ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সাগরে তেল গ্যাস অনুসন্ধান কাজ ফের পিছিয়ে গেল

প্রকাশিত: ০৬:০৪, ৭ মে ২০১৫

সাগরে তেল গ্যাস অনুসন্ধান কাজ ফের পিছিয়ে গেল

রশিদ মামুন ॥ মার্কিন কোম্পানি কনকো ফিলিপস তিন ব্লকে কাজ করতে অস্বীকৃতি জানানোতে সমুদ্রে তেল গ্যাস অনুসন্ধান আরও এক দফা পিছিয়ে গেল। এ নিয়ে তিন দফা ব্লক ইজারা পেলেও মার্কিন কোম্পানিটি দুটি ব্লকে আংশিক কাজ করে তা ছেড়ে দেয়। বাকি দুই দফায় চারটি ব্লকে উৎপাদন বণ্টন চুক্তি (পিএসসি) স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানায় তারা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০০৮ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত গত ৮ বছর ধরে সরকার দেশে জ্বালানি সঙ্কট সমাধানে সাগরে তেল গ্যাস অনুসন্ধানের উদ্যোগ নিচ্ছে। এরমধ্যে কয়েক দফায় দরপত্র আহ্বান করা হয়। বহুজাতিক কোম্পানির মধ্যে সাগরে তেল গ্যাস অনুসন্ধানে কনোনো ফিলিপস সবচেয়ে বেশি আগ্রহ দেখিয়েছে। প্রত্যেকবারই কোন না কোনভাবে তারা দরপত্রে অংশ নিয়েছে। সরকার বিভিন্ন সময়ে ছয়টি ব্লক তাদের দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে কনোকোই কোন না কোনভাবে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের তেল গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম ঝুলিয়ে দিচ্ছে। দেশের স্থলভাগে বড় গ্যাস মজুদ পাওয়ার সম্ভাবনা না থাকায় সমুদ্রে তেল গ্যাস অনুসন্ধানের চেষ্টা করা হচ্ছে। প্রতিবেশী মিয়ানমার এবং ভারত তাদের সমুদ্রসীমায় তেল গ্যাস অনুসন্ধানের ব্যাপক উদ্যোগ নিয়েছে। সে দিক থেকে আমরা বেশ পিছিয়ে রয়েছি। এই অবস্থা আরও দীর্ঘস্থায়ী হলে সাগরে তেল গ্যাস অনুসন্ধান দীর্ঘসূত্রিতা থেকে মুক্ত হতে পারবে না। পেট্রোবাংলা সূত্র জানায়, ২০১১ সালের ১৬ জুন সাগরের ১০ ও ১১ নম্বর ব্লকে তেল গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের জন্য কনোকো ফিলিপসের সঙ্গে উৎপাদন বণ্টন চুক্তি (পিএসসি) করে পেট্রোবাংলা। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ২৮০ কিলোমিটার দূরে এ দুটি ব্লকে সমুদ্রের পানির গভীরতা এক থেকে দেড় কিলোমিটার। নতুনভাবে ব্লকগুলোর ড্রয়িং করলে সাত নম্বর ব্লকের কিছু অংশের মধ্যে ১১ নম্বর ব্লক ঢুকে যায়। পরবর্তী সময়ে অগভীর সমুদ্রে সাত নম্বর ব্লকটিও কনোকো ফিলিপসকে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সরকারের অনুমোদনের পর ২০১৩ সালের শেষের দিকে কনোকোকে পিএসসি স্বাক্ষরের আমন্ত্রণ জানায় পেট্রোবাংলা। কিন্তু ২০১৪-এর এপ্রিলে কনোকো আনুষ্ঠানিকভাবে জানায়, তারা ব্লক-৭ এ পিএসসি করবে না। কারণ হিসেবে তারা জানায়, ওই ব্লকে তেল গ্যাস অনুসন্ধানে অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হওয়া যাবে না। গত বছর এপ্রিলে ৭ নম্বর ব্লক ছেড়ে দেয়ার পর একই বছর জুনে এসে কনোকো নতুন অজুহাত দাঁড় করায় ব্লক-১০ এবং ১১ নিয়ে। চুক্তি স্বাক্ষরের তিন বছর পরে এসে তারা জানায়, গ্যাসের দাম না বাড়ালে ১০ এবং ১১ নম্বর ব্লকে তাদের পক্ষে কাজ করা সম্ভব নয়। ওই সময়ে তারা পেট্রোবাংলাকে জানায়, দুটি ব্লকে অনুসন্ধান চালিয়ে ১১ নম্বর ব্লকের একটি অংশে গ্যাস স্তর খুঁজে পেয়েছে তারা। এতে চার ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ) গ্যাসের মজুদ আছে বলে ধারণা দেয় কোম্পানি। তবে এটিকে বাণিজ্যিকভাবে উত্তোলনযোগ্য মনে হয়নি কনোকোর। দ্বিমাত্রিক জরিপে প্রাপ্ত গ্যাস উত্তোলনের সম্ভাবনা মাত্র ২০ শতাংশ বলে প্রতিবেদনে জানিয়েছিল তারা। প্রথমে পেট্রোবাংলা কনোকোর সঙ্গে এখানে বিনিয়োগও করতে চায়। কিন্ত পরবর্তী সময়ে পেট্রোবাংলা তাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে। দাম বৃদ্ধি না করায় সাত নম্বর ব্লকের মতোই ভাগ্য বরণ করে ১০ এবং ১১ নম্বর ব্লক। গত বছর অক্টোবরে এসে পেট্রোবাংলাকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানায়, ব্লক দুটিতে কনোকো আর কাজ করছে না। চুক্তি অনুযায়ী প্রথম পাঁচ বছরকে ম্যান্ডেটরি ওয়ার্ক প্রোগ্রাম এবং বিডেড ওয়ার্ক প্রোগ্রাম শেষ করার কথা ছিল। এরমধ্যে ভূতাত্ত্বিক জরিপ, ভূ-পদার্থিক জরিপ, অন্যান্য জরিপ (গ্র্যাভিটি, ম্যাগনেটিক, জিওকেমিক্যাল সার্ভে ইত্যাদি)। এরপর তাদের দ্বিতীয় ধাপে প্রবেশ করার কথা। তারা প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কাজ শেষ করায় ব্যাংক গ্যারান্টি ফেরতও পায়। দ্বিতীয় ধাপের কাজ শুরু করলে তাদের একটি কূপ খনন করতে হতো। আর এই কূপ খনন করলেই গভীর সমুদ্রের ১০ এবং ১১ নম্বর ব্লকে সত্যিই গ্যাস রয়েছে কি না জানা যেত। কনোকো চলে যাওয়ায় তা আর সম্ভব হয়নি। এরপরও দীর্ঘ দিন আটকে রাখার পর সাগরের ১২, ১৬ এবং ২১ নম্বর ব্লকে তেল গ্যাস অনুসন্ধান কাজের জন্য উৎপাদন অংশীদারী চুক্তি (পিএসসি) করবে না বলে জানিয়েছে। এখন কনোকোর সঙ্গে যৌথভাবে দরপত্রে জমা দেয়া স্টেট ওয়েলকে এককভাবে কাজ করতে দিতে অনুরোধ করছে তারা। সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কনোকোকে প্রস্তাব দিতে বলা হয়েছে। বুধবার পেট্রোবাংলার সংশ্লিষ্ট শাখায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কনোকো এখনও এ বিষয়ে কোন আনুষ্ঠানিক চিঠি পাঠায়নি। সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিষয়ক মন্ত্রী সভার অনুমোদনের পর গত ২৮ মার্চ এই তিন ব্লকে পিএসসি অনুস্বাক্ষরের জন্য কনোকো ফিলিপসকে আমন্ত্রণ জানায় পট্রেবাংলা। কনোকোর একটি প্রতিনিধি দল ২৭ মে ঢাকা সফরে আসে। ওই দিন তারা পেট্রোবাংলা, জ্বালানি সচিব এবং বিদ্যুত জ্বালানি প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে জানায়, তাদের পক্ষে এই ব্লকেগুলোতেও কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না। জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার সাবেক চেয়ারম্যান মোশারফ হোসেন এ প্রসঙ্গে জনকণ্ঠকে বলেন, এখন তেলের দাম কমে যাওয়ায় সারা বিশ্বেই তেল গ্যাস অনুসন্ধানে একটু মন্দাভাব যাচ্ছে। তেল গ্যাস অনুসন্ধানকারী অনেক যন্ত্রাংশ (রিগ) এখন অলস বসে আছে। এখন একটা সুযোগ ছিল আমাদের এই অঞ্চলে কাজ করার জন্য। কিন্তু আমরা তা করাতে পারছি না। তিনি মনে করেন ব্যাবসায়িক কৌশল হিসেবে কোন নির্দিষ্ট অঞ্চল থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে কোন কোন কোম্পানি। অতীতেও দেশে এই ধারা দেখা গেছে। কনোকোর ক্ষেত্রেও এমনটা হয়ে থাকতে পারে। তারা আমাদের এখান থেকে সব বিনিয়োগ প্রত্যাহার করছে। কিন্তু এর বিপরীতে ব্লকগুলো তাদের হাতে থাকায় আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পিএসসি-২০০৮ এ গ্যাসের দাম কম ছিল। কনোকো ফিলিপস-এর অনুরোধেই প্রথমে নির্ধারণ করা পিএসসির খসড়া সংশোধন করে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়। দরপত্র আহ্বান করার সময় দাম ছিল চার দশমিক দুই ডলার কিন্তু পরবর্তীসময়ে পিএসসির সংশোধনী ২০১২তে তা বাড়িয়ে সাড়ে ছয় ডলার নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু কনোকো আরও গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করার তাগিদ দেয়। তারা বার বার উদাহরণ হিসেবে মিয়ানমারকে টেনে আনে। মিয়ানমার সাগরে গ্যাস অনুসন্ধানে বিদেশী কোম্পানিকে সাড়ে আট ডলার দাম দিচ্ছে। কিন্তু ভারত এখন প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাসের দাম আমাদের থেকে আরও এক ডলার কম দিচ্ছে। সরকার নতুন করে এখন আর পিএসসিতে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির চিন্তা করছে না। জ্বালানি সচিব আবু বক্কর সিদ্দিক এ প্রসঙ্গে বলেন, আমাদের পিএসসিতে এখন গ্যাসের দাম ভাল মানের। যে কোন বহুজাতিক কোম্পানি যাতে আকৃষ্ট হবে বলে আমরা মনে করছি। আপাতত পিএসসিতে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির পরিকল্পনা আমাদের নেই। সাগরে জরিপ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। জরিপ শেষ করে নতুন ব্লক ইজারার দরপত্রের সময়ই বিষয়টি আবারও বিবেচনা করা যেতে পারে। মিয়ানমার তাদের উৎপাদিত গ্যাসের বেশিরভাগ রফতানি করে। অন্যদিকে আমরা অভ্যন্তরীণভাবে ব্যবহার করি। কাজেই দেশেল অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনা করেই আমাদের পিএসসিতে গ্যাসের দাম নির্ধারণ করতে হয়।
×