ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সমাবেশের প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে জেলা নেতাদের

নেতাকর্মীদের মনোবল চাঙ্গা করতে জেলা সফরে যাবেন খালেদা

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ৬ মে ২০১৫

নেতাকর্মীদের মনোবল চাঙ্গা করতে জেলা সফরে যাবেন খালেদা

শরীফুল ইসলাম ॥ তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মনোবল চাঙ্গা করতে সত্বর সারাদেশের বিভিন্ন জেলা সফরে যাবেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। ইতোমধ্যেই কেন্দ্র থেকে বিভিন্ন জেলা নেতাদের এ তথ্য জানিয়ে নিজ নিজ এলাকায় সমাবেশ আয়োজন করার প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে। টানা ৩ মাসের আন্দোলন কর্মসূচী ব্যর্থ হওয়া এবং এ আন্দোলনে বিএনপির প্রতি সাধারণ মানুষের নেতিবাচক ধারণা প্রকট হয়। এ পরিস্থিতিতে বিএনপির সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের মনোবল ভেঙ্গে পড়ে। বিশেষ করে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা হতাশ হয়ে দল বিমুখ হয়ে পড়ে। তবে ৩ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিএনপি সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের মনোবল চাঙ্গা করার চেষ্টা করলেও নির্বাচন শুরুর সোয়া ৪ ঘণ্টা পর বর্জনের কারণে বিভিন্ন মহল থেকে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়তে হয় দলটিকে। দলের নেতাকর্মীদেরও হতাশার পাশাপাশি মনোবল ভেঙ্গে পড়ে। এ অবস্থার অবসানে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া চট্টগ্রাম, রাজশাহী, বগুড়া, সিলেট, খুলনা ও যশোরসহ বিভিন্ন জেলা সফরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বিএনপির নেতৃত্বে ২০ দলীয় জোটের ডাকে ৬ জানুয়ারি থেকে টানা ৯২ দিনের অবরোধ ও দফায় দফায় হরতালের কারণে সারাদেশে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। বিশেষ করে পেট্রোলবোমার আঘাতে শতাধিক মানুষ মারা যাওয়া এবং আরও শতাধিক মানুষ আগুনে দ্বগ্ধ হয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হওয়ার মতো নেতিবাচক দিকগুলো এখনও দেশের মানুষ মেনে নিতে পারেনি। আন্দোলনের কথা মনে হলেই মানুষ এখন বিএনপির বিরুদ্ধে এই ধ্বংসাত্মক কর্মকা-ের অভিযোগ উত্থাপন করে। তাই সিটি নির্বাচন বর্জনের পর বিএনপি আর আন্দোলনে যাওয়ার সাহস দেখাচ্ছে না। তবে আপাতত আন্দোলনে না গিয়ে তৃণমূল পর্যায়ে দলের নেতাকর্মীদের মনোবল চাঙ্গা করতে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া জেলায় জেলায় গিয়ে সমাবেশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে জানা গেছে। এদিকে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার জেলা সফরের খবর শুনে স্থানীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে চিন্তা বেড়ে গেছে বলে জানা গেছে। একদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গ্রেফতার-নির্যাতন ও অপরদিকে জনসভা সফল করতে আর্থিক খরচের কথা বিবেচনায় নিয়েই তাদের মধ্যে চিন্তা বেশি বেড়ে গেছে বলে জানা গেছে। সূত্র মতে, একটি জেলা সফর কর্মসূচী সফল করতে কমপক্ষে ৫০ হাজার লোক জড়ো করতে হয়। সেইসঙ্গে খালেদা জিয়াসহ জনসভায় আগত সকল নেতাকর্মীদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করতে হয় জেলা পর্যায়ের নেতাকর্মীদেরই। এতে কমপক্ষে ২ কোটি টাকা খরচ হয়। আর তা করতে না পারলে দলীয় হাইকমান্ডের তিরস্কারের পাত্র হতে হয় জেলা পর্যায়ের নেতাদের। কিন্তু বর্তমানে রাজনৈতিকভাবে বেকায়দায় থাকায় স্থানীয় পর্যায়ের নেতাকর্মীদের জড়ো করা ও জনসভার সার্বিক প্রস্তুতির জন্য আর্থিক জোগান দিতে জেলা নেতাদের জন্য সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে জানা গেছে। তবুও কয়েকটি জেলা থেকে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া গেছে। তারা খালেদা জিয়ার জেলা সফর কর্মসূচীকে কেন্দ্র করে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি শুরু করেছেন বলে জানা গেছে। উল্লেখ্য, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এক বছর পূর্তিকে সামনে রেখে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া সারাদেশের বিভিন্ন জেলায় জনসভা করে সরকারবিরোধী আন্দোলনের যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। এরপর এ বছর ৫ জানুয়ারি রাজধানী ঢাকায় বড় ধরনের সমাবেশ করে সরকারবিরোধী আন্দোলন চাঙ্গা করার প্রস্তুতি নেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। ২০ দলীয় জোটের ব্যানারে এ কর্মসূচী সফল করতে দুইদিন আগে অর্থাৎ ৩ জানুয়ারি রাতেই তিনি গুলশান কার্যালয়ে অবস্থান নেন। এখানে থেকেই তিনি ২০ দলীয় জোটের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে থাকেন। এর আগে থেকেই বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী নয়া পল্টন বিএনপি কেন্দ্রীয় অবস্থান করতে থাকেন। ৩ জানুয়ারি রাত ১১টার দিকে গুলশান কার্যালয়ে অবস্থানকালে খালেদা জিয়ার জানতে পারেন নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অবস্থানরত রুহুল কবির রিজভী অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তখন খালেদা জিয়া রিজভীকে দেখতে গুলশান কার্যালয় যেতে চান। কিন্তু খালেদা জিয়া ৫ জানুয়ারির কর্মসূচীকে সামনে রেখে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে থেকে যাবেন এমন আভাস পেয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ের বাইরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করে এবং তাকে সেখান থেকে বের হওয়ার বিষয়ে বাধা দেয়। সেই রাতেই রিজভীকে রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় এ্যাপোলো হাসপাতালে ভর্তি করে বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে দেয়া হয়। পরদিন ৪ জানুয়ারি খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ের সামনের রাস্তায় দুইপাশে ব্যারিকেড দিয়ে র‌্যাব-পুলিশের বিপুলসংখ্যক সদস্য সেখানে অবস্থান করে। এক পর্যায়ে খালেদা জিয়ার কার্যালয় সংলগ্ন ৮৬ নম্বর সড়কের দুইপাশে আড়াআড়িভাবে ইট, বালি ও মাটিভর্তি ট্রাক, প্রিজন ভ্যান, সাঁজোয়া যান ও জলকামানসহ অবরুদ্ধ করা হয়। ৫ জানুয়ারি দুপুরে খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ের গেটে তালা ঝুলিয়ে দেয়া হয়। বিকেলে গুলশান কার্যালয় থেকে বের হয়ে নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন তিনি। গাড়িতে চড়ে বসলেও পুলিশ গেট খুলে না দেয়ায় গুলশান কার্যালয়ে থাকা মহিলা দলের নেতাকর্মীরা গেটে লাথি মেরে চিৎকার চেঁচামেচি করতে থাকে। এক পর্যায়ে পুলিশ তাদের ওপর পিপার স্প্রে ছুড়ে মারে। পরে খালেদা জিয়া গাড়ি থেকে নেমে গুলশান কার্যালয়ের ভেতরে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ২০ দলীয় জোটের পক্ষ থেকে সারাদেশে টানা অবরোধ কর্মসূচী পালনের ঘোষণা দেন। কিন্তু দীর্ঘ ৩ মাস ধরে এ কর্মসূচী চলাকালে বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মীরা মাঠে না নামলেও বিচ্ছিন্নভাবে রাজপথে নেমে পেট্রোলবোমাসহ চলন্ত যানবাহনে ঝটিকা হামলা চালানো হয়। এতে সারাদেশে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেও বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া সারাদেশের বেশ ক’টি জেলায় জনসভা করে সরকারবিরোধী আন্দোলন জোরদার করার জন্য জনমত তৈরি করেন। ২০১৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর মার্চ ফল ডেমোক্র্যাসি কর্মসূচী ঘোষণা করে সারাদেশ থেকে বিএনপি জোটের নেতাকর্মীদের রাজধানীতে এসে জড়ো হওয়ার ডাক দেন খালেদা জিয়া। তার ডাকে সাড়া দিয়ে ক’দিন আগে থেকেই সারাদেশ থেকে ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মীরা ঢাকায় আসার চেষ্টা করেন। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাধার কারণে ঢাকা আসতে না পেরে তারা নিজ নিজ জেলায় প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। কিন্তু রাজধানীতে অবস্থান করা বিএনপির সিনিয়র নেতারা আত্মগোপনে চলে যাওয়ায় দলের কোন স্তরের নেতাকর্মীরা ২৯ ডিসেম্বর রাজপথে নামার সাহস দেখাননি। তবে ওইদিন বিকেলে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া তার গুলশানের বাসা থেকে বের হতে চাইলেও পুলিশী বাধায় তিনি বাসা থেকে বের হতে পারেননি। এ কারণে মার্চ ফর ডেমোক্র্যাসি কর্মসূচী ব্যর্থ হয়। মার্চ ফর ডেমোক্র্যাসি কর্মসূচী ব্যর্থ হওয়ার পর বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া সারাদেশে ভোটকেন্দ্রভিত্তিক সংগ্রাম কমিটি গঠন করে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দেন। তার ঘোষণার সাড়া দিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা পর্যায়ের নেতাকর্মীরা নির্বাচনকে বাধাগস্ত করার ব্যাপক চেষ্টা করলেও রাজধানীতে বিএনপির পক্ষ থেকে নির্বাচন ঠেকানোর কোন চেষ্টাই পরিলক্ষিত হয়নি। এ কারণে কেন্দ্রীয় নেতাদের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে সারাদেশের জেলা-উপজেলা পর্যায়ের নেতাকর্মীরা দলীয় কার্যক্রমে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। তবে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এক বছর পূর্তিকে সামনে রেখে আবার খালেদা জিয়া জেলা সফর কর্মসূচীর মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সক্রিয় করেন। এর ফলে ৬ জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া ৩ মাসব্যাপী আন্দোলনে ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলায় তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা সক্রিয় ছিল। তবে ঢাকায় অবস্থান করা কেন্দ্রীয় নেতাদের ব্যর্থতার কারণে সে আন্দোলনে সফল হতে পারেনি বিএনপি। এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া আন্দোলন শুরুর আগেও বিভিন্ন জেলা সফরে গিয়েছেন, আবারও যাবেন। জেলা সফর কর্মসূচীর মাধ্যমে তিনি তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সাংগঠনিক বিষয় ছাড়াও পরবর্তী আন্দোলন কর্মসূচীর বিষয়ে জনমত তৈরি করবেন। এতে একদিকে তৃণমূল পর্যায়ে সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধি পাবে এবং অন্য দিকে নেতাকর্মীদের মনোবল চাঙ্গা হবে।
×