ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ভারতে মাওবাদী আন্দোলন কোন্্ পথে

প্রকাশিত: ০৪:০২, ২৯ এপ্রিল ২০১৫

ভারতে মাওবাদী আন্দোলন কোন্্ পথে

ভারতে মাওবাদীদের লক্ষ্য হলো সর্বহারাশ্রেণীর নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। তাদের মূল লড়াই রাষ্ট্রক্ষমতা নিয়ন্ত্রণকারী আমলা, বুর্জোয়া ও বৃহৎ ভূস্বামী। এই উদ্দেশ্যে গণবাহিনী গড়ে তুলেছে তারা। তাদের লড়াই রাষ্ট্রের পাহারাদার পুলিশসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধেও। ২৮ এপ্রিলের সম্পাদকীয় পাতার পর আজ পড়ুন শেষাংশ... আদিবাসীরা প্রধান শক্তি ভারতে আদিবাসীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৮ কোটি অর্থাৎ জনসংখ্যার ৬.৮ শতাংশ, দ-কারণ্য ও এর আশপাশেই এরা সর্বাধিক কেন্দ্রীভূত। তবে মাওবাদী আন্দোলনকে কেবল অধিবাসীদের আন্দোলন বললে ঠিক হবে না। এই সংগঠনের ক্যাডারদের মধ্যে শুধু যে তপসিল উপজাতি আছে তা নয়, আছে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ছাত্র এবং দলিত বা অচ্ছুৎ সম্প্রদায়ের লোকজনও। তেমনি আছে পশ্চাদপদ শ্রেণীর তথা সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর বিপুলসংখ্যক যোদ্ধা। আবুজমারের বিপন্ন ও হতদরিদ্র আদিবাসীরা পলাতক মাওবাদীদের নিজেদের মধ্যে আশ্রয় দিয়ে এবং বছরের পর বছর ধরে মাওবাদী দর্শনের সংস্পর্শে থেকে অনেকেই নক্সালবাদী বা মাওবাদী রাজনীতি গ্রহণ করেছে। নক্সাল বা মাওবাদী আন্দোলনের প্রধান ক্ষেত্র হলো ভারতের বিপুল খনিজসম্পদের প্রাণকেন্দ্র। এটা কোন কাকতালীয় ব্যাপার নয় যে, মাওবাদীদের যুদ্ধের মঞ্চটা রয়েছে ঝাড়খন্ডে ও ছত্তিশগড়ে। খনিজসম্পদের দিক দিয়ে এই দুই রাজ্য সবচেয়ে সমৃদ্ধ রাজ্য। ভারতে মজুদ কয়লার ৪০ শতাংশেরও বেশি রয়েছে এই দুই রাজ্যে। কয়লা ছাড়াও এখানে রয়েছে কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার মূল্যের আকরিক লৌহ, চুনাপাথর, ডেলোমাইট ও বক্সাইটের মজুদ। ভারতের স্থবির অর্থনীতিকে এগিয়ে নেয়ার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বিদ্যুত। এ বিদ্যুত শুধু শিল্পেরই প্রসার ঘটানোর জন্যই নয়, দেশের যে এক তৃতীয়াংশ পরিবার তথা ৩০ কোটি মানুষ অন্ধকারে থাকে তাদের ঘর আলোকিত করার জন্যও প্রয়োজন। ঝাড়খন্ড ও ছত্তিশগড়ের কয়লায় বিদ্যুত কেন্দ্র চলে এবং এই বিদ্যুত দিয়ে সুদূরের মোট্রোপলিসগুলো আলোকিত হয়। এখানকার লৌহ ও ইস্পাত দিয়ে তৈরি হয় আধুনিক ভবন যানবাহন ও অন্যান্য প্রকৌশল সরঞ্জাম। অথচ এই দুই রাজ্য দারিদ্র্যের হার ও নক্সালী সহিংসতা সবচেয়ে বেশি। ইউএনডিপির এক সমীক্ষা অনুযায়ী ঝাড়খন্ড ও ছত্তিশগড়সহ ভারতের ৮টি রাজ্য যত দারিদ্র্যের বাস তা আফ্রিকার দরিদ্রতম ২৬টি রাজ্যের সম্মিলিত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর চেয়েও বেশি। খনিজসম্পদে সমৃদ্ধ হবার কারণে এই দুই রাজ্যে ধনী-গরিবের ব্যবধানে যেখানে কমার কথা সেখানে এই ব্যবধান অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে পরিবেশ দূষণ, সহিংসতা ও উদ্বাস্তু সমস্যা। খনিজসম্পদ আহরণ, করতে গিয়ে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে আবার অন্যদিকে বিপুলসংখ্যক মানুষ জমিজমা হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে। এই নিঃস্বদের একাংশ গিয়ে যোগ দিচ্ছে মাওবাদী বা নক্সালী আন্দোলনে। এমন এক পরিস্থিতির মূর্তরূপ বলা যেতে পারে উত্তর ঝাড়খন্ডের করণপুরা ভ্যালি। এটি আজ উন্মুক্ত কয়লা খনি এলাকা। এখানে বিপুল পরিমাণ কয়লা আহরিত হয়। কয়লা খনির জন্য স্থানীয়দের কাছ থেকে জমি নিয়ে ক্ষতিপূরণ দেয়ার ব্যবস্থা আছে। তবে অভিযোগ আছে ক্ষতিপূরণের অঙ্ক পর্যাপ্ত নয়। অনেকে জমি ছেড়ে দিয়ে ক্ষতিপূরণ নিয়ে চলেও গেছে। অন্যরা যাদের আত্মা ও জীবিকা এখানকার মৃত্তিকার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত তারা মাটি কামড়ে আছে। খনিগুলোর আশপাশে ওদের ধূলিধূসর বাড়িঘর বিক্ষিপ্তভাবে দাঁড়িয়ে আছে। কখনো কখনো কয়লা খনির বিস্ফোরণে সৃষ্ট ম্যাকওয়েভে বাড়িঘর ধসে পড়ে কিংবা তাতে ফাটল ধরে। তথাপি তারা জমি ছাড়ে না। হেনজদা গ্রামের ৭৫ শতাংশ মানুষই জমি ছাড়তে নারাজ। মোটামুটি এমন চিত্র খনি এলাকার আশপাশের সব গ্রামে। অথচ খনি কোম্পানিগুলো ছলেবলে-কৌশলে তাদের জমি হাতিয়ে নিচ্ছে। এতে করে স্থানীয় সমাজ বিভাজিত হয়ে পড়েছে। জমিহারা বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে এবং এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগাচ্ছে মাওবাদীরা। কারণ জমি হুকুম দখলের ফলে আশ্রয়চ্যুত মানুষের দল মাওবাদীদের নতুন রিক্রুটের আঁধারে পরিণত হয়েছে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত জমি হুকুম দখলের ফলে ভারতে প্রায় ৬ কোটি লোক বাস্তুচ্যুত হয়েছে এবং তার মধ্যে আদিবাসীর সংখ্যাই প্রায় আড়াই কোটি। ভিটেমাটি ছাড়া হয়ে অবর্ণনীয় দুর্দশার শিকার হয়েছে আদিবাসীরা যাদের অনেকেরই পুনর্বাসন হয়নি। ভারতের ৯০ শতাংশ কয়লা, ৫০ শতাংশেরও বেশি খনিজসম্পদের আঁধার এবং বেশিরভাগ কাক্সিক্ষত জলবিদ্যুত বাঁধের স্থান আদিবাসী এলাকায়। সেখানে জমির হুকুম দখলের ব্যাপারটা সনাতনী সমাজের প্রয়োজন এবং দ্রুত শিল্পায়নরত অর্থনীতির চাহিদার মধ্যে সংঘাতের জন্ম দিয়েছে। চাঁদাবাজিতে মাওবাদীরা এ পরিস্থিতিকে কাজে লাগানো মাওবাদীদের জন্য সহজতর হয়েছে। তবে সবক্ষেত্রে তারা যে স্থানীয়দের জমির অধিকার রক্ষার জন্য মাইনিং কোম্পানিগুলোকে আক্রমণ করে তাড়িয়ে দিচ্ছে তা নয়। বরং অনেক ক্ষেত্রে ওরা কোম্পানির কাছ থেকে চাঁদা আদায় করছে। টেন্ডু পাতার কিংবা ধানের ওপর কর বসিয়ে তারা বছরে যে পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করে তার চেয়ে বেশি আদায় করে চাঁদাবাজি থেকে। আজ ভারতের কোন কোন জায়গায় মাওবাদ আদর্শ দ্বারা নয় বরং চাঁদাবাজি দ্বারা চালিত। কোথাও কোথাও এমনও দেখা যায় যে কয়লা খনি পরিচালনার গোটা কাজটাই করছে মাওবাদীরা। বলাবাহুল্য এমন খনি বিনা লাইসেন্সে গ্রামবাসীরাই গড়ে তুলেছে। মাওবাদী আন্দোলন ভারতের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী ও সর্বাধিক গভীরে ব্যাপ্ত সংঘাত যা ভারতের নিরাপত্তার প্রতি সবচেয়ে বড় অভ্যন্তরীণ হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমান রূপের এই সংঘাতের সূত্রপাত ২০০৪ সালে। সে সময় বিভিন্ন নক্সালপন্থী গ্রুপের সমন্বয়ে গঠিত হয় সিপিআই (মাওবাদী)। মূলত পিপল’স ওয়ার গ্রুপ (পিডব্লিউজি) ও মাওয়িস্ট কমিউনিস্ট সেন্টারের (এমসিসি) একীভবনের মধ্য দিয়ে এই সংগঠনটির উত্থান ঘটে এবং এই উত্থান মাওবাদী কমিউনিস্ট বিপ্লবের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা হিসেবে অভিনন্দিত হয়। মাওবাদী বা নক্সালীরা পশ্চিমবঙ্গ থেকে অন্ধ্রপ্রদেশ হয়ে কেরালা, তামিলনাড়ু ও কর্নাটকের সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকার ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে। মাওবাদী আন্দোলন ভারতের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী ও সর্বাধিক গভীরে ব্যাপ্ত সংঘাত যা সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ভাষায় ভারতের নিরাপত্তার প্রতি সবচেয়ে বড় হুমকি। মাওবাদীরা খনি এলাকার নিরাপত্তা যোগায়। বিনিময়ে মুনাফার একটা ভাগ নেয়। পুলিশও ব্যাপারটা জানে এবং তারাও ভাগ বসায়। মাওবাদীরা ঘুষ দিয়ে দুর্নীতিবাজ অফিসারদের ম্যানেজ করে। এভাবে মাওবাদী এলাকায় হাজার হাজার বেআইনী কোক কয়লা খনি গড়ে উঠেছে। এক একটি খনি থেকে মাওবাদীরা দিনে আয় করছে এক হাজার ডলারের সমপরিমাণ অর্থ। মোটেই কম কিছু নয়। এভাবে দ-কারণ্য নক্সালীদের আশ্রয় দিয়েছে আর খনিজসম্পদ যুগিয়েছে অর্থ। সূত্র : দি হিন্দু এবং ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক
×