ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ব্যাংকিং খাতে চাকরিচ্যুতি ॥ গবর্নরের উদ্বেগ

প্রকাশিত: ০৩:৫৬, ৮ মে ২০১৫

ব্যাংকিং খাতে চাকরিচ্যুতি ॥ গবর্নরের উদ্বেগ

খবরের শিরোনাম হচ্ছে : ‘দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছেন এনসিসির পরিচালকরা’। ‘এনসিসি’ মানে ন্যাশনাল ক্রেডিট এ্যান্ড কমার্স (এনসিসি) ব্যাংক লিমিটেড যা এক সময় ছিল ‘ইনভেস্টম্যান্ট’ বা ফিন্যান্স কোম্পানি। গত শতাব্দীর শেষের দিকের ঘটনা। এই কোম্পানিটি আরেকটি ফিন্যান্স কোম্পানি অর্থাৎ ‘বিসিআই’র সমসাময়িক সময়ে ‘গাড্ডায়’ পড়ে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকার এ দুটোকে উদ্ধার করে ব্যাংকে রূপান্তরিত করার অনুমতি দেয়। দেখা যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটির এনসিসি সমস্যা ব্যাংক হওয়া সত্ত্বেও শেষ হচ্ছে না। মঙ্গলবারের একটি খবরে দেখা যাচ্ছে ব্যাংকটির পরিচালকরা আবার দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছেন। বিনা নোটিসে তিনজন শেয়ারহোল্ডার পরিচালককে বোর্ড থেকে অপসারণ করা হয়েছে। ব্যাংটির ‘সংঘবিধিও’ পরিবর্তন করা হয়েছে এবং তা অনুমোদনের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠানো হয়েছে। এই নিয়েই নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বা গ-গোল তা হোক গিয়ে, এতে আমাদের মাথাব্যথা কম। ব্যথাটা অন্যত্র। একই খবরে দেখা যাচ্ছে ব্যাংকটির চেয়ারম্যানের নির্দেশে শতাধিক কর্মকর্তাকে ছাঁটাইয়ের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ভাইস প্রেসিডেন্ট, সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও সিনিয়র এ্যাসিস্টেন্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট পদমর্যাদার ৩০ জনের মতো কর্মকর্তা ইতোমধ্যে ব্যাংক ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। অনেককেই চাকরি খুঁজতে মৌখিকভাবে বলা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট খবরটিতে বলা হয়েছে এতে ব্যাংকটিতে অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছে। খবরটি একটাই মর্মার্থ। চেয়ারম্যান সাহেব নির্দেশ দিয়েছেন শতাধিক কর্মকর্তাকে ছাঁটাই করতে হবে। প্রেক্ষাপটে দেখা যাচ্ছে মালিকদের মধ্যকার গ-গোল। এখানেই প্রশ্ন, মালিকদের গ-গোলের শিকার কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা হবেন কেন? ইদানীং এসব ঘটনা বেসরকারী খাতে অহরহ ঘটছে। কয়েকদিন আগে খুবই লাভজনক প্রতিষ্ঠান গ্রামীণফোনের কাহিনীর কথা শুনেছি। এই প্রতিষ্ঠানটিতে কয়েক মাস পরপরই লোকের চাকরি খাওয়া হয়। এটা বিদেশী প্রতিষ্ঠান। ‘দক্ষতার’ কথা বলে তারা ছাঁটাই করে। এনসিসি ব্যাংক দেশী প্রতিষ্ঠান। এখানে দক্ষতার প্রশ্ন নয়। প্রশ্ন মালিকানায় গ-গোল। গ-গোল তাঁরা করতে পারেন। কিন্তু কোন ক্ষমতাবলে ব্যাংকের চেয়ারম্যান কর্মকর্তাদের ছাঁটাইয়ের কথা বলেন? আর্থিক ব্যবসায়িক ও প্রশাসনিক কোন ক্ষেত্রেই চেয়ারম্যান কেন বোর্ডের কিছুই করার নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মানুুসারে এসব দৈনন্দিন বিষয়ে ‘এমডি’ সাহেবই মুখ্য। তাঁর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। বোর্ড করবে নীতিমালা। এর বাইরে চেয়ারম্যান ও পরিচালকদের কিছুই করার নেই। দেখা যাচ্ছে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে তা মানা হচ্ছে না। উপরোক্ত খবরের একদিন পর ব্যাংকের ওপর আরেকটি খবর ছাপা হয়েছে। এবার খবরের শিরোনাম : ‘বেসিক ও ফারমার্স ব্যাংকে অনিয়মে দুই ভাই।’ দুই ভাইয়ের মধ্যে এক ভাই ব্যাংকের পরিচালক এবং অন্যজন ব্যবসায়ী। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মাহফুজুর রহমানের মতে এক ভাই পরিচালক হিসেবে অন্যায় করেছেন। অন্যজন ঋণে অনিয়ম করেছেন। ব্যাংকের পরিচালক মাহবুবুল হক চিশতির একক ক্ষমতায় ঋণ দেয়া হয়েছে। কোন ধরনের দাফতরিক প্রক্রিয়া ছাড়াই মাহবুব সাহেব লিখিত নির্দেশে ঋণ দেন। বিষয়টি খুবই উদ্বেগের। কোন পরিচালক, তিনি কোন কমিটির চেয়ারম্যান হলেও ঋণ দেয়ার জন্য লিখিত নির্দেশ দিতে পারেন না। ঋণ প্রক্রিয়া করবে অফিসাররা। কমিটির ক্ষমতা থাকলে ওই কমিটি প্রস্তাব অনুমোদন করবে। বাকি কাজ অফিসারদের। দেখা যাচ্ছে এখানে হচ্ছে ঠিক বিপরীত। এই ঘটনাটির মধ্যেই লুক্কায়িত অন্য একটি বিষয়। আর সেটা হচ্ছে চাকরি ও চাকরিচ্যুতি। পরিচালকদের এ ধরনের অবৈধ কাজে সহায়তাদানকারী কিছু অফিসার থাকে। কেউ এতে সহায়তা না করলেই শাস্তি, চাকরিচ্যুতি। এটিই ঘটছে ব্যাংকিং খাতে। এর সর্বসাম্প্রতিক খবরটি হচ্ছে এনসিসি ব্যাংকের। এর আগেও এ ধরনের খবর কাগজে ছাপা হয়েছে। মনে হচ্ছে এ ধরনের ঘটনা মাত্রার বাইরে চলে গেছে। তা না হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাননীয় গবর্নর ব্যাংকারদের এই বিষয়ে সতর্ক করতেন না। উদ্বেগ প্রকাশ করতেন না। পহেলা মে তারিখের একটি খবরের শিরোনাম হচ্ছে : ‘ব্যাংকগুলো অফিস সময়ের পরেও বিনা কারণে স্টাফদের বসিয়ে রাখে।’ খবরটিতে বলা হয়েছে গবর্নর সাহেব ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সঙ্গে এক সভায় অভিযোগ করে বলেছেন ব্যাংকগুলো অফিস সময়ের পরেও বিনা কারণে স্টাফদের বসিয়ে রাখে, এমনকি মহিলা কর্মীদেরও। তিনি একে অমানবিক আচরণ বলে আখ্যায়িত করেন। ঘটনার এখানেই শেষ নয়। প্রকাশিত খবরটিতে দেখা যায় গবর্নর আরও ঘোরতর কতগুলো অভিযোগ করেছেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক নানা ধরনের অভিযোগ পাচ্ছে। কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জোর করে চাকরিচ্যুত করা হচ্ছে। তাদের বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি আটকে রাখা হচ্ছে। কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের ছাঁটাই করা হচ্ছে, বিদায় করা হচ্ছে। এমনকি তাদের আর্থিক সুবিধাদি প্রাপ্তিতে পর্যন্ত বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে। গবর্নর সাহেব আরও উল্লেখ করেন যে, প্রশাসনিক ব্যবস্থাও যথাযথভাবে নেয়া হচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে তা ইচ্ছামাফিক করা হচ্ছে। ব্যাংকের ‘মানব সম্পদ নীতিতে’ (হিউম্যান রিসোর্স পলিসি) এমন ধারা রাখা হয়েছে যার বলে কারণ না দর্শিয়ে লোকের চাকরি খাওয়া যায়। তিনি অভিমত প্রকাশ করে বলেন, এর ফলে ভাল ভাল অফিসারের চাকরিজীবন অকালে সমাপ্ত হচ্ছে। এতে ব্যাংকিং খাতের উন্নতি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। চাকরি খাওয়ার জন্য ব্যাংকগুলো অযৌক্তিক ‘আমানত টার্গেট’ দেয় অফিসারদের। এতে প্রতিযোগিতার পরিবেশ নষ্ট হয়। ব্যাংকগুলো অযৌক্তিক প্রফিট টার্গেট দেয় কর্মকর্তাদের। প্রধান নির্বাহীরা বোর্ডকে সন্তুষ্ট করার জন্য এসব টার্গেট গ্রহণ করে যা কাম্য নয় বলে অভিমত দেন গবর্নর মহোদয়। মাননীয় গবর্নর ড. আতিউর রহমানকে অসংখ্য ধন্যবাদ। তিনি বিভিন্ন ব্যাংকে কী ঘটছে তার একটা পুঙ্খনাপুঙ্খ বর্ণনা দিয়েছেন। কিভাবে কর্মকর্তাদের ছাঁটাই করা হচ্ছে, চাকরিচ্যুত করা হচ্ছে, পদোন্নতি আটকে রাখা হচ্ছে, বেতন বৃদ্ধি আটকে রাখা হচ্ছে। তার বর্ণনা তিনি দিয়েছেন। নিত্যনৈমিত্তিক এসব ঘটনা আস্তে আস্তে পুরো ব্যাংকিং খাতকে একটা বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ব্যাংকের কোন সম্পদ নেই। তার প্রধান ভিত্তি ‘আমানত’ বা ডিপোজিট। এটা ব্যাংকের দায় বা লায়াবিলিটি। এর বিপরীতেই ‘লোন’ দেয়া হয় যা খাতায় সম্পদ হিসেবে দেখানো হয়। অতএব আসল সম্পদ হচ্ছে ‘কর্মী’। এটাই দীর্ঘদিন যাবত শুনে আসছি। ব্যাংকের মূল সম্পদ ‘কর্মীবাহিনী’ এর অস্বীকৃতিস্বরূপই সকল ব্যাংক ‘প্রশাসন বিভাগের’ নাম বদলে করেছে ‘মানব সম্পদ বিভাগ’। কিন্তু দেখা যাচ্ছে কাজে হচ্ছে ঠিক বিপরীত যার কথা ড. আতিউর তুলে ধরেছেন। তাঁর চাকরির ৬ বছর পূর্তি উপলক্ষে তিনি মানব সম্পদ সম্পর্কে যে বাস্তব অবস্থা তুলে ধরেছেন বস্তুত বিগত এক বছর যাবত আমি আমার এই কলামে তা তুলে ধরেছি। সমস্যা তুলে ধরা এবং সমস্যার স্বীকৃতির পর থাকে সমাধানের কথা। এ বিষয়ে দুটো কথা বলতে চাই। এর আগে ছয় বছর পূর্তি উপলক্ষে গবর্নরকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানাই। গবর্নর সাহেব বলেছেন, ব্যাংকগুলোর ‘মানব সম্পদ নীতিতে’ এমন ধারা আছে যার বলে কারণ না দর্শিয়ে কর্মীদের চাকরিচ্যুত করা যায়। এখানেই কথা। সমস্ত নীতি বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগে যায়। তাদের ওইসব নীতি পড়ার কথা। কোন কিছু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলে, ব্যাংকিং খাতের জন্য ক্ষতিকর হলে তা অনুমোদিত হওয়ার কথা নয় এবং সেই বিষয়গুলো গবর্নর সাহেবের নজরে আনার কথা। আমার ধারণা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগ এই বিষয়টি তার নজরে আনেননি। অথচ এই ধারার ফলে গত দুই-তিন বছরের মধ্যে শত শত কর্মীর বিনা কারণে চাকরি গেছে। গেছে মধ্যবয়সে যখন কর্মীদের ছেলে-মেয়েরা স্কুলে পড়াশোনা করে, যখন তারা জীবনের পরিকল্পনা করা শুরু করে। ইতোমধ্যেই অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেছে। বহু ছেলেকে আমি জানি যারা আজ রাস্তায় এবং তা বিনা কারণে। হয় মালিকানা পরিবর্তনের জন্য, নয় প্রধান নির্বাহী পরিবর্তনের জন্য। এই দুটো ঘটনায় শত শত ব্যাংকারের জীবন তছনছ হচ্ছে। এবার গবর্নর সাহেবের উচিত শক্ত হাতে এসব দমন করা। ঋণ নিয়ন্ত্রণ করা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বড় কাজ। এটি করতে গিয়ে ব্যাংকিং খাতের মানব সম্পদের উন্নয়ন প্রচেষ্টা অবহেলিত থাকবে তা হতে পারে না। ব্যাংকের ‘এমডি’র চাকরি প্রাপ্তি এবং তার পদচ্যুতি বা অপসারণ দুই-ই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদনসাপেক্ষ। নিশ্চয়ই এই নীতির পেছনে কারণ আছে। আমি মনে করি শুধু ‘এমডি’কে রক্ষা করলেই চলবে না, ‘এমডিরা’ যাতে স্বৈরাচারী না হয় তাও দেখতে হবে। মালিকরা যাতে স্বৈরাচারী না হয় তাও নিশ্চিত করতে হবে। মালিকদের গ-গোলে বা তাদের মধ্যে পরিবর্তনের ফলে কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় তাও দেখতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের এই মুহূর্তে দায়িত্ব হচ্ছে তথ্য সংগ্রহ করা, কোন ব্যাংক থেকে কতজন কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে জোরে বিদায় করা হয়েছে তার হিসাব বের করা। সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে শাসিয়ে দেয়া দরকার এক্ষুণি। মানব সম্পদ নীতি যাতে মানবিক হয় তার ব্যবস্থা করা দরকার। কোন আপত্তিকর ধারা থাকলে তা বদল করা দরকার। অযৌক্তিক মুনাফা, আমানত ও ব্যবসার টার্গেট দেয়া বন্ধ করা দরকার। এর ফলে কর্মকর্তারা অবাঞ্ছিত ব্যাংকিং করতে বাধ্য হন। ‘ফ্রড ও ফর্জারি’ এ কারণেও বাড়ছে। মালিকদের মুনাফাপ্রিয়তা রোধ করা দরকার। অতিরিক্ত মুনাফার জন্য শাস্তি দরকার। সর্বোপরি ‘এমডিদের’ কাছ থেকে মানবিক আচরণ নিশ্চিত করা দরকার। মনে রাখা দরকার এটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নয়, এটা বাংলাদেশ। কথায় কথায় চাকরিচ্যুতি এক্ষুণি বন্ধ হোক। যারা করছে তাদের শাস্তি হোক যাতে অন্যরা এ কাজে বিরত হয়। লেখক : সাবেক প্রফেসর বিআইবিএম
×