ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শাহরিয়ার কবির

নির্বাচন ও গণমাধ্যম- দায়বদ্ধতা কোথায়

প্রকাশিত: ০৬:২১, ৯ মে ২০১৫

নির্বাচন ও গণমাধ্যম- দায়বদ্ধতা কোথায়

ইউরোপের বিভিন্ন দেশ এবং আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান প্রভৃতি দেশের কথা বাদ দিলে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার প্রায় সব দেশের নির্বাচনে কম-বেশি অনিয়ম একটি স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়েছে। এমনকি আমাদের প্রতিবেশী বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র ভারত, যেখানে অত্যন্ত শক্তিশালী ও দক্ষ নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসন রয়েছে সেখানেও পরিপূর্ণ অবাধ, সন্ত্রাসমুক্ত সুষ্ঠু নির্বাচন এখনও সম্ভব হয়নি। এসব ক্ষেত্রে আমাদের দেখা দরকার সন্ত্রাস, অনিয়ম ও কারচুপির ঘটনা ঘটলে তার সংখ্যা কত, সামগ্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়ার কত শতাংশ এবং নির্বাচন কমিশন এ বিষয়ে কী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। গত ২৮ এপ্রিল বাংলাদেশের দুই মহানগরের তিনটি মেয়র নির্বাচনে বিএনপি সাড়ম্বরে প্রচারণায় অংশগ্রহণ করলেও নির্বাচনের দিন ভোটগ্রহণ শুরুর চার ঘণ্টার ভেতর ব্যাপক কারচুপি, ভোট ডাকাতি ও সন্ত্রাসের অভিযোগ এনে তিন মেয়র প্রার্থী প্রত্যাহার করে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে। ঢাকা দক্ষিণের কয়েকটি ভোট কেন্দ্রে সন্ত্রাস ও অনিয়মের কিছু দৃশ্য টেলিভিশনে আমরা বার বার দেখেছি, পরে জানা এগুলো ছিল প্রধানত আওয়ামী লীগের দলীয় ও বিদ্রোহী কাউন্সিলরদের সমর্থকদের বিরোধ। এসব কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের স্থানীয় কর্মীদের সন্ত্রাসের কারণে শুধু বিএনপি বা অন্য দল নয়, আওয়ামী লীগেরও অনেকে ভোট দিতে যাননি। তবে যাবতীয় অনিয়ম ও সন্ত্রাসের পরিমাণ শতকরা ২ ভাগের বেশি নয়। সমস্যা হচ্ছে শতকরা ২ ভাগের হিসাব আমাদের করতে হয়েছে গণমাধ্যমের সংবাদ থেকে, বিএনপি এখন পর্যন্ত নিয়ম অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন এবং/অথবা গণমাধ্যমসমূহকে লিখিতভাবে জানায়নি কোন্ কোন্ ভোট কেন্দ্রে কী ধরনের অনিয়ম ও সন্ত্রাস হয়েছে এবং ভিকটিম কারা। বাংলাদেশের দুই মহানগরের পৌর নির্বাচনের দশদিন আগে পশ্চিমবঙ্গে কলকাতাসহ ৯২টি পৌরসভায় নির্বাচন হয়েছে। এই নির্বাচন সম্পর্কেও যথারীতি অনিয়ম কারচুপি ও সন্ত্রাসের অভিযোগ এসেছে বিরোধী বামফ্রন্ট, বিজেপি ও কংগ্রেসের পক্ষ থেকে। ১৮ এপ্রিল পশ্চিমবঙ্গে পৌর নির্বাচনে খুনোখুনি, বোমাবাজি, জালভোট, বিরোধী দলের সমর্থকদের ভোটপ্রদানে বাধাদানসহ বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম ও সন্ত্রাসের খবর গণমাধ্যমেও প্রকাশিত হয়েছে। জালভোট সম্পর্কে বিরোধী দলের একটি অভিযোগ- কলকাতার ৩০টি বুথে ১০৪ থেকে ১৪০ ভাগ ভোট পড়েছে। বিচিত্র সব অনিয়মের খবর বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। তারপরও ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসের ঘোরতর বিরোধী কোন পত্রিকা এমন শিরোনাম করেনিÑ এসব অনিয়মের কারণে গণতন্ত্র পরাজিত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় বাংলাদেশে ভোটগ্রহণ অনেক শান্তিপূর্ণ ও স্বাভাবিক হওয়া সত্ত্বেও ২৯ এপ্রিল বাংলাদেশের অত্যন্ত প্রভাবশালী দৈনিক ‘প্রথম আলো’র শিরোনাম ছিল- ‘জিতল আওয়ামী লীগ, হারল গণতন্ত্র।’ ‘প্রথম আলো’র সহযোগী ইংরেজী দৈনিক ‘ডেইলি স্টার’-এর শিরোনাম ছিল- ′Polls bubble bursts: BNP’s early pullout makes AL win insignificant, irregularities widespread...′। ২৯ এপ্রিলের পরেও এ দুটি কাগজে দুই মহানগরের পৌর নির্বাচনে অনিয়ম ও কারচুপির খবর এমনভাবে ছাপা হয়েছে যাতে মনে হবে অতীতে কোন নির্বাচনে এ ধরনের কারচুপি হয়নি। গত ৩ মে ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’র প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক শহীদ জননী জাহানারা ইমামের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত সেমিনারে অন্যতম বিষয় ছিল দুই মহানগরের নির্বাচন। সেমিনারে উত্থাপিত মূল প্রবন্ধে আমি বলেছিলাম, বিএনপি এত অনিয়মের অভিযোগ করেছে কিন্তু এখন পর্যন্ত নির্দিষ্টভাবে বলেনি কোন কোন কেন্দ্রে কী ধরনের অনিয়ম ও সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটেছে এবং কারা ভিকটিম। সব ভোটকেন্দ্রে ‘ব্যাপক কারচুপি’ হয়েছে, ‘নজিরবিহীন সন্ত্রাস’ হয়েছেÑ এ ধরনের ঢালাও অভিযোগ করলে নির্বাচন কমিশনের কিছু করার থাকতে পারে বলে আমি মনে করি না। আমি গত চব্বিশ বছর ধরে জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচন প্রত্যক্ষ করছি। আমার পর্যবেক্ষণ হচ্ছে ২০০৮-এর ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছাড়া এবারের মতো এতটা শান্তিপূর্ণ নির্বাচন বাংলাদেশে অতীতে হয়নি। আমার এ বক্তব্য নিয়ে তিন কলাম সংবাদ শিরোনাম করেছে ৪ মে’র ‘ডেইলি স্টার’। যদিও অন্যসব দৈনিকে ৩ মে’র সেমিনারের প্রধান অতিথি বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের বক্তব্যই শিরোনাম হয়েছে এবং সেটাই ছিল স্বাভাবিক। ‘ডেইলি স্টার’ শুধু আমার বক্তব্য সংবাদ শিরোনামই করেনি, শেষের পাতায় তাদের ‘ও মাই গড’ কলামেও আমার বক্তব্য উদ্ধৃত করেছে আশ্চর্যচিহ্নহ্ন দিয়ে। নাম উল্লেখ না করে ‘ডেইলি স্টার’ ও ‘প্রথম আলো’র সম্পাদকদের উদ্দেশ করেই আমার প্রবন্ধে লিখেছিলাম, ‘নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জয়ী হলে গণতন্ত্রের জয় হয় আর আওয়ামী লীগ জয়ী হলে গণতন্ত্রের পরাজয় হয় এই মানসিকতার উৎস খুঁজতে হলে আমাদের ’৭১-এ ফিরে যেতে হবে।’ আমার প্রবন্ধে কিছুটা উল্লেখ করেছিলাম ২০০১ সালে ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট নজিরবিহীন সন্ত্রাস, হত্যা, নারী নির্যাতন, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগসহ যাবতীয় ধ্বংসযজ্ঞ করে জয়ী হয়েছিল। বন্ধু মুনতাসীর মামুন জনকণ্ঠে ধারাবাহিকভাবে লিখছেন ‘আওয়ামী লীগ জিতলে গণতন্ত্র পরাজিত, আর বিএনপি জিতলে গণতন্ত্রের জয়!’ অতীতে জিয়া-এরশাদের আমলে নির্বাচনে কত ধরনের অনিয়ম, কারচুপি ও সন্ত্রাস সংঘটিত হয়েছিল মামুন তার এই ধারাবাহিকে উল্লেখ করেছেন, যা আমরা ভুলে গিয়েছিলাম। ২০০১ সালের নির্বাচনের প্রসঙ্গে মামুন আমার লেখারও উল্লেখ করেছেন। সেবার নির্বাচনে প্রতিপক্ষকে হারানোর জন্য যা যা যেভাবে করা দরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার, সামরিক-অসামরিক প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন ও গণমাধ্যমকে দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করে বিএনপি-জামায়াত জোট সবই করেছিল। আমাদের ২৭৬০ পৃষ্ঠার শ্বেতপত্রে এসব অনিয়ম, জালিয়াতি ও সন্ত্রাসের একটি খণ্ডচিত্র পাওয়া যাবে, কারণ সারাদেশে ঘুরে ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করার সামর্থ্য আমাদের ছিল না। আমরা প্রধানত গণমাধ্যম, বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের পর্যবেক্ষণ এবং আমাদের সীমিত তদন্তের ভিত্তিতে ২০০৫ সালে যে শ্বেতপত্রে প্রকাশ করেছিÑ বাংলাদেশে নির্বাচনের ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কিত অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হবে ২০০১-এর ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে পরাজিত করার নীলনকশা শুধু দেশের ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতার ভেতর আবদ্ধ ছিল না। ২০০১ সালে মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক ও যুদ্ধাপরাধী অধ্যুষিত বিএনপি-জামায়াত জোটকে ক্ষমতায় আনার জন্য পাকিস্তানের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল প্রতিবেশী ভারতও। ভারতের যে বৃহৎ পুঁজি এবার বিজেপিকে ক্ষমতায় বসিয়েছে ২০০১ সালে নির্বাচনের আগে তারেক জিয়ার সঙ্গে দফায় দফায় তাদের বৈঠকের খবর তখন ভারতীয় পত্রিকায়ও প্রকাশিত হয়েছিল। পাকিস্তানের পত্রিকায় বেরিয়েছিল আইএসআই কিভাবে বাংলাদেশের সেনাপ্রধানকে আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করেছে। নির্বাচনে জামায়াতকে জয়ী করাবার জন্য সেনাবাহিনীকে কিভাবে ব্যবহার করা হয়েছে তার কিছু প্রমাণ আমার ‘ওদের বাঁচতে দাও’ প্রামাণ্যচিত্রে আছে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের পাশাপাশি সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনের যে স্টিমরোলার চালানো হয়েছিল তার অনেক বিবরণ তখন ‘ডেইলি স্টার’ ও ‘প্রথম আলো’য়ও ছাপা হয়েছিল। আমরা কী ভুলে গেছি বাগেরহাটের সেই হিন্দু মায়ের কান্নাÑ যিনি আত্মজার ধর্ষণকারীদের করজোড়ে বলছেন, বাবারা তোমরা একজন একজন করে আসো, আমার মেয়েটা খুব ছোট! আমরা কি ভুলে গেছি খুলনার আরেক হিন্দু মায়ের কথা, যিনি সাংবাদিকদের মাধ্যমে খালেদা জিয়াকে অনুরোধ করছেন ভোটার তালিকা থেকে তাদের নাম বাদ দেয়ার জন্য, কারণ তারা দেশে থাকতে চান, গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক অধিকার প্রয়োগ করে সর্বস্ব হারিয়ে দেশছাড়া হতে চান না। আমরা কী ভুলে গেছি নিহত জ্ঞানতাপস গোপালকৃষ্ণ মুহুরীর স্ত্রী কিংবা ধর্ষিতা রাধারানী, পূর্ণিমা ও মহিমাদের হাহাকার? সাতক্ষীরার কালীগঞ্জের অসহায় রাধারানী আমার হাত ধরে যখন কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে বলেছিলেন বাবা, আমরা এদেশে থাকতে চাই, আমাদের বাঁচান, আমরা বাঁচতে চাইÑ তাকে সান্ত¡না দেয়ার ভাষা আমার জানা ছিল না। নির্বাচনের আগে ও পরে সন্ত্রাস উপদ্রুত এলাকায় আমরা ঘুরেছি, নির্যাতিতদের হাহাকার শুনেছি, যতদূর সম্ভব ক্যামেরায় ধারণ করেছি, লিখেছি এবং এর জন্য জেলে গিয়েছি। ২০০১ সালের ২২ নবেম্বর আমাকে যখন বিমানবন্দর থেকে গ্রেফতার করে জেলে ঢোকানো হলো তখন ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দীর সংখ্যা ছিল সাত হাজার। দু’মাস পরে যখন জামিনে জেল থেকে বেরিয়ে আসি তখন বন্দীর সংখ্যা এগারো হাজার ছাড়িয়ে গেছে। প্রতিদিন দেখেছি আওয়ামী লীগের মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদের ধরে এনে হাত পা ভেঙ্গে কারাগারের বিভিন্ন সেলে ছুড়ে ফেলে দিয়ে যেতে। জেল থেকে বেরিয়ে ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনামকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলাম। আমার কারা নির্যাতন সম্পর্কে তিনি অত্যন্ত মর্মস্পর্শী একটি সম্পাদকীয় মন্তব্য লিখেছিলেন তার পত্রিকার প্রথম পাতায়। অনেক পত্রিকা যেমন আমার গ্রেফতার ও নির্যাতনের প্রতিবাদ করেছিল তেমনি ‘ইনকিলাব’-এর মতো পত্রিকা ‘অবাধ’ নির্বাচনের পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে ধারাবাহিকভাবে আমার প্রতি বিষোদগারও করেছে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিষয়টি অধিকাংশ দৈনিক প্রথমে উপেক্ষা করেছিল। পরে যারা এসব সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের খবর ছেপেছে তারা এগুলোকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখেছে, নির্বাচনের সঙ্গে এর সম্পর্ক খুঁজে পায়নি। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দাবিদার এমন একটি দৈনিকে আমার সমালোচনা করা হয়েছে এই বলে যে আমি নাকি সংখ্যালঘু নির্যাতনের অতিরঞ্জিত প্রতিবেদন ও কলাম লিখে দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করছি। প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ চৌধুরী প্রথম দিন থেকেই বলেছেন, দেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার কোন ঘটনা ঘটেনি, কিছু কিছু সংবাদপত্র এ বিষয়ে অতিরঞ্জিত, মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত খবর ছেপে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে চাইছে। আমার গ্রেফতারের পর সিরাজগঞ্জে গণধর্ষণের শিকার কিশোরী পূর্ণিমার মাকে আমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য বিশ হাজার টাকা দিতে চেয়েছিলেন স্থানীয় বিএনপির এক নেতা ও পুলিশ প্রশাসন। শর্ত ছিল তাকে বলতে হবে পূর্ণিমাকে ধর্ষণের ঘটনা ঠিক নয়। পূর্ণিমার হতদরিদ্র মা বাসনা রানী সেই টাকা প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন, পূর্ণিমা শাহরিয়ার কবিরকে বাবা ডেকেছে। বাবার বিরুদ্ধে পূর্ণিমা মিথ্যা সাক্ষী দিতে পারবে না। গ্রেফতারের আগে আমার একাধিক কলামে লিখেছিলাম, সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের চেয়েও জঘন্য অপরাধ হচ্ছে নির্যাতনের ঘটনা অস্বীকার করা, ধর্ষণের মতো ঘটনাকে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেয়া। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরী পূর্ণিমা ধর্ষণের ঘটনাও অবলীলায় অস্বীকার করে বলেছিলেন, ওকে কেউ ধর্ষণ করেনি, শুধু ওড়না ধরে টেনেছিল। সেবার ‘ডেইলি স্টার’ ও ‘প্রথম আলো’ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের খবর ছেপেছিল বটে নির্বাচনকে অবাধ, শান্তিপূর্ণ ও নিরপেক্ষ বলতে কার্পণ্য করেনি। নির্বাচনের পরদিন ‘ডেইলি স্টার’-এর শিরোনাম ছিল ‘Voters opt for change। ৩ অক্টোবর ডেইলি স্টার-এর আট কলাম ব্যানার হেডিং ছিল ‘‘Historic landslide victory for BNP : Debacle for AL, bags 62 seats .’ এর নিচে খালেদা জিয়ার সংবাদ ‘ঞরসব ভড়ৎ ঁহরঃু, হড়ঃ ফরারংরড়হ.’ তারপর শেখ হাসিনার সংবাদ অখ ৎবলবপঃং বষবপঃরড়হ ৎবংঁষঃং, ধষষবমবং ‘পৎঁফব ৎরমমরহম.’ ২ অক্টোবর প্রথম আলোর আট কলাম শিরোনাম ছিল ‘বিএনপিসহ চার দলে বিপুল বিজয় : উৎসবের আমেজে শান্তিপূর্ণ ভোটগ্রহণ, কিছু স্থানে বিক্ষিপ্ত সহিংসতা, মহিলাসহ ভোটার উপস্থিতি ব্যাপক’। ২০০১ সালের নির্বাচনে নজিরবিহীন সন্ত্রাস, ভোট ডাকাতি ও কারচুপি প্রথম আলোর ভাষায় ‘কিছু স্থানের বিক্ষিপ্ত সহিংসতা’ আর ২০১৫-এর মেয়র নির্বাচনে নগণ্য সংখ্যক অনিয়ম ও সন্ত্রাসের ঘটনাকে গণতন্ত্রে পরাজয় বিবেচনা করা কখনও সৎ সাংবাদিকতার নিদর্শন হতে পারে না। ২০০১ সালে ‘জনকণ্ঠ’ ও ‘ভোরের কাগজ’-এর মতো কয়েকটি পত্রিকা সাহস করে নির্বাচনে অনিয়ম, কারচুপি ও সন্ত্রাসের খবর ধারাবাহিকভাবে ছেপে কিভাবে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের রোষানলে পড়েছিল আমরা জানি। ভোরের কাগজ-এর সম্পাদক সাবের হোসেন চৌধুরীকে গ্রেফতার করা হয়েছে, জনকণ্ঠে বিদ্যুতের লাইন কেটে দেয়া হয়েছে, সরকারী বিজ্ঞাপন বন্ধ করা হয়েছে, এমনকি বোমাও মারা হয়েছে। তখন মাহফুজ আনাম বা মতিউর রহমানের মতো জাঁদরেল সম্পাদকরা ঘটা করে কোন প্রতিবাদ করেছেন বলে মনে পড়ছে না, যেমনটি হালে তারা করেছেন ‘আমার দেশ’-এর সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের গ্রেফতারের সময়। যদিও আমরা জানি সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নামে মাহমুদুর রহমান কিভাবে জামায়াত-হেফাজত-বিএনপির নজিরবিহীন মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসে ইন্ধন জুগিয়েছেন। গণমাধ্যমকে দায়বদ্ধ থাকতে হয় সত্যের প্রতি, জনস্বার্থের প্রতি। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের আরও একটি দায়বদ্ধতা আছেÑ সেটি ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে তিরিশ লাখ শহীদ, পাঁচ লক্ষাধিক ধর্ষিত নারী এবং কয়েক কোটি মানুষের চরম ত্যাগের প্রতি। এক কথায় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনার প্রতি। বাংলাদেশের প্রতি দায়বদ্ধ গণমাধ্যমে আর যাই হোক পাকিস্তানী ন্যারেটিভ আমরা দেখতে চাই না। আওয়ামী লীগের অপকর্মের বহু সমালোচনা আমরা করতে পারি এবং করা প্রয়োজনও। কিন্তু আওয়ামী লীগের সমালোচনা করতে গিয়ে আমাকে যদি জামায়াত ও পাকিস্তানপন্থীদের পঙ্ক্তিতে দাঁড়াতে হয়Ñ দুঃখিত, সে অবস্থান আমার কাম্য নয়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয়-পরাজয় সম্পর্কে আহমদ ছফার একটি বক্তব্য আমার কাছে তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়। আওয়ামী লীগের কট্টর সমালোচক আহমদ ছফা লিখেছিলেন, নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হলে একা জয়ী হয়, হারলে গোটা মুক্তিযুদ্ধ পরাজিত হয়। স্মৃতি থেকে উদ্ধৃত করছি, শব্দের হেরফের হলেও বিষয়বস্তু এটিই। ২০১৫-এর সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয় হলেও দলে নেতৃত্বের জন্য অশনিসঙ্কেত হচ্ছে দলীয় ও বিদ্রোহী প্রার্থীদের সংঘর্ষ ও সহিংসতা, যা আগামীতে আরও বৃদ্ধি পাবে বলে আশঙ্কা করছি। নির্বাচনের আগে ৯২ দিনের যাবতীয় সন্ত্রাস এবং ভোটগ্রহণের চার ঘণ্টার ভেতর নির্বাচন বর্জনের ঘোষণার পরও বিএনপির পক্ষে ৩৫% ভোটের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। বিএনপিকেও ভাবতে হবে জামায়াতের সহযাত্রী হয়ে তাদের অগস্ত্যযাত্রা আর কতদিন তারা অব্যাহত রাখবে। ৬ মে ২০১৫
×