ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

হাজার হাজার শিক্ষার্থীর মুক্তিযুদ্ধের ভাবাদর্শ প্রতিষ্ঠার শপথ

প্রকাশিত: ০৬:০০, ২৫ এপ্রিল ২০১৫

হাজার হাজার শিক্ষার্থীর মুক্তিযুদ্ধের ভাবাদর্শ প্রতিষ্ঠার শপথ

মোরসালিন মিজান ॥ মস্তবড় উৎসব। আট হাজারের বেশি ছেলেমেয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠ যেন উপচে পড়ছিল! শুক্রবার দেশের বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষার্থীরা সমবেত হয়েছিল এখানে। মুক্তির উৎসবে যোগ দিয়েছিল তারা। হ্যাঁ, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের আয়োজন। এবার চতুর্দশতম। সঙ্গত কারণেই উৎসবটি সম্পর্কে অনেকে জানেন। তবে সশরীরে উপস্থিত হলে মন ভরে যায়। আয়োজনটির বিশালত্ব ও সৌন্দর্যের নানা দিক মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী মানুষদের বিশেষভাবে মুগ্ধ করে। এবারও এর কোন ব্যতিক্রম হয়নি। সকাল থেকেই জমে উঠেছিল উৎসব। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা গানে নাচে ফুটিয়ে তুলেছে মুক্তিযুদ্ধকে। যাঁদের লড়াই আর আত্মত্যাগের বিনিময়ে আজকের বাংলাদেশ, সেই শহীদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়েছে। শপথ নিয়েছেÑ মুক্তিযুদ্ধের ভাবাদর্শকে বুকে বাঁচিয়ে রাখার। সব মিলিয়ে অনন্য সুন্দর একটি দিন। প্রতি বছরই মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর পরিদর্শন করতে আসে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা। গত বছর আসা শিক্ষার্থীদের নিয়ে আয়োজন করা হয় মুক্তির উৎসব-২০১৫। উৎসব উপলক্ষে যথারীতি খোলা মাঠে তৈরি করা হয়েছিল বিশাল প্যান্ডেল। এর নিচে হাঁটু ভাঁজ করে বসেছিল আগামী দিনের নাগরিকরা। সকলের গায়ে স্কুলের ইউনিফর্ম। মাথায় লাল-সবুজ রঙের ক্যাপ। দেখে মনে হয়েছে, এক টুকরো বাংলাদেশ। সকাল ৯টার কিছু পরে পতাকা উত্তোলন, জাতীয়সঙ্গীত ও দেশের গান পরিবেশনের মধ্যদিয়ে উৎসবের সূচনা করা হয়। স্বাগত বক্তব্য রাখেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ডাঃ সারওয়ার আলী। তিনি বলেন, নতুন প্রজন্মকে একাত্তরের বেদনা, নৃশংসতা ও গৌরবের ইতিহাসটির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়ার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছি আমরা। দেশ নানা দিক দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ভাবাদর্শ প্রতিষ্ঠার কাজ সে তুলনায় পিছিয়ে। আগামী প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ গড়ার তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, তোমাদের মুক্তচিন্তার মুক্তবুদ্ধির মানুষ হতে হবে। যুক্তি ছাড়া কোনকিছু তোমরা গ্রহণ করবে না। ডাঃ সারওয়ার আলীর বক্তব্যটিই আরেকটু ব্যাখ্যা করেন ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী। শিক্ষার্থীদের শপথবাক্য পাঠ করান তিনি।। তাঁর সঙ্গে হাজার হাজার ছেলেমেয়ে কণ্ঠ মিলিয়ে বলেÑ যাঁদের আত্মদান ও বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের ফলে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, তাঁদের স্মৃতি আমরা বহন করব প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। মুক্তিযুদ্ধের যে অগণিত নারী নির্যাতিত হয়েছেন, আমরা তাঁদের শ্রদ্ধা জানাই। তাঁদের দুঃখ ঘুচিয়ে দিতে পাশে থাকব আমরা। সকল ধর্মের মানুষের অধিকার ও সম্প্রীতির স্বদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে যাত্রা করেছিল বাংলাদেশ। স্বদেশের সেই স্বপ্নযাত্রার পতাকা হাতে আমরা ধর্মের অপব্যবহার ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতা রুখতে সব সময় সজাগ থাকব। একাত্তরে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচার ন্যায় ও সত্যের জয় ঘোষণা করছে। এই অর্জন সার্থক করতে আমরা সদা প্রস্তুত থাকব। সকল ধর্ম ও জাতিসত্তার মানুষের সমান অধিকার ও মুক্তমনের বিকাশ উপযোগী উদার অসাম্প্রদায়িক মানবিক সমাজ গড়ে তুলতে আমরা দৃঢ়ভাবে কাজ করে যাব। জয় বাংলা চিৎকারে চারপাশ কাঁপিয়ে দিয়ে শেষ হয় অনন্য সুন্দর শপথগ্রহণ। উৎসবে যোগ দেয়া শিশু-কিশোরদের বাড়তি নজড় কেড়েছিলেন ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল। মঞ্চে তাঁকে দেখামাত্রই করতালিতে ফেটে পড়ে ভক্তরা। এদিনও নিজস্ব ভঙ্গিতেই শুরু করেন জাফর ইকবাল। লাল-সবুজের পতাকার দিকে আঙ্গুল উঁচিয়ে তিনি বলেন, এই যে পতাকা দেখছ, এটি যুদ্ধ করে পাওয়া। ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের বয়স ছিল ১৭ কিংবা ১৮ বছর। তাই না? তোমাদের বয়সে তাঁরা যুদ্ধ করেন। তাঁদের এত ত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া দেশটিকে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, দেশটাকে ভালবাসতে হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ পেয়েছি আমরা। এমন কিছু করা যাবে না যাতে তাঁরা মনে কষ্ট পান। বাচ্চাদের প্রিয় ক্রিকেট প্রসঙ্গ টেনে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিমাদের বৈষম্যমূলক আচরণের ইতিহাসটি বর্ণনা করেন সুবক্তা। বলেন, আমরা কাকে বাংলাওয়াশ করেছি? শিক্ষার্থীরা সমস্বরে চিৎকার করে ওঠেÑ পাকিস্তানকে। জাফর ইকবাল এরপর বলেন, পাকিস্তান আমলেও আমরা ক্রিকেট খেলতে জানতাম। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের লোকেরা আমাদের খেলায় নেয়নি। আর এখন আমাদের স্বাধীন দেশ। এখন ক্রিকেট দলে সবাই বাঙালী। ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়ার কথা মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, আমরা বাংলাওয়াশ করব। সেই সঙ্গে লেখাপড়াও করব। কেমন? সঙ্গে সঙ্গে ছোট ছোট ভক্তরা চিৎকার করে ওঠে। জানিয়ে দেয়, প্রিয় স্যারের কথা তারা মেনে চলবে। নারী-পুরুষের পরস্পরের প্রতি সম্মান দেখানোর শিক্ষাটিও এখান থেকে দেয়া হয়। জাফর ইকবাল মেয়েদের দেখে রাখার জন্য ছেলেদের দ্বায়িত্ব দেন। তেমনি মেয়েদের বলেন, তোমাদের ভাইদের দেখে রাখবে। এভাবে খুব মিষ্টি একটি সময় উপহার দিয়ে যান তিনি। উৎসব যেহেতু, প্রচুর গান হয়েছে। নাচ হয়েছে। স্বাধীন বাংলা বেতারের গান বার বার ফিরিয়ে নিয়ে গেছে একাত্তরে। নাচের মুদ্রায় তুলে ধরা হয়েছে আগামীর বাংলাদেশ। জনপ্রিয় শিল্পীদের সঙ্গে ছেলেমেয়েরা গেয়েছে। নেচেছে। এমন হাসিরাশি আনন্দের মাধ্যমে যে পাঠ, নিশ্চয়ই একদিন বড় কাজে দেবে। এই ছেলেমেয়েদের হাত ধরেই হয়ত ঘুরে দাঁড়াবে বাংলাদেশ। সকলের তাই প্রত্যাশা।
×