ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নাশকতায় জড়িত ৫শ’ জামায়াতপন্থী শিক্ষক নিয়মিত বেতন নিচ্ছেন

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ৫ মে ২০১৫

নাশকতায় জড়িত ৫শ’ জামায়াতপন্থী শিক্ষক নিয়মিত বেতন নিচ্ছেন

বিভাষ বাড়ৈ ॥ শিক্ষা মন্ত্রণালয়, অধিদফতর ও বোর্ডের নমনীয়তার সুযোগে সারাদেশে গত এক বছরের নাশকতায় জড়িত প্রায় পাঁচ শ’ জামায়াতপন্থী শিক্ষক প্রতিষ্ঠানে অনুপস্থিত থেকেও বেতন-ভাতা তুলে নিচ্ছেন, এর মধ্যে তিন শ’র বেশি শিক্ষক মাদ্রাসার; বাকিরা বেসরকারী স্কুল ও কলেজের শিক্ষক। এক বছরের মধ্যে হলেও বেশিরভারই গেল তিন মাসের নাশকতার মামলার আসামি। শিক্ষকদের অধিকাংশ রংপুর, গাইবান্ধা, দিনাজপুর, জয়পুরহাটসহ উত্তরাঞ্চলের। পুলিশের খাতায় পলাতক হলেও এরা শিক্ষক হিসেবে বেতন-ভাতা তুলছেন। রংপুর বিভাগের বিভিন্ন জেলায় নাশকতার মামলায় পুলিশের খাতায় পলাতক হয়ে সবচেয়ে বেশি শিক্ষক সরকারী বেতন-ভাতা তুলছেন। গাইবান্ধার পলাশবাড়ি, সাদুল্যাপুর ও সদর উপজেলার ১৬টি মাদ্রাসা ও স্কুলের শিক্ষক দায়িত্ব পালন না করেও গোপনে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর দিয়ে তুলছেন বেতন-ভাতা। এদিকে উদ্বেগজনক এ পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট এলাকার জনগণ ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা অধিদফতর মাদ্রাসা বোর্ড ও শিক্ষাবোর্ডকে বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে। মাদ্রাসা বোর্ডকে চিঠি দিয়ে এসব বিষয়ে সতর্ক করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থাও প্রায় ৪শ’ শিক্ষকের তালিকা করে (যারা নাশকতায় জড়িত) মাদ্রাসা বোর্ডে পাঠিয়েছে। কিন্তু অধিদফতর ও বোর্ড এখন পর্যন্ত কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেয়নি। যদিও মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ফাহিমা খাতুন বলেছেন, আমরা উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারদের চিঠি দেব কারা কারা অনুপস্থিত থেকে বেতন-ভাতা নিচ্ছেন, তা জানাতে। যদি বোমা হামলা, বিস্ফোরক মামলার আসামি হয়ে প্রতিষ্ঠানে অনুপস্থিত থাকার পরও কেউ বেতন-ভাতা নেন তাহলে যাদের স্বাক্ষরে এসব হচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। জানা গেছে, কমবেশি সারাদেশেই পুলিশের খাতায় পলাতক হলেও স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা শিক্ষক হিসেবে নিয়মিত বেতন-ভাতা তুলছেন পেট্রোলবোমা হামলার অনেক আসামি। এরা শিক্ষক হলেও জামায়াত-শিবিরের মাঠ পর্যায়ের নেতা। ওই সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা পরিচালনা পর্ষদে থাকা আওয়ামী লীগের নেতারাও তাদের বেতন-ভাতার বিলে প্রতিস্বাক্ষর করেছেন। এ নিয়ে ইতোমধ্যেই স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের প্রতিরোধের মুখেও পড়েছেন পরিচালনা পর্ষদে থাকা আওয়ামী লীগ নেতারা। গত ৫ জানুয়ারি থেকে লাগাতার তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে অবরোধ-হরতাল কর্মসূচী সফল করার জন্য শিক্ষক নামধারী জামায়াত-শিবিরের শিক্ষকরা সংশ্লিষ্ট এলাকায় তা-বে জড়িয়ে পড়েন। তারা ক্লাসরুমের পরিবর্তে রাস্তায় নেমে পেট্রোলবোমা ছুড়ে নাশকতা চালান বলে অভিযোগ রয়েছে। জানতে চাইলে মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এ কে এম ছায়েফ উল্লাহ জনকণ্ঠকে বলেন, গেল মাসের মাঝামাঝি সময়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে একটি চিঠি পাঠিয়ে বলা হয়েছে, দেশের বিভিন্ন মাদ্রাসায় নাশকতা মামলার আসামি শিক্ষক নাম দিয়ে ‘ঘাপটি’ মেরে বসে আছে। এদের বিষয়ে সাবধান হওয়ার পাশাপাশি স্থানীয় পুলিশকে তথ্য দিতে হবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই চিঠির বিষয়ে মাদ্রাসা বোর্ড কী ব্যবস্থা নিয়েছে? জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ্যাকশনের বিষয়ে এখন সব কিছু খোলাসা করে বলা উচিত হবে না। আগেভাগেই বলে দিলে অপরাধীরা ‘এ্যালার্ট’ হয়ে যাবে। তিনি বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি আসার আগে একটি গোয়েন্দা সংস্থাও বোর্ডে চিঠি পাঠায়। ওই সংস্থা তাদের চিঠিতে প্রায় ৪শ’ স্কুল-মাদ্রাসা ও কলেজের শিক্ষকের নামের তালিকা দিয়ে বলে, এরা নাশকতা মামলার আসামি। এদের বিষয়ে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে হবে। চেয়ারম্যান জানান, কেবল এই সময় নয়, অনেক আগে গত সংসদ নির্বাচনের আগে-পরে নাশকতায় জরিতদের বিষয়ে রিপোর্ট দেয়া হয়েছে। এসব শিক্ষককে আমরা নজরদারিতে রেখেছি। আর প্রতিষ্ঠানে অনুপস্থিত থাকলে তাদের বিষয়ে তথ্য দেয়ার জন্য আমরা ইতোমধ্যেই বোর্ডের ওয়েবস্ইাটে বিজ্ঞপ্তিও দিয়েছি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত কোন শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলছিলেন, আল্লাহ্র ওয়াস্তে পেট্রোলবোমা মারা বন্ধ হয়েছে-এটাই কম কিসে। ব্যবস্থার বিষয়ে তিনি পাল্টা প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে?’ বিষয়টির ব্যাখা জানতে চাইলে তিনি বলেন, মন্ত্রণালয়, অধিদফতর, বোর্ডে যারা কাজ করেন তাদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা জামায়াতের রাজনীতিকে পছন্দ করেন। ফলে জামায়াত-শিবিরের কোন শিক্ষকের বিরুদ্ধে শাস্তির নথি উত্থাপন হলেই মাঠ পর্যায়ে অভিযুক্তদের কাছে খবর চলে যায়। তারপরে অভিযুক্তরা স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের নিয়ে মন্ত্রণালয়ে চলে আসে। চলে তদবির। এর পর নথি ধামাচাপা। উত্তরাঞ্চলের মধ্যে গাইবান্ধা জেলার বিভিন্ন নাশকতা ও পেট্রোলবোমা হামলায় অভিযুক্ত জামায়াত-শিবির নেতাদের মধ্যে বিভিন্ন স্কুল-মাদ্রাসায় কর্মরত অন্তত ১৬ জন। কেউ প্রতিষ্ঠান প্রধান আবার কেউ করেন শিক্ষকতা। এদের মধ্যে জামায়াত-শিবিরের ঘাঁটি বলে পরিচিত পলাশবাড়ি উপজেলাতেই আছেন অন্তত ১৪ জন। নাশকতার ২১ মামলা মাথায় নিয়ে পলাতক মেরিরহাট ফাজিল মাদ্রসার অধ্যক্ষের দায়িত্বে থাকা জেলা জামায়াতের সাংগঠনিক সেক্রেটারি মাওলানা নজরুল ইসলাম এবং শিক্ষক হিসেবে দায়িত্বে থাকা উপজেলা জামায়াতের সেক্রেটারি বেলাল উদ্দিন। পুলিশ তাদের খুঁজে না পেলেও খাতাপত্র বলছে, নিয়মিত ক্লাস নিচ্ছেন তারা। বেতন-ভাতা বিলে প্রতিস্বাক্ষর দিচ্ছেন সংসদ সদস্যের সুপারিশে সভাপতির দায়িত্ব পাওয়া আওয়ামী লীগের স্থানীয় এক নেতা। নাশকতার দশ মামলার আসামি পলাশবাড়ি ইউনিয়ন জামায়াতের আমির জামালপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আবু তালেব। পলাতক থেকে নির্বাচিত হন উপজেলা ভাইস -চেয়ারম্যান। সে সময়ও হাজিরা খাতায় নিয়মিত স্বাক্ষর করে বেতন-ভাতা তুলেছেন তিনি। গাইবান্ধার পুলিশ সুপার আশরাফুল ইসলাম বলেছেন, পুলিশ তাদের ক্রমাগত খুঁজছে। কিন্তু পাচ্ছে না। এই সুযোগে তারা এসে বেতন-ভাতা তুলে নিয়ে যাচ্ছে। এটা তো হতে পারে না। এ বিষয়ে গোপনে প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়েছে। রংপুর বিভাগে নাশকতার মামলায় পুলিশের খাতায় পলাতক থাকলেও মাস ফুরোলেই বেতন-ভাতা তুলছেন বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেক শিক্ষক। প্রতিষ্ঠান প্রধানকে ম্যানেজ করে বেতন-ভাতা উত্তোলন করা হচ্ছে। রংপুর সদর, মিঠাপুকুর, পীরগাছা, বদরগঞ্জ, গাইবান্ধা, পলাশবাড়ি, সাদুল্যাপুর, সুন্দরগঞ্জ, দিনাজপুর, চিরিরবন্দর, রানীরবন্দর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, নীলফামারীসহ এই বিভাগের প্রায় আড়াই শ’ শিক্ষক দায়িত্ব পালন না করেও গোপনে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর দিয়ে নিয়মিত বেতন-ভাতা উত্তোলন করছেন। এরই মধ্যে গাইবান্ধা জেলা শিক্ষা অফিসার কুতুব উদ্দিন তার তিন উপজেলায় ১৬ শিক্ষকের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশও দিয়েছেন। জানা গেছে, পলাশবাড়ি মেরিরহাট ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ জেলা জামায়াতের সাংগঠনিক সম্পাদক সম্প্রতি বরখাস্ত হওয়া পলাশবাড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান জামায়াত নেতা কাওছার নজরুল ইসলাম লেবু সহিংসতা ও নাশকতার সাতটি মামলার আসামি হিসেবে পলাতক থাকলেও হাজিরা খাতায় যথারীতি স্বাক্ষর করে বেতন-ভাতা নিচ্ছেন। মাদ্রসাটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন পলাশবাড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা। তার পরও পলাশবাড়ির মাঠেরহাট আবু বকর ফাজিল মাদ্রাসার ভাইস-প্রিন্সিপাল উপজেলা জামায়াতের আমির মাওলানা সাইদুর রহমানও অনুপস্থিত থেকে বেতন-ভাতা উত্তোলন করেছেন। এই প্রতিষ্ঠানেও ম্যানেজিং কমিটির দায়িত্বে রয়েছেন আওয়ামী লীগ মনোনীত দলীয় এক নেতা। পলাশবাড়ি সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার ভাইস-প্রিন্সিপাল আব্দুল মজিদ আকন্দ অনুপস্থিত থেকেও বেতন নিয়েছেন। আরও জানা গেছে, নিয়মিত বেতন-ভাতা নিচ্ছেন পলাশবাড়ি উপজেলার এমন শিক্ষকদের তালিকায় রয়েছেন মেরিরহাট ফাজিল মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষক বেলাল উদ্দিন, জামালপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আবু তালেব, পলাশবাড়ি সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার সুপার রুহুল আমিন ও এবতেদায়ি প্রধান কাজী মোজাম্মেল হোসেন, চকবলা আলিম উদ্দিন দাখিল মাদ্রাসার সহকারী মৌলভী সাখাওয়াত হোসেন, বাসুদেব দাখিল মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষক জিয়াউর রহমান জিয়া, আল্লাহর দরগা দাখিল মাদ্রাসার অফিস সহকারী শহিদুল ইসলাম কাজী ও সহকারী মৌলভী আইয়ুব আলী, হরিণাবাড়ি সিদ্দিকীয়া দারুল উলুম মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষক আব্দুল ওয়াহেদ ও সহকারী শিক্ষক ইছাহাক আলী, মহেশপুর দাখিল মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষক আলমগীর হোসেন। এছাড়া আছেন সাদুল্যাপুর উপজেলার তিলকপাড়া দাখিল মাদ্রাসার সুপার রফিকুল ইসলাম এবং সদর উপজেলার বাদিয়াখালী স্টেশন আলিম মাদ্রাসার প্রভাষক আছাদুল ইসলাম। রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি মোঃ হুমায়ুন কবীর সাংবাদিকদের বলেন, যারা আসলেই অনুপস্থিত, তারা কিভাবে বেতন-ভাতা নিচ্ছেন তা পুলিশের বিষয় না। আইন বা বিধিতে স্পষ্ট বলা আছে, সরকারী কর্মকর্তা এবং জনপ্রতিনিধিদের কেউ যদি অভিযুক্ত হয়, তাহলে তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে। পুলিশ সেটা জানিয়েছে। জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) মহাপরিচালক অধ্যাপক ফাহিমা খাতুন বলেন, মাঠ পর্যায়ের শিক্ষা কর্মকর্তারা এ বিষয়ে এখনও কোন প্রতিবেদন পাঠাননি। তার মতে, সুস্পষ্ট অভিযোগ না এলে এখান থেকে কোন শিক্ষকের এমপিও কর্তন করা সম্ভব নয়। তবে তিনি নিজেই উদ্যোগী হয়ে বিষয়টি মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কাছে জানতে চাইবেন।
×