ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

শাহজাহান মিয়া

নির্বাচনটি ইস্যু করা গেলো না

প্রকাশিত: ০৪:২৫, ৭ মে ২০১৫

নির্বাচনটি ইস্যু করা গেলো না

২৮ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ঢাকা উত্তর, দক্ষিণ এবং চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। এই নির্বাচনকে ইস্যু বানানোর চেষ্টা করেছিলেন খালেদা জিয়া। কিন্তু হালে পানি পেলো না। এই নির্বাচন নিয়ে দেশে এখনও আলোচনার ঝড় বইছে। পত্র-পত্রিকায় এখনও লেখালেখি চলছে। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে হচ্ছে প্রাণবন্ত আলোচনা। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচন বর্জন করে শত সহিংসতার ঘটনা ঘটিয়ে তা প্রতিরোধে ব্যর্থ খালেদা জিয়া দলীয়ভাবে না হলেও দলটির সমর্থিত প্রার্থীদের দিয়ে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অংশগ্রহণ দেশের মানুষের মনে কিছুটা হলেও স্বস্তি ফিরে আসতে শুরু করে। এ বছর ৫ জানুয়ারি থেকে তিন মাসাধিককাল ধরে দেশে বাস-ট্রাক ও লঞ্চে পেট্রোলবোমা মারায় উৎসাহিত করে যেভাবে খেটে খাওয়া গরিব-নিরীহ-নিরপরাধ মানুষকে নির্মমভাবে পুড়িয়ে মারা হয়েছে তাতে বিরতি টেনে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি নির্বাচনে আসায় মানুষ দলটির রাজনীতিতে একটা ইতিবাচক ইঙ্গিত লক্ষ্য করে আশান্বিত হয়েছিল। প্রশান্তি পেয়েছিল কারণ, একদল পারিষদ নিয়ে দীর্ঘ তিন মাস নিজে দলীয় অফিসের মধ্যে শুয়ে-বসে কাটিয়েছেন। তার নির্দেশে পরিচালিত আন্দোলনে পেট্রোলবোমা মেরে আগুনে পুড়িয়ে দেড় শ’ সাধারণ মানুষকে হত্যা করা করা হয়েছে। হাজারদেড়েক বাস-ট্রাকসহ বিভিন্ন ধরনের যানবাহন আগুন পোড়ানো হয়েছে, ভাংচুর করা হয়েছে হাজার হাজার গাড়ি। আর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই নিজেকে গুলশানে দলের কার্যালয়ে অবরুদ্ধ রেখে বিএনপি নেত্রী শেষ পর্যন্ত গুলশানের বাসায় ফিরে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘোষণা দেন। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন দলীয়ভাবে না হলেও এটা যে দলের নির্বাচনী প্রতীক ব্যবহার ব্যতীত পুরোপুরি দলীয় ছত্রছায়াই হয়ে থাকে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীদের পক্ষে ঢাকায় নির্বাচনী প্রচারে নেমে তাদের জন্য তিনি উদাত্ত কণ্ঠে ভোটও চেয়েছিলেন। মনে হয়েছিল খুব আগ্রহভরে আন্তরিকভাবেই তিনি কাজটি করছিলেন। কিন্ত আসলে তা যে ছিল সকলি গরল ভেল, তা পরে পানির মতো পরিষ্কার হয়ে যায়। অবশ্য প্রচার অভিযান চালানোর সময় রাজধানীর কয়েকটি স্থানে পেট্রোলবোমায় নিহত ও আহত পরিবারের বিক্ষুব্ধ সদস্যরা তাঁকে কালো পতাকা প্রদর্শন করেছিল। ২৭ এপ্রিল ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি-জামায়াতের ডাকা হরতাল-অবরোধে সহিংস ঘটনায় হতাহতদের স্বজনদের অনেকেই তিন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন প্রার্থীদের ভোট না দেয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। ‘খালেদা জিয়া আমার স্বজনকে কেন পোড়ালেন, জবাব দিন’, ‘খালেদা জিয়া আমার অগ্নিদগ্ধ স্বজনের দোহাই, আমাদের কাছে ভোট চাইবেন না’Ñ লেখা ব্যানার ঝুলিয়ে স্বজনরা এই সংবাদ সম্মেলন করে তাঁদের ক্ষোভ-বিক্ষোভ প্রকাশ করেন। রাজধানী ঢাকার দুটি সিটি কর্পোরেশন (উত্তর ও দক্ষিণ) নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীর পক্ষের অধিকাংশ পোলিং এজেন্ট ২৮ এপ্রিল মঙ্গলবার ভোটকেন্দ্রে আসেননি। স্থানীয় বিএপি নেতারাই তাঁদের পোলিং এজেন্টদের ভোটকেন্দ্রে আসতে বারণ করেছেন বা প্রতিপক্ষের কাছ থেকে টাকা নিয়ে কেন্দ্রে আসেননি। বিএনপির মাঠপর্যায়ের নেতারাও নির্বাচন বর্জনের আগাম পরিকল্পনার বিষয়টি জানতে পেরে এজেন্টরা পরিকল্পিতভাবে ভোটকেন্দ্রে না গিয়ে অভিযোগ করেন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। অথচ বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, পোলিং এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। অথচ অত্যন্ত হাস্যকরভাবে বিএনপি নেতৃত্ব ভোটকেন্দ্রে তাদের এজেন্টদের ঢুকতে না দেয়া এবং কারসাজির অভিযোগ তুলে নির্বাচন বর্জন ও প্রত্যাখ্যানের ঘোষণা দেয়। ভোট চুরি, জাল ভোট প্রদান, আগের রাতেই ভোট দেয়া ও ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের অভিযোগও তোলা হয়। ২৮ এপ্রিল সকাল ৮টায় ভোটগ্রহণ শুরুর অনেক আগেই রাজধানী ঢাকার দুটি ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন কেন্দ্রে ভোট প্রদানের জন্য ভোটারদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে পুরুষ ও মহিলা ভোটাররা তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য সুশৃঙ্খলভাবে লাইনে দাঁড়িয়ে যান। সে সুন্দর দৃশ্য টেলিভিশনের বিভিন্ন চ্যানেলে দর্শকরা প্রত্যক্ষ করেছেন। কিন্তু হঠাৎ কোথা দিয়ে কি হয়ে গেল, ভোট শুরু হওয়ার ঘণ্টাচারেকের মধ্যেই বিএনপি ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে প্রায় সব কেন্দ্র দখল ও কারচুপির অভিযোগে তিন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয়। ২৮ তারিখ মঙ্গলবার দুপুর সোয়া ১২টায় নয়াপল্টনের বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ এবং চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন। মওদুদ আহমদ বলেন, ‘সরকারী দলের সমর্থকরা অধিকাংশ কেন্দ্র থেকেই আমাদের এজেন্টদের বের করে দিয়েছে। এরপর তারা নিজেরাই নিজেদের ভোট দিয়েছে। এ অবস্থায় আমরা নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করলাম, নির্বাচন বর্জন করলাম।’ সংবাদ সম্মেলনে দলীয় মেয়র, কাউন্সিলর প্রার্থীদের ভোটকেন্দ্র থেকে সরে আসারও ঘোষণা দেন মওদুদ আহমদ। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা উত্তরের মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়াল ও দক্ষিণের মেয়র প্রার্থী মির্জা আব্বাসের স্ত্রী আফরোজা আব্বাস। অবশ্য এর আগে বেলা সোয়া ১১টায় চট্টগ্রাম মহানগরীর দেওয়ানহাট উন্নয়ন আন্দোলনের নির্বাচনী কার্যালয়ে বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থী মনজুর আলম নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, তিনি রাজনীতি থেকেও অবসর নেয়ার ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, ‘আমি আর রাজনীতি করব না। সমাজসেবা নিয়েই ব্যস্ত থাকব।’ সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো- সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির সিনিয়র নেতা মওদুদ আহমদ তাদের মুখ দিয়ে লাখবার উচ্চারিত একটি মুখস্থ বুলি আওড়েছেন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচন বর্জন করে তারা বলেছিল নির্বাচনটিতে মাত্র ৫ ভাগ ভোটার ভোট দিয়েছিল। অথচ বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বে ২০ দলীয় জোটের বর্জন সত্ত্বেও ওই নির্বাচনে কমপক্ষে ৪০ ভাগ ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছিল। তিন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন সম্পর্কেও তারা একই মন্তব্য করতে ভুল করেননি। লাজ-শরমের মাথা খেয়ে মওদুদ আহমদ বলেছেন, এবারের সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনেও নাকি মাত্র ৫ শতাংশ ভোট পড়েছে। চট্টগ্রামে বেলা ১১টার দিকে এবং ঢাকায় দুপুর ১২টার দিকে বিএনপি নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিলেও আওয়ামী লীগ সমর্থিত তিন সিটিতে তিন মেয়র প্রার্থীর পাওয়া প্রায় ১৩ লাখ ভোটের বিপরীতে বিএনপির তিন মেয়র প্রার্থী আট লক্ষাধিক ভোট পেয়েছেন। এই লাখ লাখ ভোট কি হাওয়া থেকে পাওয়া? নাকি আকাশ থেকে পাওয়া! হঠাৎ অপ্রত্যাশিতভাবে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয়ায় বিএনপির ভোটাররা নিশ্চয়ই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বুঝে উঠতে পারেননি। আর তাই সকালের মতো বিকেলে ওই দলটির সমর্থকরা হয়ত বিপুল সংখ্যায় ভোট দিতে যায়নি। তা না হলে বিএনপি প্রার্থীদের প্রাপ্ত ভোটের পরিমাণ আরও বেড়ে যেতে পারত। এটা বলাই বাহুল্য এবং দু-একটি জায়গায় হয়ত অঘটন ঘটে যাওয়া অমূলক ছিল না। যেমন বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীদের মধ্যে চট্টগ্রামের মেয়র প্রার্থী মনজুর আলম পেয়েছেন সর্বাধিক তিন লাখ দুই হাজার সাত শ’ সতেরো ভোট। বিএনপির কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতৃত্বের সিদ্ধান্ত, কর্মকা- ও তার প্রতি বৈরী আচরণে নাখোশ মনজুর আলম ঢাকা থেকে নির্বাচন বর্জনের এক ঘণ্টা আগেই নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন। তারপরও তিনি তিন লক্ষাধিক ভোট পেয়েছেন। তিনটি সিটি কর্পোরেশনে বিএনপির নির্বাচন বয়কট করার সিদ্ধান্ত ছিল সম্পূর্ণভাবে পূর্বপরিকল্পিত। সুচিন্তিভাবে প্রণীত একটি গভীর নীলনক্সারই অংশ মাত্র। নির্বাচনের দিন রাতে এ বিষয়ে দুটি টেলিভিশন চ্যানেলে ইন্টারনেট থেকে পাওয়া একটি টেলিফোনের আলাপচারিতার অডিও শোনানো হয়। সেখানে বিএনপির একজন তৃণমূল নেতাকে দলের একজন শীর্ষনেতাকে বলতে শোনা গেছে, ‘স্যার, আমরা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি নির্বাচনের দিন সকাল ১১টায় আমরা বয়কট করব। এটা না করে নির্বাচনের আগের দিন বয়কট করার ঘোষণা দিলে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিজেরা নিজেরাই মারামারি করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে নির্বাচন বানচাল করত। দলটির তৃণমূলের এক নেতার সঙ্গে দলের শীর্ষপর্যায়ের এক নেতা নজরুল ইসলাম খানের কথোপকথনেই পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, নির্বাচন বর্জন কত গভীর ষড়যন্ত্রের ফসল ছিল। বিএনপির আরেক শীর্ষ ও সিনিয়র নেতা সংবাদ সম্মেলন করে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন বর্জনের ঘোষণাদানকারী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ও বিএনপি চেয়ারপার্সনের বিশেষ সহকারী শিমুল বিশ্বাসের মধ্যে অনুষ্ঠিত ফাঁস হওয়া ফোনালাপের অডিও রেকর্ড থেকেও নির্বাচন নিয়ে দলটির তামাশা খেলা দিবালোকের ন্যায় পরিষ্কার হয়ে গেছে। বিষয়টি বিশেষভাবে স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নির্দেশেই দলটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন বয়কট করেছে। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে দলটির এই ষড়যন্ত্রের শিকড় অনেক গভীরে প্রোথিত। সাধারণ মানুষের সে কথা বোঝার কোন উপায় নেই। ষড়যন্ত্রের সম্রাজ্ঞীর এই খেলা তার সুদূরপ্রসারী চিন্তারই ফসল। অপরিণামদর্শী এই চিন্তার চূড়ান্ত পরিণতি কী ঘটে সে বিষয়টি বিবেচনায় না নিয়েই বিএনপি নেত্রীর এই খেলা। কারণ, তড়িঘড়ি করে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণাটিকে ভালভাবে দেখেননি পর্যবেক্ষক মহল ও ঢাকায় অবস্থিত কূটনীতিকরা। বরং তাঁরা সমালোচনা করেছেন। দলের নেতা-কর্মী-সমর্থকরাও এ ধরনের আত্মঘাতী সিদ্ধান্তে নাখোশ হয়েছেন। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া এবং তাঁর আস্থাভাজন কিছু নেতা-নেত্রী এ সবকিছুর কোন তোয়াক্কা না করেই তাঁরা তাঁদের সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল একটাই যে, মিথ্যাচার বা নাটক করে হলেও আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে কোন সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়, যে করেই হোক তাঁদের সে বক্তব্যটিকে প্রমাণ করা। এই অজুহাতে জোরদার আন্দোলন করে ক্ষমতাসীন সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাধ্য করা। বেগম জিয়া অনেক স্বপ্ন দেখলেও এটা যে দিবাস্বপ্নের মতোই উবে যাবে তা বোধ হয় তিনি বুঝে উঠতে পারেননি। লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক
×