ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

হতভাগ্যদের বিরাট অংশ বাংলাদেশী ও রোহিঙ্গা

থাইল্যান্ডে গণকবর আদম পাচার রুটের শেষ আবিষ্কার

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ৬ মে ২০১৫

থাইল্যান্ডে গণকবর আদম পাচার রুটের শেষ আবিষ্কার

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ সমুদ্র পথে দেশ থেকে মানব পাচার, থাইল্যান্ডে বন্দীশিবির, মালয়েশিয়ার কারাগারে জেল জীবন এবং নৌযানযোগে যাত্রাকালে বিভিন্ন কারণে নিমজ্জিত হয়ে হত দরিদ্র মানুষের মৃত্যুর অসংখ্য ঘটনার পর এবার আবিষ্কৃত হয়েছে থাইল্যান্ডের উপকূলবর্তী জঙ্গলে গণকবর। বিদেশী গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী মঙ্গলবার পর্যন্ত পনেরোটি গণকবরের সন্ধান মিলেছে। এসব গণকবর থেকে থাই পুলিশ একে একে উদ্ধার করেছে নরকঙ্কাল ও গলিত লাশ। বিদেশী গণমাধ্যমের খবরে আরও জানানো হয়েছে, এক নয়, দুই নয় প্রায় ৫শ’ বন্দীশিবির রয়েছে থাই উপকূলের গভীর জঙ্গলে। থাই সরকারের নির্দেশে এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ব্যাপক তল্লাশি শুরু করা হয়েছে। ইতোমধ্যে সে দেশের চারজন অভিযুক্ত পাচারকারীকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। কিন্তু দেশের চট্টগ্রাম থেকে সেন্টমার্টিন পর্যন্ত উপকূলীয় অঞ্চল দিয়ে দীর্ঘ সময় জুড়ে প্রতিনিয়ত মালয়েশিয়ায় আদম পাচারের যে ঘটনা ঘটে চলেছে এবং উদ্ধার হয়েছে শত শত বাংলাদেশী হতদরিদ্র মানুষ তাদের অজানা এ গন্তব্যে নেয়ার নেপথ্যের নায়কদের কাউকে এ পর্যন্ত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের নজির নেই। অথচ গণমাধ্যমগুলোতে এসব ঘটনা নিয়ে অসংখ্য প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, গডফাদার এবং তাদের নিয়োগকৃত দালালদের তালিকাও প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এদের কেউ কেউ গ্রেফতার হলেও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার একশ্রেণীর দুর্নীতিবাজ সদস্যের সহযোগিতায় আইনী ফাঁকফোকরে পার পেয়ে গেছে। সম্প্রতি থাইল্যান্ডের জঙ্গলে অভিবাসীদের গণকবরের সন্ধান লাভের ঘটনা বিশ্ব মিডিয়ায় ফলাও প্রচার হওয়ার পর সর্বত্র হৈ চৈ পড়ে গেছে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে যারা এ পথে পাড়ি দিয়ে নিখোঁজ রয়েছে তাদের পরিবারে চলছে কান্নার রোল। কিন্তু এর শেষ কোথায় তা কারও জানা নেই। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত এবং মানবপাচারসহ চোরাচালানের ঘটনা নিয়ে তদন্তে নিয়োজিতদের বিভিন্ন সূত্রে জানানো হয়েছে, থাইল্যান্ডে বন্দীশিবির এবং আবিষ্কৃত গণকবরে যাদের ঠিকানা হয়েছে এদের অধিকাংশ বাংলাদেশী এবং মিয়ানমারের রোহিঙ্গা। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে নিপীড়ন নির্যাতনে টিকতে না পেরে এরা কয়েক দশক আগে থেকে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে দলে দলে বাংলাদেশে যে আসা শুরু করেছে তা এখনও অব্যাহত রয়েছে। তবে বিজিবি, কোস্টগার্ড এবং পুলিশের কড়া নজরদারির কারণে সম্প্রতি এতে কিছুটা ভাটা পড়েছে। কিন্তু ভাটা পড়েনি সমুদ্রপথে স্বপ্নের দেশ মালয়েশিয়া যাত্রার আগ্রহ। এখনও প্রতিনিয়ত সেন্টমার্টিন, উখিয়া, টেকনাফ, কক্সবাজার, বাঁশখালি, কুতুবদিয়া, চট্টগ্রাম, সীতাকু- উপকূলজুড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সদস্যদের চোখ ফাঁকি দিয়ে ইঞ্জিনচালিত নৌকাযোগে দেশের বিভিন্ন এলাকার লোকজন অজানার উদ্দেশে পাড়ি জমাচ্ছে। মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার এবং বাংলাদেশÑ এ চারদেশীয় মানব পাচারকারী শক্তিশালী সিন্ডিকেট আদম পাচারের এ ঘটনায় জড়িত থেকে হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবন নিয়ে যে খেলা খেলে চলেছে এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া একমাত্র উপায় হচ্ছে দেশীয় গডফাদার ও দালালদের বিরুদ্ধে দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। প্রসঙ্গত, উখিয়া, টেকনাফ এবং কক্সবাজারের সংঘবদ্ধ পাচারকারী দলের গডফাদারদের মূল ব্যবসা এখন মালয়েশিয়ায় আদম পাচার। বিভিন্ন সূত্রে জানানো হয়েছে, আগে জনপ্রতি ২০ হাজার টাকা দিয়ে মালয়েশিয়াগামীদের ইঞ্জিন নৌকায় তুলে দেয়া হতো। সেখান থেকে সেন্টমার্টিনের অদূরে বাংলাদেশী জলসীমায় অপেক্ষমাণ বড় ট্রলারে তাদের তুলে নেয়া হতো। সেখান থেকে নেয়া হতো থাইল্যান্ডে। থাইল্যান্ডের জঙ্গলে বন্দীশিবিরে তাদের রেখে নির্ধারিত মুক্তিপণ আদায়ের মাধ্যমে এক এক করে ছাড়া হতো। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে দেশে আত্মীয়স্বজনদের কাছে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করে গডফাদার ও দালালদের নির্ধারিত সদস্যদের কাছে মুক্তিপণ পৌঁছে দিত তাদের মালয়েশিয়া সীমান্তে পৌঁছে দেয়া হতো। আর যারা এতে ব্যর্থ হয়েছে দিনের পর দিন অনাহারে অর্ধাহারে রেখে এবং নির্যাতনে তাদের শেষ পর্যন্ত মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে হয়েছে। এভাবে যারা মরেছে এদেরই গণকবর এখন আবিষ্কৃত হচ্ছে থাইল্যান্ডের উপকূলীয় জঙ্গল এলাকায়। নিশ্চিতভাবে বলা হচ্ছে, গণকবরের সংখ্যা আরও বাড়বে। কারণ সমুদ্র পথে শত নয়, হাজার নয় লখো মানুষের যাত্রা হয়েছে। এদের কি পরিমাণ স্বপ্নের দেশ মালয়েশিয়ায় পৌঁছেছে তার হিসাব যেমন নেই, তেমনি নির্যাতনে মৃত্যুবরণ করেছে এবং বন্দীশিবির ও সরকারী জেলখানায় রয়েছে তার হিসাবও নেই। একেবারে হতদরিদ্র এসব জনগোষ্ঠীর লোকজন বিদেশে গিয়ে বাড়তি রোজগার করে নিজেদের এবং পরিবারের সদস্যদের সচ্ছল করার লক্ষ্যে এই দুর্গম পথের অভিযাত্রী হচ্ছে প্রতিনিয়ত। দেশের বিভিন্ন জেলায় হাজার হাজার দালাল নিয়োগ করে গড়ফাদাররা মুক্তিপণ আদায়ের যে অপখেলায় লিপ্ত হয়েছে এদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তির বিধান করা না গেলে দুর্গম ও নিশ্চিত মৃত্যুর এ অভিযাত্রা থামবে কিনা তা বড় ধরনের প্রশ্নবোধক হয়ে আছে। গণমাধ্যমসহ সরকারী বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার তালিকায় দেশীয় গড়ফাদারদের নাম রয়েছে। এরমধ্যে টেকনাফ, উখিয়া ও কক্সবাজারের লোকজনের নাম বেশি। আর অভিযাত্রীদের মধ্যে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নাগরিকের সংখ্যাই বেশি। বাংলাদেশে যখন থেকে রোহিঙ্গা নাগরিকদের শরণার্থী হয়ে আসার ঘটনার জন্ম হয় এরপর থেকে এদের বড় একটি অংশ চলে গেছে সৌদি আরবে। মিয়ানমারে নির্যাতিত নাগরিক হিসেবে সৌদি সরকার রোহিঙ্গাদের স্থায়ীভাবে সে দেশে বসবাসের সুযোগ করে দেয়ার পর তারা সেদেশের পরিবেশকে কলুষিত করার ঘটনায় এখন আর এ ধরনের রোহিঙ্গাদের স্থান দেয়া হচ্ছে না। এরপরও রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের পাসপোর্ট বানিয়ে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমানো অব্যাহত রেখেছে। থাইল্যান্ডের জঙ্গলে গণকবর এবং বন্দীশিবিরের ঘটনা বের হয়ে আসার পর কক্সবাজার-টেকনাফের বিভিন্ন সূত্রে দাবি করা হচ্ছে, এসব অভিবাসীর অধিকাংশ বাংলাদেশের এবং এরমধ্যে রোহিঙ্গাদের আধিক্য রয়েছে। মালয়েশিয়ায় সমুদ্রপথে মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত দালাল এবং এদের গডফাদাররা চিহ্নিত এবং প্রভাবশালী। আবার কেউ কেউ সরকারদলীয়। যে কারণে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা এদের সহজে আইনের আওতায় আনতে ব্যর্থ হচ্ছে বলে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। এসব গডফাদার দেশের বিভিন্ন এলাকার দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সদস্যদের বিনা অর্থে মালয়েশিয়ায় যাত্রার লোভে ফেলে তাদের চট্টগ্রাম, কক্সবাজারসহ বিভিন্ন পয়েন্টে জড়ো করে প্রতিনিয়ত তুলে দিচ্ছে ইঞ্জিনচালিত নৌকায়। এ যাত্রায় মালয়েশিয়ায় পৌঁছানোর হার খুব বেশি নয়। এছাড়া মিয়ানমার থেকে সমুদ্রপথে বাংলাদেশী সীমানার জলসীমায় এনেও অপেক্ষমাণ বড় ট্রলারে তুলে দেয়ার অসংখ্য ঘটনা রয়েছে। এদের প্রথমে থাই উপকূলে নামানো হয়। এরপরে তাদের জীবন চলে যায় অনিশ্চিত এক জগতে। যেখানে শুধু মৃত্যুর হাতছানি। এ পথে কেউ পালিয়ে বা মুক্তিপণ দিয়ে শেষ রক্ষা পেয়ে পুনরায় দেশে ফিরে আসে অবর্ণনীয় দুঃখ দুর্দশা অতিক্রম করে। আবার কেউ কেউ মালয়েশিয়ায় গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে চলে যায় জেল জুলুমে। আবার কেউ কেউ সে দেশের পুলিশ ও দালালকে অর্থ দিয়ে হাত করে অবৈধভাবে থেকে শারীরিক পরিশ্রমের বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত হয়। কিন্তু এ অবস্থা আর কতদিন চলবে এবং এর শেষ কোথায় এ নিয়ে নানা প্রশ্ন ও জিজ্ঞাসার শেষ নেই। তবুও অনিশ্চিত এ যাত্রা থেমে নেই। কেউ মরছে নৌযান ডুবে, কেউ মরছে থাইল্যান্ডের বন্দীশিবিরে। আর কেউ মরছে অমানবিক নির্যাতনে এবং অনাহারে অর্ধাহারে। সরকারী বেসরকারী সূত্রগুলো অভিন্ন সুরে বলছে, টেকনাফ, কক্সবাজার অঞ্চলের গডফাদারদের দমন করা না গেলে এর পরিণতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা বলা মুশকিল।
×