হবে অপরিসীম এবং এটা শুধু তাদের সংগঠন থেকেই সহায়তা বয়ে আনবে না বরং সাধারণ মানুষের কাছ থেকেও সহায়তা বয়ে আনবে।” (ওবানের বইয়ের বাংলা অনুবাদ থেকে-পৃষ্ঠা ৪০) জেনারেল ওবানের বক্তব্যে মুক্তিবাহিনীর কোন কোন সদস্যের বিরুদ্ধে যে ধরনের অভিযোগের কথা বলা হয়েছে তার পরিমাণ খুব বেশি ছিল না। আমার নিজের জানা মতে, কিছু কিছু মুক্তিযোদ্ধা যেমন প্রতিশোধ নিতে যুদ্ধে গিয়েছিল, তেমনি রাজাকার বাহিনীতেও কেউ কেউ গিয়েছিল ব্যক্তিগত-পারিবারিক কোন্দল বা দলাদলির জন্য। কিন্তু মুক্তি বাহিনীর কিছু সংখ্যক সদস্যের বৃন্তচ্যুতির জন্যই মুজিব বাহিনী গঠন করা হয়েছিল এই যুক্তিটি সঠিক নয়। জেনারেল ওবানের কাছে এটি একটি কারণ মনে হলেও আমার কাছে মনে হয়েছে মুজিব বাহিনী গঠনের পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ ছিল রাজনৈতিক। একাত্তরের যুদ্ধের সময় একটি রাজনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ ও সচেতন সশস্ত্র গেরিলা বাহিনী যারা রাজনৈতিক সচেতনতা নিয়ে সশস্ত্র লড়াই করবে তাদের প্রয়োজনীয়তা অবশ্যই ছিল। মুক্তিবাহিনী সাধারণ মানুষের বাহিনী ছিল বলে এর রাজনৈতিক চরিত্র নির্ণয় করাও কঠিন ছিল। যদিও ’৭০-এর নির্বাচনের পর বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের বাইরে তেমন কোন বড় রাজনৈতিক শক্তি ছিল না- তথাপি আওয়ামী লীগের কর্মী হলেও সে স্বাধীনতার লড়াইয়ের অর্থ বুঝবে তেমনটি হওয়ার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকতে পারে না। বরং মুক্তিবাহিনীতে যোগদানকারী ইপিআর-পুলিশ সৈনিক এবং সাধারণ মানুষের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক ভিত্তিটা ততটা স্পষ্ট ছিল না। ষাটের দশকের নিউক্লিয়াসের কথা আলোচনায় না আনলেও এটি স্পষ্ট করে বলা যায় যে, ’৬৯-৭০-৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে সশস্ত্র সংগ্রামের পথে নিয়ে যাওয়ার পেছনে সিরাজুল আলম খান ও তার সহযোগী যুব নেতৃত্ব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। জাতির জনককে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেয়া, জয় বাংলা সেøাগানের জন্ম দেয়া, জাতীয় পতাকা তৈরি, জাতীয় সঙ্গীত বাছাই, স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রস্তাব পাশ, স্বাধীনতার ইশতেহার ঘোষণা, পতাকা উত্তোলন, জয় বাংলা বাহিনী গঠন ইত্যাদির সবটাই এই নেতৃত্ব করেছে। ওরাই যখন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে গেছে তখন যুদ্ধের অগ্রসেনানীর জায়গাটিতে তাদেরকে গড়ে তোলাটাই একটি অপরিহার্য বিষয় ছিল। সমালোচকদের কেউ কেউ বলেন, মুজিব বাহিনী গঠনের ব্যাপারে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের আগ্রহ ছিল না। তখনকার প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ এমন একটি বাহিনী গড়ে উঠুক তেমনটি চাননি বলে খোদ মেজর জেনারেল ওবান তাঁর বইতে উল্লেখ করেছেন। মুজিব বাহিনীর নেতারা তাজউদ্দীন আহমদ শেখ মুজিবের বিপক্ষে কাজ করছেন তেমন অভিযোগও নাকি করেছেন। কিন্তু তাজউদ্দীন আহমদ জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন যে, তাঁর মতো বিশ্বস্ত মুজিবভক্ত আর একটিও ছিল না। ওবান তাঁর বইতে মুজিব বাহিনী নিয়ে ভারত সরকার এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গেও নানাভাবে সঙ্কটাপন্ন হয়েছেন বলে উল্লেখ করেছেন। ওবানের বইতে মুজিব বাহিনীর কৃতিত্ব হিসেবে তাঁর চট্টগ্রাম অপারেশন্স যেমন উল্লিখিত হয়েছে তেমনি উল্লিখিত হয়েছে মুজিব বাহিনীর শক্তি-সাহস, প্রজ্ঞা, মেধা ও দেশপ্রেমের বিষয়টি। মুজিব বাহিনী সম্পর্কে উইকিপিডিয়াতে বলা আছে, Mujib Bahini was a special force created by the and composed of 60,000 young supporters of the liberation movement. It was organised with the active assistance of of the . Student League leaders and ; ; and were the organizers of this special force. It is alleged that this force was formed during the concluding part of Liberation War according to the policy of Awami League and the ally, India, aimed against the leftist freedom fighters to bar them from taking the lead in the War. অন্যদিকে বাংলাপিডিয়াতে বলা হয়েছে, Mujib Bahini was formed during the . It was mainly composed of activists drawn from the and its student front Chhatra League. It had enlisted about 5000 members who were posted out to four sectors with a 19-member central command. Initially, the sector commanders operated from Barrackpur, Shiliguri, Agartala and Meghalaya of India. Tofail Ahmed, Sirajul Alam Khan, Abdur Razzak and were the central commanders with Moni acting as the commander-in-chief. This force was trained under the direct supervision of Major General Uban of India at Deradun hills. The was not said to have been informed about the formation and training programmes of Mujib Bahini. Besides, the Bahini never made formal declaration of allegiance to the Mujibnagar government. So, controversies were created within and outside the Bangladesh government-in-exile regarding the formation of Mujib Bahini. For resolving this dispute, some senior civil and military officials of India like DP Dhar and General Manek Shaw mediated between the Bangladesh government and the Mujib Bahini leaders. The government of India provided the Bahini with one C-4, one N-12 and an old Dakota along with trucks and jeeps. Many believe that Mujib Bahini was formed to face the emergence of any alternative leadership in the event the liberation war was prolonged. Others think that the leaders of Mujib Bahini created this force because they were not satisfied with the working of Mujibnagar government and were suspicious about the activities of the rightist faction of the Awami League. In the battlefield, the Mujib Bahini fought shoulder to shoulder with other freedom fighters. It carried out daring raids into the Pakistani occupation army’s positions in the south, the south-west and some areas around Dhaka. It was especially trained in guerrilla warfare and was equipped with comparatively better weapons. The concept of Mujib Bahini appears to have been developed in the middle of 1960s. It remained as an academic theme for a long time within the confines of Dhaka University and among some nationalist intellectuals. It is the core members of the Mujib Bahini who forged the Sarbadaliya Chhatra Sangram Parishad and who enunciated eleven-point programme in 1969. They also led the mass uprising of 1969. It is this group which led the nationalist struggle for independence from 1 March 1971, declared independence on 3 March at Paltan Maidan and organised subsequent preparations for an eventual War of Liberation. [Helal Uddin Ahmed] মুক্তিযুদ্ধটি শেষ হবার চার দশক পার হবার পরও এই বাহিনী সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য পাওয়া যায় না। ভবিষ্যতে হয়ত আরও কম তথ্য পাওয়া যাবে। এরই মাঝে মুজিব বাহিনীর দু’জন সংগঠক শেখ ফজলুল হক মণি ঘাতকের হাতে নিহত ও আবদুর রাজ্জাক মারা গেছেন। মুজিব বাহিনীর সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত কাজি আরেফ আহমেদও নেই। নেই ড. আফতাব আহমদসহ আরও অনেক সদস্য ও নেতা। বাকিরা জীবিত থাকলেও তারা এসব বিষয়ে তেমন কোন কথা বলেন না। আমি নিজে এই বাহিনীর অতি সাধারণ একজন কর্মী ছিলাম বলে আমি স্মরণ করতে পারি যে, এই বাহিনী গঠনের প্রথম ও প্রধান উদ্দেশ্য ছিল একটি দীর্ঘমেয়াদী রাজনৈতিক যুদ্ধ করা, যার রণকৌশল হতো গেরিলা কায়দার। জেনারেল ওবান গেরিলা যুদ্ধের বিশেষজ্ঞ ছিলেন বলেই তাঁকে এই বাহিনী সংগঠিত করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। একাত্তরে আমার তো আর দিল্লীর খবর জানার ক্ষমতা ছিল না। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পাহাড়ের চাইতে দিল্লীর দূরত্ব যেমন বেশি ছিল তেমনি ছিল অতি নিচু পর্যায়ের একজন ক্ষুদ্র দেশপ্রেমিক তরুণের দিল্লীর লাড্ডুর খবর পাবার ক্ষুদ্রতা। যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার যে বন্ধুরা ছিল তাদের সঙ্গেও থাকতে পারতাম তবে হয়ত এখন ব্যাখ্যা করতে পারতাম ওবান কতটা সত্য আর কতটা মিথ্যা বলেছেন। আমি পাহাড়ে বসে এমন কথাই শুনেছিলাম যে, আমাদের যুদ্ধটি দীর্ঘস্থায়ী হবে এবং আমাদের ভারতে থেকে নয়, নিজের দেশে থেকেই যুদ্ধ করতে হবে। আমাকে এটিও বলা হয়েছিল যে, ভারতের অস্ত্র নিয়েও যুদ্ধ করা যাবে না- আমাদেরকে দেশের ভেতরে থেকে পাকিস্তানীদের হাতিয়ার কেড়ে নিয়ে যুদ্ধ করতে হবে। এমনকি দেশের ভেতরেই প্রশিক্ষণ এবং দেশের ভেতর থেকেই যোদ্ধা সংগ্রহ করার লক্ষ্য দিয়েই আমাদেরকে দেশের ভেতরে আসতে বলা হয়েছিল। আমার বন্ধুরা ১৬ ডিসেম্বরের আগেই ঢাকা পৌঁছে গিয়েছিল এবং ঢাকাসহ দেশের নানা স্থানে বিভিন্ন ধরনের সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে নানা ধরনের অপারেশন করেছিল। মুজিব বাহিনীতে দশ থেকে ষাট হাজার পর্যন্ত মানুষ যুক্ত ছিল বলে মনে করা হয়। এদের অনেকেই দেশের ভেতরে যুদ্ধ করলেও বস্তুত যুদ্ধটা ব্যাপকভাবে করার সময়টা যখন ডিসেম্বর মাসে এসে যায় তখন তো ভারত সরাসরি যুদ্ধেই জড়িয়ে পড়ে।
×