বাস্তবে কোথাও নেই, আছে আওয়াজে। অনেকটা ‘কাজীর গরু কেতাবে থাকা’র প্রবাদের মতোই, আছে কোথাও হয়ত এবং থাকলেও তা না থাকার মতোই। নেই যদিও তার অস্তিত্ব, কিন্তু আছে তার মৌখিক অবস্থান। আর তা আছে কিনা সে নিয়ে সাধারণের নেই কোন আগ্রহ, অনুসন্ধিৎসা কিংবা কৌতূহল। তারা তো জানেই বোমার শব্দ, আগুনের ফুলকি কিভাবে কেড়ে নেয় প্রাণ। হরণ করে বাঁচার সব পথ। ধ্বংস করে সম্পদ, বিপর্যস্ত করে মানবজীবন। কী দারুণ তার লয়ের শক্তিমত্তা। টানা তিন মাস ধরে পেট্রোলবোমার আঘাতে দগ্ধ মানুষের মৃত্যুর সারি, বার্ন ইউনিটে আহাজারি সবই প্রত্যক্ষ করেছে দেশের মানুষ, এদের প্রায় সবাই কোন না কোনভাবে এখন ঘটনায় চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। চার মাস আগে ঘোষিত অবরোধ নামক মানুষ মারার কর্মসূচীটি আজও প্রত্যাহার করা না হলেও বোমা মেরে বাস পোড়ানো, মানুষ হত্যা বন্ধ রয়েছে মাসখানেক ধরে। জনগণ ধরেই নিয়েছে আর বোমাবাজি হবে না, কারণ অবরোধ নেই। কিন্তু অবরোধ ঘোষণাকারিণী সিটি নির্বাচনের ভোটগ্রহণের একদিন আগে সংবাদ সম্মেলনে জানালেন, অবরোধ এখন আর তেমন সক্রিয় নেই, এই মোটামুটি আছে আর কি! কিন্তু তার পারিষদ কেউ কেউ বলেন, দেশে আর কোন অবরোধ নেই। আসলে কী আছে কী নেই তা ‘উহারা’ নিজেরাও জানেন না। এই থাকা না থাকার মাঝখানে হয়ত দাঁড়িয়ে জনগণ সংশয়াচ্ছন্ন এইজন্য যে, অবরোধের অবগুন্ঠন গলিয়ে ঘাতকোচিত অবয়ব ঢেকে বোমাবাজি, নিষ্ঠুরতায় প্রাণহরণ, সম্পদহানির ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেন আবার না ঘটে। কারণ জঙ্গী ও সন্ত্রাসের মদদদাতারা নির্বাচনে পরাজয়ের আশঙ্কায় পিছু হটে বর্জন খেলায় মেতে সুফল পায়নি। তাই নতুন করে সংগঠিত হয়ে নাশকতার নতুন দরজা এবার খুলে দিতে পারে। ধ্বংসাত্মক পথ অবরোধের জানালাটা তাই খোলা রেখেছে, কপাট বন্ধ রাখলেও। গত ৫ জানুয়ারি অবরোধ কর্মসূচী তড়িঘড়ি করে ঘোষণা করেন বিএনপি-জামায়াত জোট নেত্রী। অফিস ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে সাংবাদিকদের উৎসাহ-উদ্দীপনায় উজ্জীবিত হয়ে আচমকাই বলে ফেলেন পরবর্তী ঘোষণা না দেয়া পর্যন্ত অনির্দিষ্টকালের জন্য অবরোধ চলবে। স্পষ্ট করা হয়নি, এই অবরোধ জলে স্থলে, অন্তরীক্ষে চলবে কি-না। এরপরও বলা হয়, কথিত আন্দোলন যৌক্তিক পরিণতিতে না পৌঁছা পর্যন্ত অবরোধ চলবে। সেই পরিণতি হয়ত এসেছে, হয়ত আসেনি। আর তা জানেন তিনিই, যিনি অবরোধ নামক রাজনৈতিক কর্মসূচীর সংজ্ঞাটাই পাল্টে ফেলেছেন। অবরোধ শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, বাধা, প্রতিবন্ধক, আটক, বন্দিত্ব, অন্তঃপুর, পরিবেষ্টন সৃষ্টি, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে যাতায়াতের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে বাধা প্রদান ইত্যাদি। এককথায় অবরোধের সংজ্ঞা হচ্ছে কোন নির্দিষ্ট স্থানে যাতায়াতে সহিংস বাধাদান।
গ্রীক উপাখ্যান ইলিয়াড ও ওডেসিতে ট্রয় অবরোধের কথা রয়েছে। হেলেনের সেই আলোড়িত ও আলোচিত কাহিনী আর কী! একুশ শতকে হেলেন অব ট্রয় না থাক, অবরোধ প্রথা বিদ্যমান রয়ে গেছে। একে রোধ করার যেন নেই কোন প্রক্রিয়া।
আর অবরোধের সংজ্ঞা পাল্টে গেছে একালের হেলেনদের মাধ্যমে। বদলে গেছে পট। পেট্রোলবোমা মেরে মানুষকে হত্যা, বাস পোড়ানোর মাধ্যমে জিঘাংসা চরিতার্থের পাশাপাশি সাধারণের ওপর প্রতিশোধ গ্রহণই হচ্ছে বিএনপি-জামায়াত জোটের অবরোধ পালন। কোথাও কোন নেতাকর্মী নেই, অথচ চোরাগোপ্তা পথে বোমা হামলা চালিয়ে বাস পোড়ানো, মানুষকে দগ্ধ করার কাজে জঙ্গী-সন্ত্রাসীদের লেলিয়ে দেয়া হয়েছে।
রাজপথ, রেলপথ, সচিবালয় অবরোধ কর্মসূচী দেশবাসী আগে পালন করেছে। কিন্তু বোমার অবরোধ ছিলো এই প্রথম। বিষয়টি গিনেসে লেখানোর মত বৈকি। অবরোধ নিয়ে দেশবাসী ভাবে না। ভাবে অবরোধকালে যারা নিহত হয়েছে, সেই হত্যার বিচার হবে কিনা সেটা নিয়ে।
শীর্ষ সংবাদ: